তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও পানি আর বিদ্যুত নিয়ে এত হাহাকার দেখা যায়নি। হঠাৎ করে দেশে এমন কিছু ঘটে যায়নি, যার কারণে পানি আর বিদ্যুত নিয়ে দেশবাসি এতটা উত্তপ্ত হয়ে যাবে। শুধু একটি কারণেই এধরণের অভাব ঘটতে পারে। সেটি হলো প্রশাসনিক অদক্ষতা। অর্থাৎ দেখার কেউ নেই। যে যার খুশি যা খুশি করছে। সেটার দায়ভার এড়ানো বর্তমান সরকারের পক্ষ্যে সম্ভব নয়।
পানির প্রসঙ্গেই আজকের লেখা। তাই বিদ্যুতকে দুঃসাহসের সাথে না বলে দিচ্ছি।
মাছে ভাতে বাঙ্গালির জীবনে পানির আকালের কথা অন্তত ৫০ বছর আগেও কেউ কল্পনা করতে পারতো না। সেই দুঃস্বপ্ন আজ বাস্তব সত্যে পরিণত। এবং আগামি ৫০ বছরে কি ধরণের দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছে, সেটিও কল্পণাতিত। বিশেষ করে বিশ্ব উষ্ণায়নের ব্যাপারে আমাদের উদাসীনতা আমাদের অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশবাদিরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছেন, যে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ভারত কর্তৃক এক তরফাভাবে উজানে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার। বলা বাহুল্য এ ধরণের আচরণ আন্তর্জাতিক নীতিমালার পরিপন্থিও বটে। তাছাড়া এই কারণে প্রতি বছর চার বিলিয়ান ডলার ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। এব্যাপারে ওয়াশিংটন পোস্ট একটি গুরুত্বপুর্ণ রিপোর্ট ছেপেছিল। আগ্রহিরা পড়ে দেখতে পারেন।
Click This Link
১৯৭৫ সালে মাত্র ৪০ দিনের অনুমতি নিয়ে ভারত এই ফারাক্কা বাধ চালু করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা। কিন্ত তৎকালিন ভারত সরকারের এব্যাপারে তত্ত্ব উপাত্তগুলি যে সঠিক ছিল না, সেটা প্রমানিত হয় যখন এই ফারাক্কা বাধ খোদ পঃ বঙ্গের জন্যও মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়ায়। এব্যাপারে ২০০৬ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি তদন্তের আয়োজন করা হয়েছিল। যার সংক্ষিপ্ত রুপ পড়ুন নিচের লিংকে।
Click This Link
নিশ্চই করে আমাদের ব্যার্থতা এবং দুর্বলতার কারনেই ফারাক্কা বাঁধ আমাদের পদ্মাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। কেননা ভারত তো আমাদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে এই চুক্তি করতে বাধ্য করেনি। আমরা যদি আগপিছ চিন্তা না করে আত্মধবংসি পদক্ষেপ নেই, তাহলে ভারতকে এক তরফা দোষ দেবার যুক্তি কই?
রাজনৈতিকভাবে এই ইস্যুতে জনগনের সমর্থন থাকলেও, এব্যাপারে আলোচনায় ভারতের অনাগ্রহ, টালবাহানা, সময়ক্ষেপন, রাজনৈতিক বিভক্তি, ভারত থেকে অবৈধ সুবিধা আদায়, প্রধান প্রধান মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবিদের এব্যাপারে রহস্যময় নিস্ক্রিয়তা, এই সব কারণে আমাদের চরম সর্বনাশ হয়ে গেলেও, ফারাক্কা বিরোধী যে কোন কার্যক্রমকে আমরা ভারত বিরোধী একটি সস্তা ইস্যু বলে গণ্য করছি। অথচ খোদ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানি একবার ফারাক্কা অভিমুখে লং মার্চের ডাক দিয়েছিলেন।
ফারাক্কার প্রভাব হয়তো এতটা ক্ষতি করতে পারতো না যদি আমরা নিজেদের পানি সম্পদ রক্ষায় সচেতন হতাম। অবশ্য ফারাক্কার বিরুপতা রুখতে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান , খাল খনন কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু কিসের কি? সেখানেও দুর্নীতি বাসা বাঁধাতে সেই কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। বিশেষ করে তার মৃত্যুর পর।
পরিবেশ নিয়ে আমাদের সচেতনার অভাবেই, আমরা বন জঙ্গল কেটে বিলিন করে দিয়েছি, ভুমি দস্যু হয়ে নদী নালা খাল বিল ভরাট করে জমি আত্মসাত করেছি, কলকারখানার বর্জ্য নিস্কাসনে নদীকে ব্যাবহার করে জল কলুষিত করেছি, নদী খননে কোন উদ্যোগ নেইনি, মাছ মেরে সাফ করে দিয়েছি, কিন্ত এর বংশবিস্তারের জন্য কোন ব্যাবস্থা রাখিনি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। এখন ভুগর্ভস্থ পানি পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক অঞ্চলে আবার আর্সেনিকের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এখন পানির জন্য চারিদিকে হাহাকার, হায় হুতাশ আর পরস্পরের প্রতি দোষারোপের নিত্য খেলা।
এখন শুনি টিপাইমুখে বরাক নদীতে ভারত বাধ দেবার পায়তারা শুরু করেছে। যদি এই প্রকল্প চালু হয়, তাহলে পদ্মার মত আমাদের মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারাও একদা প্রমত্তা পদ্মার ভাগ্য বরণ করবে। অবশ্য শুনেছি, আমাদের পররাস্ট্র মন্ত্রি দিপুমনি সেই বাধকে বাংলাদেশের জন্য হানিকর নয় বলেছিলেন। তার কথা মেনে নেয়া যেতো, যদি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা তার বিপরীত কথা না বলতেন। কেননা বাপার সদস্যরা নিঃসন্দেহে পরিবেশের ব্যাপারে দিপুমনির চেয়ে ঢের সচেতন এবং শিক্ষিত।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান স্বীকার করে, আমরা যা কিছু ত্যাগ করেছি, তাতে নতুন করে ঋণ শোধের প্রশ্নই আসে না। এক ফারাক্কার জন্যই বাৎসরিক ৪ বিলিয়ান ডলার হিসেবে গত ৩৩ বছরে যত অর্থ আমরা হারিয়েছি, তার সিকি ভাগের একভাগও বন্ধুত্বের জন্য অন্য কোন দেশ স্বীকার করতো বলে মনে হয় না।
অতিতের ভুল পুনরাবৃত্তি রোধে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ভারতকে বন্ধুত্বের পরাকাষ্ঠা দেখাতে, আরেকটি ফারাক্কা চালুর অনুমতি দিয়ে কোনমতেই নিজ অস্তিত্বকে ধবংসের মুখে ঠেলে দেয়া উচিত হবে না। অতিতের অভিজ্ঞতায়, ভারতের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা নামের শঠতায় আর আস্থা রাখা সম্ভব নয়। এখনই জাতিসংঘের সাহায্য নেবার জরুরি প্রয়োজন রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ি এব্যাপারে আমাদের জয়ের সম্ভাবনা অনেক অনেক বেশি। কিন্তু দিপুমনি আর পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রির দাসসুলভ মনভাবের কারণে সে উদ্যোগ বাস্তবে রুপ নেবে কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন। তবে যদি একবার ভারত বরাক বাধ চালু করে দেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কিছু করার মত শক্তি আমাদের নেই, একথাটা সংক্লিস্ট সবাইকেই মাথায় রাখতে হবে।