চারদিকে ধুরুম ধুরুম শব্দ। বোমার শব্দে কেঁপে উঠেছে গোটা গ্রাম। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শাহবাজপুরের ব্রিজটিও ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শাহবাজপুরের পাশের গ্রাম দেওড়া। ব্রাহ্মনবাড়িয়া মহকুমার সরাইল থানার একটি গ্রাম। মহাসড়কের কাছে হওয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি ধুলো উড়িয়ে গ্রামের রাস্তা পার হয়। ভয়ে জবুথবু গ্রামের মা-ঝিরা। কাকে কখন ধরে নিয়ে যায়। কাকে কখন গুলি করে হত্যা করেÑ এ ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে বসবাস গ্রামবাসীর। এরই মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করতে তাদের দোসর, রাজাকার আর আলবদরদের তৎপরতা দিন দিন বেড়ে যায়। ওই গ্রামের এক মায়ের মুখে শোনা যুদ্ধ সময়ের কথা আজও মনে পড়ে। সেই মা আজ আর পৃথিবীতে নেই। ছোট সময়ে যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে সেই মা কেঁদে বুক ভাসাতেন। ওই গ্রামেরই আরেক মা বঙ্গবন্ধুকে নিজ হাতে স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন। এই সেই দেওড়া গ্রাম। যে গ্রামে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে প্রতিটি ঘর ছিল ফাঁকা। আলবদর বাহিনী আর পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে মা বোনেরা চলে যান দূর গ্রামে। পার্শ্ববর্তী নাসিরনগর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। যেখানে আলবদরের ভয় নেই। যেখানে পাকিস্তানি সেনারা যেতে পারবে না। সেসব গ্রামের স্বজনদের বাড়ি গিয়ে ওঠেন তারা। কেউ কিছু বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে পারেননি। কেউ পুঁটলায় করে কিছু চিড়া, গুড় নিয়ে গেছেন। কেউবা খালি হাতে প্রাণ নিয়ে ছুটেছেন। সেই মা তার ৩১ দিনের শিশু সন্তানকে বাঁচাতে যে লড়াই করেছেন তার বর্ণনা দিতে দিতে রাত পার করতেন। ছোট সময়ে যখন হাইস্কুলে পড়ি তখন বন্ধু বান্ধবরা মিলে ওই মাকে ঘিরে ধরতাম যুদ্ধ দিনের কথা শুনতে। ওই মা বলতেন- যারা যুদ্ধ দেখেনি তারা যুদ্ধের মর্ম কি বুঝবেন। যারা যুদ্ধ দেখেনি তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের দোসরদের কুকীর্তির কথাই বা কি বুঝবেন? এভাবে তিনি বলে যেতে থাকেন তার গল্প। একে একে আমার পাঁচটি সন্তান জন্মের পর পর মারা যায়। আমি তখন পাগলপ্রায়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই সর্বত্র আলোচনা হতে থাকে দেশে যুদ্ধ হতে পারে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে যুদ্ধ হবে বুঝতে পারিনি। ৯ই মার্চ আমার পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। আদর করে তার নাম রাখি সোহাগ। ২৫শে মার্চ রাতে যখন ঢাকায় বর্বর হামলা চলে তখনই বুঝতে পারি আর রক্ষা নেই। শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। এ যুদ্ধ যে এত ভয়াবহ হবে কে জানত? আকাশে বিমানের গর্জন। সড়কে সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীর টহল। মহাসড়ক থেকে ভেসে আসছে গুলাগুলির শব্দ। বাড়ির পাশেই ঝোপে বাংকার করা হয়। বাড়ির পুরুষরা সেই বাংকার খুঁড়ে। গাড়ির শব্দ শুনলেই বাড়ির মহিলারা দৌড়ে সেই বাংকারে গিয়ে লুকাতাম। এভাবে কদিন চলার