ধিরিঙ্গি মহিলার ক্রমাগত কান পচানো "মামা তোমাকে যেতেই হবে" শুনে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সেই যন্ত্রণা থেকে বাচতে অবশেষে ঘরকুনো এই বঙ্গসন্তান সামান্য বাক্স প্যাটরা নিয়েই উড়াল দিলাম সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে।
বুক ঢিপ ঢিপ করছিলো। কেন জানি না, শ্বেতাঙ্গ দেখলেই আমার ভয় লাগে। মনে হয় যেন এক্ষুনি ডেকে নিয়ে কড়া ধমক লাগাবে।
এয়ারপোর্টে ঝামেলা হয়নি। হতেই পারে না। অন্তত আমার বেলায় অসম্ভব। প্লেনেও ঝামেলা নেই। শুধু মিজারুল ভাই এর মুখটা বেশ ভার। বিশেষ করে লম্বা জার্নিতে তার বেশি মন খারাপ থাকে। তাকে নাকি প্লেনের মধ্যে বেশি নাড়াচাড়া না করতে রাস্ট্রিয়ভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
আপনারা যাই বলুন, ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি। প্লেনে কি শুধু রোগা আলপটকারাই উঠে? উনি একটু বেশি স্বাস্থ্যবান বলে কি পাপ করে ফেলেছেন।
এই এয়ারপোর্ট সেই এয়ারপোর্ট ঘুরে শেষ অবধি নিউইয়র্কে পৌছানো হলো। আমি যাদের সফর সঙ্গি হয়ে এতটা পথ পাড়ি দিলাম তাদের লটবহর দেখে আমি নিজেই টাস্কিত ! এজন্য তো বলি প্লেনে যাত্রির সংখ্যা এত অল্প কেন?
লম্বা সুস্বাস্থের অধিকারি শ্বেতাঙ্গ (কয়েক জন কৃষ্ণাঙ্গও অবশ্য ছিল) ইমিগ্রশন অফিসার একজন একজন ধরে ধরে পাসপোর্ট দেখছে। পরে নাকি আবার কি নিরাপত্তা চেক করবে !
একে তো বিদেশ, তায় ভিন জাতি তাও পুরুষ যখন নিরাপত্তা তল্লাশি শুরু করলো মনে হলো, কোন পাগলে পাইছিলো আইছিলাম নিউইয়র্ক। ছি ছি ছি ! এভাবে উদাম করে চেক করে মানুষ?
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই দেখি ডাইরেক্ট পল্টনের ময়দানে উপস্থিত। একপাশে সরকারের তোষামদি করে, আরেকদিকে ১৪ গুস্টি উদ্ধার করে গগণ বিদারি শ্লোগান চলছে। গায়ে চিমটি দিলাম, স্বপ্ন দেখছি না তো? না দিব্যি ব্যাথা পেলাম। আরে ভুলেই তো গিয়েছিলাম যে মধ্যপ্রাচ্যের পর নিউইয়র্কেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশিদের বসবাস। ঢেকির পার তাহলে এত দুরেও চলছে?
হোটেলে পৌছেই লাগলো, নাহ আমেরিকাতেই এসেছি। কি বিশাল আর আলিশান। আমি কেন, আমার ১৪ পুরুষ বিক্রি করলেও এখানে ১ মিনিট থাকার পয়সা জোগাড় হবে না। আর কি ভদ্র নম্র ব্যাবহার। শ্বেতাঙ্গ ভীতি চলে গেলো।
কারোই রুমের সমস্যা হয়নি, কিন্ত মিজারুল ভাইকে নিয়েই সমস্যা। তার রুমের খাটটি নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল। পরে সুমো রেসলারদের জন্য বানানো বিশেষ খাট আনিয়ে ব্যাবস্থা করা হলো।
আমি রুমে যেতে যেতেই গাউন পড়া উর্বশি মেনকাদের দেখে বলতে ইচ্ছা হয়েছিল "একা নাকি?" একে তো বিদেশি, তায় বিদেশ বিভুই। কখন কি থেকে কি হয়ে যায়। আই এম এফ এর সাবেক প্রেসিডেন্টকে এদেরই এক স্বজাতি, বিনা পানিতে গিলে ফেলেছিলো, আমি তো কোন ছাড় !
ওহ বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম, এযাত্রায় আমার আসা সম্ভব হতো না। বুবুর ধারণা, আমি তার সাথে গেলে যাত্রা নাস্তি ! কিন্ত ভাগ্নির এক কথা ! মামাকে নিয়েই যাবে সে। আমার প্রতি এত মায়া মহাব্বতের কারণ কি মাথায়ই ধরলো না।
সে যাই হোক। সরকারি খরচে চর্ব চোষ্য পেয় ছাড়বো কেন? আমি তো আর নাটক নভেলের আদর্শবাদি নায়ক নই। আমি বাচ্চু, সামান্য বেতনে কাজ করা এক হাভাতে সাংবাদিক।
নিউইয়র্কে তখন সকাল প্রায় ১০ টা। কিন্ত ওকি ! ঘুমে যেন চোখ জড়িয়ে আসছে। কি জানি ! প্লেনের মধ্যে ভুল করে কি কি মদ টদ খেয়ে ফেলেছিলাম নাকি আবার ! নইলে এই সাত সকালে ঘুম আসবে কেন?
