somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধু মক্ষিকার সাথে মিতালী! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-২৯ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)

১২ ই আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মধু মক্ষিকা তথা মৌমাছির সাথে মিতালী করা আমার দীর্ঘ দিনের বিরল অভিজ্ঞতার অন্যতম একটি দিক। আমার সাথে মৌমাছি চলা ফেরা করত, বসলে আমাকে ঘিরে ধরত, এমনকি হাটে বাজারে গেলেও তারা আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করে নিত। বাজারের মুদির দোকানে খোলা-মেলা চিনির বস্তায় যখন মৌমাছি হামলে পড়ত, তখন মুদি দোকানদার আমার কাছে অভিযোগ করত, তোমার মৌমাছির জ্বালায় দোকানের মিষ্টি দ্রব্যের মুখ খোলা দায়, এসব নিয়ন্ত্রণ করো! মিষ্টির দোকানদার তো রীতিমত ক্ষেপাই থাকত। বাজারের অলস দোকানদারের রসের গোল্লার হাড়িতে দৈনিক বিশ-পঞ্চাশ টা মৌমাছির লাশ তো নির্ঘাত থাকতই! এতে শুচিবায়ু ক্রেতারা আর সে মিষ্টি কিনতেন না। দোকানদার খুবই ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বলতেন, তোমার বাবা তোমাকে শিখানোর জন্য বুঝি আর কোন বিদ্যা পেল না! বলতাম! চাচা, আপনি যদি সর্বদা মিষ্টির আলমারিটা বন্ধ রাখেন, তাহলে তো মৌমাছি বাপের পক্ষেও মিষ্টির হাড়িতে পড়ার কথা না। মুরুব্বী বলে এসব কটু কথা চোখ বুঝে সইতাম! নইলে অবশ্যই বলতে পারতাম! আধা মাইল দূরে অবস্থিত আমার বাড়ী থেকে আপনার দোকানে মৌমাছি হানা দিয়েছে! এই কথা আপনাকে কে বলেছে? ভিতরে ভিতরে এই আলসে প্রকৃতির মানুষটির উপর আমিও ত্যক্ত হয়ে থাকতাম! তিনি যখন আমাকে তার রসের গোল্লা ব্যবসার করুন দশা দেখাত, তখন আমার কাছে এতগুলো অসহায় মৌমাছির করুন মৃত্যুতে ভেসে থাকা লাশ দেখে ধৈর্য ধরা কঠিন হত।

তখনও দেশে মৌমাছি পালন কিংবা মৌ-চাষ সম্পর্কে তেমন কোন ধারনা ছিলনা। বাবা আমাকে বলতেন, যদি কোথাও মৌমাছি পালনের উপর বাস্তব দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ পাই, তাহলে যেন কাজটা করে ফেলি। আমাদের বিরাট পেয়ারা বাগানের ফলন কমে যাবার অন্যতম কারণ ছিল মৌমাছির স্বল্পতা। মৌমাছি সরিষা ফুল পছন্দ করে, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে, মৌমাছি মধু খেতে গেলে বিষও গিলে আসে, ফলে প্রচুর মৌমাছি মারা যায়। আর এতে বিপত্তি ঘটে ফসলের। বাবা কোথাও মৌমাছি পালনের উপর একটি ইংরেজি বই সংগ্রহ করে আনেন, তিনি বইটি আগাগোড়া পড়েছেন এবং আমাকে শুনিয়েছেন। বইয়ের এই পড়া দিয়ে মৌমাছিকে বাস্তব ভিত্ততে পোষ মানিয়ে পালন করার বাসনা পূর্ণ হল না। তবে মৌমাছির জীবন, খাসিয়ত, চাহিদা, পছন্দ, অপছন্দ সহ যাবতীয় তথ্যাদি আমি ভাল ভাবে রপ্ত করতে পারলাম।

সিলেট থেকে আসার পর, বাবাকে ধরলাম গরুর ফার্ম করব। কিন্তু তিনি ফার্ম করার প্রতি উৎসাহী হলেন না। এমন কি খুবই নিরুৎসাহ ভাব নিয়ে আমার কথা শুনে থাকেন। আমাকে বুঝালেন তিনি চিন্তা করেছেন অন্য কিছু, তাঁর পরিকল্পনা আবারো আমার লেখাপড়া অব্যাহত করাবেন। তবে সেক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন গত কিছু ঝামেলা আছে, কেননা আমি পরীক্ষা না দিতে পেরে বোর্ডের রেকর্ডে অনিয়মিত হয়ে পড়েছি।