পর খবর চলে যায় রাজাকার আলবদরদের কাছে। শাহবাজপুরের ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলা হয়। এখন পাকিস্তানি বাহিনী ব্রিজ পার হতে না পেরে আমাদের গ্রামে হামলা চালাতে থাকে। এক রাতে এক কাপড়ে ৩১ দিনের সন্তানকে কোলে নিয়ে বাড়ি ছাড়ি। উত্তর দিকে হাওরের দিকে দৌড়াচ্ছি। শীতের রাত। দেখি আমি একা নই। সামনে পেছনে শত শত মহিলা দৌড়াচ্ছে। নিজের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য, জীবন রক্ষার জন্য। মাইলের পর মাইল দৌড়ে গিয়ে হাওরের পাশের গ্রাম গুলোতে স্বজনদের বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে তারা। আমিও শাহজাদাপুর গ্রামে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিই। ওই গ্রামের প্রতিটি বাড়িই যেন একেকটি আশ্রয়কেন্দ্র। কোনো খাবার নেই। ভাতের সঙ্গে তরকারি নেই। নুন বা অন্য যা সামনে পাচ্ছে তাই এনে দিচ্ছে স্বজনরা। সেইসব দিনের কষ্টকথা ভুলে যায় সবাই। যখন মনে করে দেশকে শক্রমুক্ত করতে দামাল ছেলেরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমেছে। এ যুদ্ধ সফল হবেই। ওই মা ছোট ছোট শিশুদের চারপাশে বসিয়ে বলতেন, রাতে দূরের সেই স্বজনদের বাড়িতে ঘুমুতে পারেনি কেউ। কারো কোলে ছোট্ট শিশু, কেউবা প্রসূতি, আবার কেউ বৃদ্ধ। কেউ কাঁদছে পেটের ক্ষুধায়। কেউ চিৎকার করে উঠছে বোমার শব্দে। ঘরের মেঝেতে খড় বিছিয়ে তার ওপর দেয়া হতো চট। কোনো বালিশ নেই। শীতের দিনে নেই শরীরে দেয়ার জন্য কোনো কাঁথা। লেপতো অলিক কল্পনা। এ ছাড়া সে সময় গ্রামের দুই একটি বাড়ি ছাড়া অন্য কারো ঘরে লেপের চিন্তা করতেই পারত না কেউ। নানা গুজবও ছড়ানো হতো সে সময়। রাজাকার আলবদররাই সে সময় গুজব ছড়াতো বেশি। হঠাৎ এক রাতে গুজব রটে গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা এসেছে। যে যেভাবে ছিলেন সেভাবেই দৌড়াতে থাকেন। ওই মাও তার শিশু পুত্রকে বুকে নিয়ে দৌড়াতে থাকেন। কিছু দূর যাওয়ার পর এক পুকুর পাড়ে পা পিছলে পড়ে যান তিনি। তার শিশুপুত্র গিয়ে পড়ে একেবারে পুকুরের পানিতে। ওই মার চিৎকারে আকাশ ভারি হয়ে ওঠে। কোথা থেকে এক যুবক এসে পানিতে লাফিয়ে পড়ে। তুলে আনে ছোট শিশুকে। শিশুটির কোনো নাড়াচাড়া নেই। পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার পর হঠাৎ কেঁদে ওঠে শিশুটি। এমন কত স্মৃতি যে ওই মা শুনাতেন যুদ্ধ দিনের কথায়। বলতেন, কত দিন, কত রাত যে না খেয়ে থেকেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তারপরও সবাই আশায় থেকেছি একদিন দেশ স্বাধীন হবে। স্বাধীন দেশে কেউ আমাদের অধিকার কেড়ে নিতে পারবে না। প্রত্যেকেই গলা ছেড়ে তার অধিকারের কথা বলতে পারবে। ওই মা একদিন শুনালেন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহর কথা। বলতেন, ওই যে শাহবাজপুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকে ভিক্ষা করে শহীদুল্লাহ সে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। যুদ্ধের পর গ্রামে ফিরে এলেও তার কোথাও কোনো কাজ হয়নি। পিতার যেসব সম্পত্তি ছিল তা বিক্রি করে এখন ফকির। শাহবাজপুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকে কোনো মানুষ বাস থেকে নামলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। লাজুক