এর মধ্যে ভাগ্নি আমাকে খুজে পেতে নাস্তা খাওয়াতে নিয়ে গেলো।
আহা কি বিশাল আয়োজন। কতগুলির নামও তো জানি না। আমাদের এক গাদা শ্বেতাঙ্গের মধ্যে বসিয়ে নিজে উধাও। বিদেশি নাস্তা, কোনটাই তো চিনি না।
কি খাবো কি খাবো ভাবতে ভাবতে স্যান্ডউইচের মত দেখতে একটা কাগজে মোড়ানো প্যাকেট খুলে খেতে লাগলাম। ভালোই তো ! খানিক নোনতা নোনতা, খারাপ লাগছে না। খালি রুটির ভেতর গোলাপি কালারের কি যেন ! সবজি টব্জি হবে হয়তো। প্রায় শেষ করে এনেছি, এর মধ্যে এ কে আজাদ সাহেব এসে হাজির।
"কি ব্যাপার বাচ্চু মিয়া, কি খাওয়া হচ্ছে?"
"কি আর খাবো আজাদ ভাই, কিছুই তো চিনি না। তাই স্যান্ডউইচটাই ...
আজাদ সাহেব বিদেশ ঘোরা মানুষ ! গলা খাকারি দিয়ে শুধু বললেন, একটু দেখে শুনে খাবে না?
- দেখে শুনে খাবো? কেন?
- মানে এর মধ্যে তো শুয়োরের মাংস দেয়া।
অ্যা ! ছি ছি ছি ! বিদেশ বিভুইয়ে এসে দেখি শুয়োর খেয়ে মরলাম দেখি !
উগরে দেবার আগেই আমাকে টেনে সিধা বাথরুমে নিয়ে গেলেন উনি । নইলে কি যে কেলেংকারি ঘটতো !
সেই নিষিদ্ধ বস্তুর অর্ধেক ভক্ষণের রেশে ঘুম তখন পালাই পালাই অবস্থা ! ওদিকে পেটে রাজ্যের ক্ষুধা ! কাকে বলবো? বুবু তো অদৃশ্য, ভাগ্নি দৃশ্যপট থেকে উধাও, আর বাকিরা যার যার ধান্ধায়।
লজ্জার মাথা খেয়ে সামনে পাওয়া হাসান মাহমুদকেই ধরলাম।
- বুঝলে বাচ্চু, তোমাকে না আরো প্রগ্রেসিভ হতে হবে। এই বিশ্বায়নের যুগে খাওয়া দাওয়ায় কুসংস্কার থাকলে চলবে? আচ্ছা রুমে যাও, আমি বলে দিচ্ছি, রুমেই খাওয়া দিয়ে যাবে।
রুমে যেয়ে খাবার অপেক্ষা করছিলাম। পাশের রুম থেকে দেখি বাংলা কথা বার্তার আওয়াজ। কান পাতার খারাপ অভ্যেস আছে আমার।
- আমার লগে ইতরামি করেন? আমি কি রাস্তার কুত্তা আইছি? আমি ডক্টরেট ডিগ্রি হোল্ডার। জেনুইন ডিগ্রি, আপনের মত ট্যাকা দিয়া কিনি নাই।
- আরে মশিউর সাহেব, এত রাগ হবার কি আছে? আগে তো পদ্মাসেতুর টাকাটা আসুক। পদে থাকেন বা না থাকেন, আপনিও তো ভাগ পাবেন।
- আমারে মগা পাইছেন? এর আগেও তেল গ্যাসের নাম কইরা যে টাকা খাইছিলেন, সবই তো পোলা মাইয়া আর মাইয়া জামাই নিয়া গপ ছাইছিলেন। আর ওই চাপাভাঙ্গা জ্বালানি উপদেস্টা আমারে মাত্র এক কোটি টাকা দিয়া কইছিলো, এর বেশি দেওন যাইবো না। এখন আমারে ভ্যাকেশনের নামে এই খানে ভুদাই বানাইতে আনছেন?
অপর পক্ষ থেকে কি বলা হচ্ছিল তা শোনার আগেই আমার রুমে নক। দূর ! শান্তি নাই দেখি। রুম সার্ভিস । দরজা খুলেই দেখি আরেক স্বর্গের অপ্সরি আমার খেদমতে হাজির। মানে আমার নাস্তা উপস্থিত।
এর নাম নাস্তা? এত সুন্দর ট্রলিতে এত্ত দামি দামি প্লেটে হাজির কিনা ঠান্ডা দুধ, ভুট্টার খই আর কমলার রস? তার ভাগ্য ভালো দুই পিস পাউরুটি আর ডিমের অমলেট ছিল ! নইলে...
অপ্সরাকে বিদায় দিতে মন চাইছিলো না। কিন্ত কান পেতে যে কাহিনী শুনছিলাম, তার বাকি অংশ না শুনলে তো চলবে না।
কপাল খারাপ ! ততক্ষণে ওই দিকের কথা বার্তা বন্ধ। এদিকে দুধ ডীম পাউরুটি সব পেটে গিয়ে নিদ্রাদেবিকে একেবারে আমার দুচোখের উপর বসিয়ে দিয়েছে।
সন্ধ্যার দিকে চোখ খুললো। জানালার ফাক দিয়ে বাইরে চোখ ধাধানো আলো র আভাস চোখে পড়লো।
গোসল সেরে রুম থেকে বের হলাম।। দেখি কেউকে পাওয়া যায় কি না ! পড়বি তো তো পর একেবারে বাঘিনির সামনে।
চলবে...