তিনি আমাকে জানালেন, চট্টগ্রামে অবস্থানরত একজন সৌখিন পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা মৌমাছি পালন সম্পর্কে জানেন। তিনি বিদেশ থেকে এটা শিখে এসেছেন। তাঁর ঠিকানা আমি সংগ্রহ করেছি। তুমি বরং তাঁর সাথে দেখা করে মৌমাছি পালন করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে আসতে পার। সেই কর্মকর্তার সাথে কিভাবে কথা বলবে, কি জানতে হবে সেটা তোমাকেই ঠিক করতে হবে। বাবা বললেন, তোমার জন্য গবাদি পশুর ফার্মের চেয়ে মৌমাছির ফার্ম অনেক উত্তম ও আনন্দদায়ক হবে। এতে আমার বাগানের উপকার হবে এবং এটি করতে গেলে তোমার লেখাপড়ায় কোন ব্যাঘাতও ঘটবে না।

শহরে তিন বার যেতে হল এবং শেষ বারে সেই কর্মকর্তাকে ধরতে সক্ষম হলাম। তিনি আমাকে রাস্তার উপদ্রব মনে করে এড়িয়ে যেতে চাইলেন। বাড়ীর গেট দিয়ে ঢুকার আগেই দু-একটি কথা বলে তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলাম। তিনি এক বাক্যে প্রশ্ন করলেন, কি জানতে চাই? তাঁকে আমার বইটি দেখিয়ে বললাম, এই ইংরেজি বইটি আমি আমার বাবার সাথে পড়েছি। শুধুমাত্র দুটি প্রশ্ন জানতে চাই; প্রথম প্রশ্ন হল, মৌমাছির বাসা কোথায় পাওয়া যাবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, মৌমাছির বিশাল একটি ঝাঁক থেকে, রানী সহ এতগুলো মৌমাছি কিভাবে বাক্সে ঢুকাব?

তিনি আমার হাতের মোটা আকৃতির ইংরেজির বই দেখে ইতস্তত করলেন, কি যেন ভাবলেন! হয়ত ভাবছেন, আমি কোন অখ্যাত পরিবার থেকে আসি নি যাকে হেলা করা যাবে অথবা ভাবছেন, তিনিও ও তো এই আকর্ষণীয় বইটি পড়েন নি কিংবা আমার ধারনার দুটোই হতে পারে!

যাক, ভদ্রলোক আমাকে বললেন, এটি আমার পেশা নয় বরং সখের বশে শিখেছি। ছুটিতে গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলাম, সেখানে একটি মৌমাছির দলকে ধরে আবদ্ধ করেছিলাম, সকল সরঞ্জাম না থাকাতে ধরে রাখতে পারিনি। দু’দিন আগেই পুরো দলটি পালিয়ে যায়। যদি আরেকটি মৌমাছির দলের খবর পাই, তাহলে তুমি সাথে থাকতে পারবে। কাজটা আমি কিভাবে করেছিলাম, সেটা আমার বাসার কাজের ছেলে মোতালেব দেখেছিল, এবার তাকেই দায়িত্ব দিয়েছি নতুন দল ধরার জন্য। তুমি তার সাথে যোগাযোগ রাখলে তোমার লক্ষ্য পূরণ হতে পারে। এটা বলেই তিনি মোতালেব! মোতালেব! বলে মুহূর্তেই ভিতরে ঢুকে গেলেন। হন্তদন্ত মোতালেব দৌড়ে এসে আমাকে উপস্থিত দেখলেন এবং সাহেবের সাথে কোন ভজগট করেছি ভেবে আমাকে শাসাতে লাগলেন! বললাম, তুমি সাহেবকে প্রশ্ন করে আস, কেন তিনি তোমায় ঢেকেছেন?