চেহারায় তাকিয়ে থাকে। দেখেই বুঝা যাচ্ছিল ভিক্ষা করতে তার লজ্জা হচ্ছিল। কিন্তু নিরুপায় শহীদুল্লাহ ভিক্ষা করতে হয়েছে। সংসার বাঁচাতে, ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে তাকে ভিক্ষা করতে হয়েছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভিক্ষা করতে হয়েছে তাকে। তার মৃত্যুর পর গ্রামে প্রশাসনের লোকজন গিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়েছিল। তার লাশ লাল সবুজের পতাকায় মোড়ানো হয়েছিল। ওই মা বলেন, শহীদুল্লাহতো তার এ সম্মান দেখেনি। এমনকি শহীদুল্লাহ যে একজন মুক্তিযোদ্ধা একথাও এ প্রজন্মের অনেকে জানত না। তার মৃত্যুর পরই অনেকে জানতে পারে তিনি ছিলেন দেশ স্বাধীন করার একজন বীর সেনানী। হ্যাঁ, ক’বছর আগেও দেখেছি শহীদুল্লাহকে। ঢাকা থেকে গিয়ে শাহবাজপুর বাস স্ট্যান্ডে নামলেই তাকে দেখা যেত। চোখাচোখি হলেই তিনি লাজুক ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতেন। জিজ্ঞেস করতেন ভালো আছেন বাবা? বুঝতে বাকি থাকে না কারোই। করুণা নয়, সবাই নিজ থেকেই তার প্রতি হাত বাড়িয়ে দিতেন। দিনের পর দিন তাকে দেখেছি শাহবাজপুর বাসস্ট্যান্ডে। এখন আর তাকে দেখি না। কেউ আর তার মতো আদর করে জিজ্ঞেস করেন না ভাল আছেন বাবা? শহীদুল্লাহ আজ আর পৃথিবীতে নেই। বিজয় দিবস গেল। কেউ কি খোঁজ নিয়েছে শহীদুল্লাহর পরিবারের?
ওই মা একজনের নাম বলতেন সে যুদ্ধের সময় রাজাকার ছিল। পাকিস্তানি আর্মিরা এসে তার সঙ্গে বৈঠক করত। গোটা যুদ্ধসময়ে সে ইস্ত্রি করা কাপড় পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটেছে। মানুষকে বুঝিয়েছে দেশ স্বাধীন হবে না। আমরা পাকিস্তানই থাকব। যারা যুদ্ধ করছে ওরা দেশের শক্র। ওদের রক্ষা নেই। দেশ স্বাধীনের পরও সে বুক ফুলিয়ে চলেছে। তার কিছুই হয়নি। অবশ্য তার মৃত্যুর পর তার অনেক স্বজনও তার লাশ দেখতে যায়নি। শুধু কি তাই? ওই মা বলতেন, রাজাকাররা ছিল চিহ্নিত। স্বাধীনতার পর রাজাকারদের তালিকা করে ফেললে সহজ হতো। গ্রামে গ্রামে সবাই রাজাকারদের বাড়ি দেখিয়ে বলত ওই যে রাজাকারের বাড়ি। স্বাধীনতার পর অনেক রাজাকার মিশে গেছে সমাজের সঙ্গে। এছাড়া নতুন প্রজন্ম রাজাকার সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কেও তেমন কিছু জানে না। কারণ তাদের জানতে দেয়া হয়নি। এটাও একটা কৌশল হতে পারে রাজাকারদের। এ ছাড়া ওই মা বলতেন, পাক সেনা শুনলেই আমার ক্ষোভ বেড়ে যায়। পাক মানে পবিত্র। রাজাকাররা স্বাধীনতার সময়ে পাকিস্তানি সেনাদের সুকৌশলে পাক সেনা হিসাবে আখ্যা দিয়ে দেয়। যা এখনও স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক মানুষ পাক সেনা বলে। আসলে পাকিস্তানি সেনারা কি পবিত্র ছিল। তাহলে তাদের পাক সেনা কেন বলব? আমরা অবশ্যই তাদের ঘৃণাভরে পাকিস্তানি সেনা বলব। আর কখনই পাক সেনা বলব না। ওই মার কথা এখন খুব মনে পড়ে। সেদিন পাক আর পাকিস্তানি শব্দ কিংবা অর্থ না বুঝলেও আজ সব পরিষ্কার। সেই মা-তো সত্যিই বলেছেন। প্রশ্ন জাগে-আমরা কেন পাক সেনা বলে দেশের শক্রদের পক্ষান্তরে পবিত্র বানিয়ে ফেলছি? আজ সেই মা নেই। যুদ্ধ দিনের গল্পও কেউ শোনায় না।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৪২