ভোট তখনও শুরুই হয়নি। ফেনীর ছাগলনাইয়ায় ২৩০০ ভোটে বাক্স ভর্তি হয়ে গেছে। আর ভোট শুরুর পর চারদিক থেকে খবর আসতে থাকে একের পর এক কেন্দ্র দখলের। উপজেলা নির্বাচনে যেন ভোটের উৎসব নয়, দখলের উৎসব। ভোটাররা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখলেন। দেখলেন প্রিজাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কোন অভিযোগেও কাজ হয়নি। তাই অসহায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে পথ খোলাসা করে দিয়ে গেছেন। পঞ্চম ধাপে এসে এমন চিত্র দেখে অবশ্য ভোটাররা অবাক হননি। এমনটি হবে আগে থেকেই যেন তারা প্র¯‘ত ছিলেন। কারণ, ৫ই জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে যে দখলের শুরু তার ধারাবাহিকতা চলছে মাত্র। গতকাল সরজমিন রাজধানীর একেবারে পাশের উপজেলায় নির্বাচনী পরিবেশ দেখতে গেলে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি বললেন, এটা ভোট উৎসব নয় বাবা দখল উৎসব। এ উৎসব দেখতে আমরা দীর্ঘ আন্দোলন করে স্বৈরাচার এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামাইনি। এমন দৃশ্য দেখতে ১৯৯৬ সালে আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনিনি। দুঃখ, সবাই সামনে এগুলেও আমরা ছুটছি পেছনে। এর জন্য দায়ী কে? সত্যিই তো ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৪ সাল। মাঝখানে প্রায় দুই যুগ। দীর্ঘ এ সময়ে মানুষ ভুলেই গিয়েছিল ভোট উৎসবে জোর যার মুল্লুক তার এমন পরি¯ি’তি ফের সৃষ্টি হবে দেশে। ভোট নিয়ে রক্তাক্ত ইতিহাস লিখতে হবে আবার। মাগুরা, সখিপুর ফের ফিরে আসবে দেশে। এ জন্যই কি বুকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক’ লিখে রাজপথে রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন নূর হোসেন? ডা. মিলন কি এ জন্যই প্রাণ দিয়েছিলেন? আগে নদীতে চর জেগে উঠলে নদী তীরবর্তী গ্রামবাসীর মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। যে গ্রামের লাঠিয়াল শক্ত তারাই জোর করে দখলে নিতো চর। এ নিয়ে সাজসাজ রব পড়ত। প্র¯‘তি থাকতো আগে থেকেই। এখন চর দখলের তেমন খবর শোনা যায় না। আশির দশকে দু’একটি ছবিতে চর দখলের দৃশ্য ছিল। সেখানে দেখানো হতো লাঠিয়াল সর্দারের নেতৃত্বে চর দখলের জন্য বাহিনী নিয়ে ছুটছে সর্দার। পেছনে পেছনে সবার হাতি দেশীয় অস্ত্র, লাঠি, বল্লম। চরে গিয়ে দু’পক্ষ মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। এক সময় সংঘর্ষে যে জয়ী হতো সে-ই হতো চরের মালিক। এ মালিকের পক্ষ হয়েই সবাই নেমেছিল চর দখলে। সেই চর দখলের দৃশ্য দেখা গেল গতকাল ভোটের মাঠে। টাঙ্গাইলের গোপালপুরে, সিরাজগঞ্জে ছোট ছোট শিশু, কিশোর ভোট দিয়েছে। গোপালপুরের এক কিশোরকে ভোট দিতে দেখে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমি নই, আমার আব্বা ভোটার। আব্বার ভোট আমি দিতে এসেছি। সাতক্ষীরায় স্বয়ং পুলিশই নেমেছে ভোট ডাকাতিতে। কি আশ্চর্য দেশ। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী যেখানে অনিয়ম দূর করবে, সেখানে তারা নিজেরাই মাঠে নামে প্রভাবশালী প্রার্থীর পক্ষে। টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে ঘটেছে ভিন্ন চিত্র। সেখানে রাত পোহাবার আগেই ৩৫ কেন্দ্রের ভোট শেষ হয়ে গেছে। এসব দেখে একটি গল্পের কথা খুব মনে পড়ছে। দুই মাতাল গভীর রাতে বাড়ি ফিরছিল। দু’জন হাঁটতে হাঁটতে একটি পাঁচ তলা ভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারা। একজন আরেকজনকে বলে, ওই দেখছস, আমাগো মহল্লায় তো কোন বিল্ডিং নাই। দেখ এখানে কত বড় বিল্ডিং। অন্যজন বলে, এক কাজ কর, চল, দুইজনে এই বিল্ডিংটারে আমরা আমাদের মহল্লায় নিয়ে যাই। দু’জনে মিলে শুরু করে ধাক্কানো। ধাক্কাতে ধাক্কাতে একেবারে কাহিল। গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। একটু থেমে একজন জিজ্ঞেস করছে, আমরা যে এতক্ষণ ধাক্কালাম এ সময়ে কতটুকু এগিয়েছি? অন্যজন বলে, নারে অনেক দূর এগিয়েছি। কেমনে বুঝলি? দেখ আমরা যখন ধাক্কানো শুরু করি তখন চাঁদটা ছিল ওই খানে। আর এখন দেখ কোথায়? অনেক দূর। আমরা এগিয়েছি বলেই চাঁদটা পেছনে চলে গেছে। তাইতো। তাহলে চল আবার ধাক্কানো শুরু করি। এবার শরীরের কাপড় খুলে পেছনে রেখে ধাক্কানো শুরু করে দু’জন। জোরে ধাক্কানো। অনেকক্ষণ পর আবার একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করছে, কইরে কতটুকু এগুলাম আমরা? অন্যজন পেছনের দিকে তাকায়। দেখে যেখানে কাপড় রেখেছিল সেখানে কাপড় নেই। দেখেই সে বলে ওঠে অনেক দূর এগিয়েছি। কিভাবে বুঝলি? আরে কাপড় খুলে পেছনে রেখেছিলাম না? দেখ কাপড় নেই। নিশ্চই কাপড় পেছনে পড়েছে, আর আমরা এগিয়েছি অনেক দূর। আসলে দুজনে যখন ধাক্কাতে ব্যস্ত তখন ওই রাস্তা দিয়ে যা”িছল চোর। ওই চোর বেটা তাদের পেছন থেকে কাপড় নিয়ে চলে যায়। মাতাল দু’জন মনে করছে বিল্ডিং সামনে এগিয়েছে তাই কাপড় পেছনে রয়ে গেছে। দু’জনে আর সময় না বাড়িয়ে আবারও ধাক্কানো শুরু করে। ধাক্কাতে ধাক্কাতে সকাল হয়ে গেছে। এবার দেখে যেখান থেকে শুরু করেছিল বিল্ডিং ধাক্কানো সেখানেই রয়ে গেছে তারা। একটুও এগোয়নি তারা। উপজেলা নির্বাচনের অব¯’া দেখে তাই মনে হয়। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেও আমরা ভোটের অধিকার ফিরে পাইনি। বরং যেখানে ছিল, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এসেও সেখানেই যেন রয়ে গেলাম আমরা।