মোতালেবের আশঙ্কা-মুক্ত চেহারা দেখে, ঘটনা বুঝিয়ে বললাম! কাজের ছেলে মোতালেব বুঝে নিল, যদিও সাহেব তাকে, মৌমাছির বাসা বানানোর একটি দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তবে এই মুহূর্তে সেটা আমারই বেশী দরকার। তার হাবভাব দেখে, তাকে বখশিশের লোভ লাগলাম, সে রাজি হয়ে গেল। সাহেবও খুশী হবে আমারও বখশিশ মিলবে! এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ নিয়ে আমাকে জানাল সাহেবের পোকা বাড়ী ছেড়ে কোথাও যায় নাই! ভবনের ছাদের একটি কোনা দেখিয়ে বলল, দেখেন! ঐ যে ঘরের কার্নিশ সেখানেই দল পাকিয়ে স্তূপাকারে সব পোকারা লটকে আছে! স্যারে জানলে আমারে বিরক্ত করবে, আবার ম্যাডামেও ওসব পছন্দ না, তাই কাউরে বলি নাই। আপনি বখশিশ দিবেন বলেছেন, তাই ব্যাপারটা খুলে বললাম।

তার পরদিন সকালে মহাসমারোহে মতলবের বিদ্যা দেখলাম। আমি নিশ্চিত হলাম যদি এই কারিগরি নিজের চোখে হাতে-কলমে না দেখতাম, তাহলে শত বই পড়েও মৌমাছি ধরতে পারতাম না। মৌমাছির বাসাটি একটি বিশেষায়িত পদ্ধতিতে বানানো। বাসার ঢাকনা উল্টিয়ে যখন মৌমাছি ঢুকাতে গেছে, তখন আমি যথেষ্ট দেরী করে ফেলেছি, বাসাটি আগেই আমাকে তন্ন তন্ন করে দেখা উচিত ছিল! তবে মোতালেবের সকল কাজ দেখার পরে, আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেল! এতটুকু দেখাতেই আমি কাজটি করতে পারব বলে সাহস পেলাম। মোতালেবকে বললাম, মৌমাছির এই বাসা কোথায় পাওয়া যাবে? কিংবা এই বাসাটি কে বিক্রয় করে? মোতালেব বলল: এই বাসা কোথাও পাইবেন না! স্যার ছয় মাস লেগে থেকে বিসিকের এক অফিসার থেকে এটা যোগাড় করছে। নতুন তথ্য পেলাম! বিসিকে গেলে হয়ত আরো নতুন কিছু যোগ হবে।

বিসিক ভবনের স্থান আগে থেকেই জানতাম। সেখানে গেলাম এবং তল্লাশির মাধ্যমে মৌ কর্মকর্তাকে উদ্ধার করলাম। তিনি আমাকে পেয়ে খুবই উৎফুল্ল হলেন! তাঁর ভাবখানা এমন, তিনিই যেন এতদিন আমাকে খুঁজছিলেন। তিনি সাধ্যমত আপ্যায়ন করালেন। আমার বিস্তারিত শুনে তিনি খুবই আশাবাদী হলেন এবং আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ উদ্দীপনা দিলেন। এটি একটি আকর্ষণীয় পেশা হিসেবেও মন্তব্য করলেন। তখনও এ সম্পর্কিত কোন বাংলা বই বাজারে বের হয়নি এমনকি প্রশিক্ষণও যথারীতি চালু হয়নি বলে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করলেন।

বিসিক কর্মকর্তা আমার কৌতূহল দেখে মৌমাছি সংক্রান্ত যাবতীয় সরঞ্জাম আমার সম্মুখে হাজির করলেন! বললেন, এসব সরঞ্জামের দুটো সেট চীন থেকে আনা হয়েছে। তবে বর্তমানে তার কাছে মাত্র একটি সেট আছে। এসব জিনিষগুলো বাংলাদেশে বানাতে কত খরচ আসবে, তার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন ওয়ার্কশপে পাঠানে হবে। আগামী তিন মাস পরে আসলে, তিনি আমাকে অর্থের বিনিময়ে একটি সেট বানিয়ে দিতে চেষ্টা করবেন।

তখন তো আর ডিজিটাল যুগ নয় যে, ক্লিক করে একটি ফটো তুলে আনি। ড্রয়িং সম্পর্কে ধারনা ছিলা না যে, এঁকে রাখি। তাই কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে, বাক্সটি খুলে ভাল করে দেখলাম। পুরো ডিজাইনটা মুখস্থ করলাম। বুঝি মত করে লিখে আনলাম। যাতে গ্রামের কাঠের মিস্ত্রিদের বুঝিয়ে একটি বাসা বানিয়ে ফেলতে পারি। কাপড়ের টুকরা দিয়ে বাকি সরঞ্জাম গুলো অস্থায়ী ভাবে বানাতে পারব কিন্তু বাসাটি বানানোই হল এই মুহূর্তে সবচেয়ে জটিল কর্ম।

