ঈদুল আজহার আগের রাতে নগরীর হাজারীবাগ এলাকায় সাত বছরের একটি শিশুকে সুলতানগঞ্জ এলাকার এক যুবক ধর্ষণ করে। এ কথা কাউকে বললে হত্যারও হুমকি দেয়া হয়। পরে বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ায় থানায় মামলা হয় এবং শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়।
কিছুদিন আগে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখায় এক ছাত্রীকে কোচিং সেন্টারে আটক করে শ্লীলতাহানির ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক পরিমলকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদে ওই শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করার কথা স্বীকার করে। অন্যদিকে ঢাকা সিটি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী শামীমা নাসরিন সুইটিকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় নিহত ছাত্রীর বাবা আলাউদ্দিন খন্দকার মেয়ের কথিত মামাবেশী প্রেমিক সাইফুল ইসলাম রনিসহ তিনজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। পুলিশ এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খোকন নামে একজনকে আটক করে। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, সুইটিকে ৪-৫ জন মিলে ধর্ষণ করে। ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য হত্যার পর আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়। খিলক্ষেত থানার ওসি শামীম হোসেন বলেন, নিহত ছাত্রীর সঙ্গে আসামি সাইফুল ইসলামের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের জন্য চাপ দেয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।
গত ৩১ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুর তাজমহল রোড়ের সি-ব্লকের ১২/৬ বাড়ির চতুর্থ তলায় মডেল আদৃতাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। তার প্রেমিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশিষ কর্মকারকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
গত সেপ্টেম্বরে রাজধানীর আদাবর মাঠখোলা মহল্লায় এক কিশোরী (১৫) গণধর্ষণের শিকার হয়। ওই কিশোরীর মা আমেলা বেগম অভিযোগ করেন, রাত সাড়ে ৮টায় তার মেয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে আদাবরে বাসায় ফিরছিল। ওই সময় স্থানীয় বখাটে শুকুর আলী তিন সহযোগীসহ মেয়েকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। তারা সবাই মিলে মাঠখোলার ফাঁকা একটি স্থানে তার ওপর নির্যাতন চালায়। আশপাশের লোকজন টের পেলে ধর্ষকরা পালিয়ে যায়। এরপর কিশোরীকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে গভীর রাতে ঢামেক হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।
কিছুদিন পরই মোহাম্মদপুরে পুলপার বটতলার একটি বাসায় অপর কিশোরী (১৪) ধর্ষণের শিকার হয়।
এছাড়া বাগেরহাটে প্রথম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে প্রতিবেশী। অপরদিকে, মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ভাবনপাড়া প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভজন কুমার শিকদার ৫ম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। এ অভিযোগে তিনদিন পর থানায় মামলা হয়।
গত ২ জুন গাজীপুরের টঙ্গীতে এক তরুণী রাতে ঘরের বাইরে গেলে বাড়িওয়ালার ছেলে মইনুদ্দিন ও তার কয়েক সহযোগী তাকে ধর্ষণ করে এবং পরে তরুণীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। গুরুতর অবস্থায় মেয়েটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ৫ জুন মারা যায়।
এদিকে, গত শবেবরাত রাতে গাজীপুরে ধর্ষণের শিকার ৬ বছরের এক শিশু ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এ ঘটনায় জনতা ধর্ষক জুয়েলকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেয়।
গত ১৬ অক্টোবর রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায় শারমীন (১০) নামের স্কুলছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। আগের দিন সকাল থেকে সে নিখোঁজ ছিল। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ বলছে তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
১৫ অক্টোবর এক কলেজ ছাত্রী সাতক্ষীরা শহরে বেড়াতে আসেন। বিকালে বাড়ি ফেরার সময় তার সঙ্গে দেখা হয় তাদের পারিবারিকভাবে পরিচিত দেবাহাটা থানার পুলিশ কনস্টেবল সালাউদ্দিনের সঙ্গে। সালাউদ্দিন কলেজ ছাত্রীকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে সাতক্ষীরা শহরের শাপলা হোটেলে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় পুলিশ কনস্টেবল সালাউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গত ৭ সেপ্টেম্বর বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জে এক গৃহবধূকে ঋণ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ঘরে আটকে রেখে পাশবিক অত্যাচার চালায় ও তার নগ্ন ছবি তুলে তা প্রচার করে মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতা।
প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। কোনোটি মিডিয়ায় প্রচার
হয়, অনেক ঘটনা থেকে যায় আড়ালে। মান-সম্মানের কথা বিবেচনা করে এসব ঘটনা অনেকেই প্রকাশ করতে কিংবা মামলা করতে চায় না। পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বর্তমান সরকারের ৩৪ মাসে সারাদেশে প্রায় ১৬শ’ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৫৮৩ নারী-শিশু। গণধর্ষণ করা হয়েছে ৪০৩ জনকে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২১০ জনকে। অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ৪৪ জন। তবে এ পরিসংখ্যানের চেয়ে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ধর্ষণের প্রকৃত ঘটনা পরিসংখ্যানের কয়েকগুণ—বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
গত ২৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের এক রায়ে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দেশের প্রতিটি থানায় আলাদা সেল গঠন করতে হবে। এক মাস পর পর যৌন হয়রানির মামলার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে থানা সেল। কিন্তু গত ১০ মাসেও আদালতের এ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি।
ক্রমেই নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে চলছে। শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরাও। ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড ও লাশ গুম করার ঘটনাও ঘটছে। পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতে নারীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটছে। সুষ্ঠু বিচার পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। ফরেনসিক পরীক্ষার ঝামেলা, আলমত সংগ্রহ এবং অভিযুক্তকে পুলিশের কাছে উপস্থিত হতে বাধ্য করায় অনেকেই লোকলজ্জায় ঘটনা এড়িয়ে যেতে চায়। থানায় মামলা হলেও গ্রেফতার হয় না অপরাধী। কেউ গ্রেফতার হলেও মামলা বেশি দূর এগোয় না। প্রভাবশালী বা ক্ষমতাসীনদের হুমকি, কখনও তাদের মধ্যস্থতায় মীমাংসা করতে বাধ্য হয় অভিযুক্তরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, নিরাপত্তার অভাবে অনেকে নির্যাতিত হয়েও মামলা করতে ভয় পায়। আবার অনেক মামলায় আসামি পক্ষের ভয়ে মানুষ সাক্ষ্য দিতে চায় না। এর ফলে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক সময় অপরাধীরা আদালত থেকে পার পেয়ে যায়। এজন্য ভিকটিম অ্যান্ড উইটনেস প্রটেকশন অ্যাক্ট নামে নতুন একটি আইন করা হচ্ছে বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গত ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭৩ জন। এর মধ্যে শিশু ৩৮৫ জন, এ ঘটনায় খুন ৫১ জন, গণধর্ষণ ১০৮ জন ও আত্মহত্যা করেছে ৩০ জন। ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৫৬ জন, শিশু ৩০৮ জন, হত্যা করা হয় ৬১ জনকে, গণধর্ষণের শিকার ১১৯ জন ও আত্মহত্যা করেছে ৬ জন। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৫৪ জন, শিশু ২৪৩ জন, হত্যা ৯৭ জন, গণধর্ষণ ১৭৬ জন ও আত্মহত্যা করেছে ৮ জন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:৪৯