খুব উৎসাহে বাড়ীতে এসে, কাঠমিস্ত্রির শরণাপন্ন হলাম। গ্রামীণ জনপদে মেধাহীন জনগোষ্ঠীর মাঝে, কিঞ্চিত অশিক্ষিত মেধাবীরাই কাঠ মিস্ত্রী হয়। এই ধরনের চারজন মেধাবী কাঠমিস্ত্রিকে মৌমাছির বাসা বানানোর পদ্ধতি বুঝাতে ব্যর্থ হই। মুখে বলি, এঁকে বলি, দেখিয়ে বলি তারা কোনমতেই বুঝেই না! উল্টো আমাকে প্রশ্ন করে বলে, ‘মৌমাছির কি থাকার জায়গার অভাব হয়েছে যে, আমাকে তাদের জন্য বাসা বানিয়ে দিতে হবে’!

ফল হয়েছে এমন, কাঠমিস্ত্রি আমাকে দেখলে অন্য পথে ঘুরে যায়। আমাকে তারা এক সাক্ষাৎ উপদ্রব ভাবতে লাগল। গায়ে পড়ে বাজারে চা-নাস্তা খাওয়ার কথা বললেও তারা খাবে না। আমি যখন বৈদ্য ছিলাম, তখন এসব কাঠমিস্ত্রির একজন আমার নিকট থেকে তাবিজ নিয়ে, তখনও টাকা দেয়নি! অবশেষে তারই শরণাপন্ন হলাম, তিনি দূর থেকে আমাকে দেখে বললেন, তুমি নাকি, কি ধরনের এক বাক্স বানাতে চাইতেছ? আমি কিন্তু সেই বাক্স বানাতে পারবনা, প্রয়োজনে তোমার তাবিজ তোমাকে ফেরত দিতে পারি!

সমস্যার কথা বাবাকে বললাম! তিনি বললেন, এটারও একটা সমাধান আছে! আমি খুশীতে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম, কি সেই সমাধান? তিনি ভিতরে ভিতরে হাসি লুকিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন, তাহলে নিজেই কাঠ মিস্ত্রির কাজটা শিখে ফেল! পেরেশান মনে বললাম; এটা কি একটা সমাধান হল? তিনি বললেন, শুনতে জটিল মনে হলেও, সৃষ্টিশীল মানুষদের জন্য এটাই উত্তম সমাধান! সবাই জানে, ‘টমাস আলভা এডিসন একজন নামকরা বিজ্ঞানী ছিলেন কিন্তু তিনি কমবেশি সকল কাজ ধরনের জানতেন, এই কথা তো সবাই জানেনা’। খুশী হলাম এবং ভরসা পেলাম।

বাবা আমাকে খন্ডকালীন একটি কাঠের মিস্ত্রির সাথে সহযোগী হিসেবে কাজ করতে লাগিয়ে দিলেন! আমার একান্ত আগ্রহ ও গভীর মনোনিবেশের কারণে, অল্পদিনেই করাত দিয়ে কাটা, বাটাল দিয়ে খোদাই, রাঁদা চালানো ও বাইশের ব্যবহার সহ কমবেশি যাবতীয় অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকলাম।

এলাকার মানুষ কাঠ মিস্ত্রির দোকানে কাজ করতে দেখে ‘ভ্রু’ কুচাতে লাগল! কেউ অবাক হল, কেউ হতবাক হল, কেউবা মন্তব্য করেই ছাড়ল, ‘পয়সা কামানোর জন্য অবশেষে তোমার বাবা, তোমাকে কাঠ মিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দিল’! হাজারো মন্তব্য! কোন মন্তব্যে তো মেজাজ বিগড়ে যাবার দশা। যে সমস্ত মিস্ত্রী এতদিন আমাকে বাসা বানিয়ে দিতে পারল না, তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! তাদের দুই জন্য ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে এসে, চর্ম চোখে আমাকে কাজে ব্যস্ত দেখে মন্তব্য করল, যাক বাবা, এবার তুমি নিজেই তোমার মৌ-বাসা বানাতে পারবে!

কৃষদের চাষের উপযোগী নাঙল-জোয়াল-মই বানায় বৃদ্ধ রমণী কান্ত। আমার ছোট কাল থেকেই দেখে এসেছি, একজন রমণী কান্তই এই অঞ্চলের কৃষকদের নাঙল-জোয়াল-মই বানিয়ে দেন। কৃষকদের একমাত্র ভরসার স্থল, বৃদ্ধ রমণীর মৃত্যুর পর কে এই কাজ করবে, এ নিয়ে কৃষকদের দুঃচিন্তার অন্ত নেই! একদিন তিনিই আমাকে ডেকে বললেন, তোমার বাবাকে আমার সাথে দেখা করতে বলো।

আমি পিড়াপীড়ি করাতে তিনি যা বললেন, তা শুনে তো আমার আক্কেল গুড়ুম! তিনি বললেন, জানিনা তোমার বাবা কেন তোমাকে মিস্ত্রি বানাতে চায়! যদি তিনি আমার দুটো কথা শুনে, তাহলে তোমার বড় উপকার হবে। অতঃপর তিনি আমাকে জানালেন, আমি যে কাজ শিখায় মনোনিবেশ করেছি, মানুষ এসব কাজকে ঘৃণা করে কিন্তু এসব মানুষ বেকার থেকে কারো কাছে হাত পাতাকে লজ্জা মনে করেনা! তারা স্বাবলম্বী হতেও চায়না আবার যে স্বাবলম্বী হতে চায় তাকে ঘৃণা করে উপরন্তু তার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টে করে।

আরো বললেন, দেখো আমার কোন ছেলে নাই, আমি চারটি মেয়েকে অনেক টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছি। প্রত্যেক মেয়েকে সাত ভরি করে স্বর্ণ দিয়েছি। তারপরও আমার অনেক টাকা ব্যাংকে জমা আছে। এসব অর্থ এই নাঙল বানিয়ে কামিয়েছি। আমার এই কাজে অনেক আয় হয়, তবে এই কাজটি শিখার জন্য আগ্রহী কাউকে পাইনি। আমি আশা করতাম কেউ গায়ে পড়ে আমার কাছে বিদ্যাটি শিখতে আসুক! কারো আগ্রহ দেখলে আমার আনন্দ লাগত। তাই আমি মনে মনে ঠিক করেছি, তুমি যদি এই কাজটি শিখ তাহলে তোমার ভবিষ্যতের জন্য উপকার হবে!

আমি বিনয়ের সহিত আমার অপারগতা প্রকাশ করলাম এবং কাঠের কাজটি কেন শিখছি তাও বিস্তারিত তুলে ধরলাম। তিনি আমার কথায় খুবই হতাশ হলেন এবং আমার ভিন্ন ধরনের একটি চিন্তার জন্য উৎসাহ দিলেন।

একদা এথেন্স থেকে বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গ্রামের বাজারে, সুতার মিস্ত্রী রমণী কান্তের দোকানের সামনে কয়েকজন বিদেশীকে নিয়ে স্থানীয় মানুষের এক জটলা দেখলাম! বিদেশীরা কিছু বলছেন কিন্তু উপস্থিত কেউ তা বুঝছে না। আমি এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম। সুইজারল্যান্ডর পর্যটক ‘পিটার’ চা বাগান পরিদর্শনে যাবার এই পথে সুতার মিস্ত্রির নাঙল বানানোর বিরল দৃশ্য চোখে পড়ে! তিনি সুতার মিস্ত্রির কর্মরত অবস্থায়, খালি গায়ের একটি ছবি তুলতে গিয়েই যত বিপত্তির শুরু। মিস্ত্রী বলেন, নাঙল বানাই বলে কি আমি গরীব নাকি? যে উদোম শরীরে ফটো তুলতে হবে! পিটার বুঝাচ্ছেন, শার্ট গায়ে দিলে ছবির মূল গুরুত্বই হারিয়ে যাবে! মিস্ত্রীকে বললাম, তিনি আপনার দুটো ফটো নিবে, একটি শাট ওয়ালা আরেকটি শার্ট ছাড়া। পিটার কে ব্যাখা করলাম তুমি, দুই অবস্থার দুটো ফটো নাও, যেটা তোমার দরকার সেটা কাজে লাগাও। সে ঘটনা বুঝতে পেরে হাসল। আমিও মিস্ত্রীকে বললাম, একদা আমাকে বলেছিলেন আপনার কাজের কোন সম্মান নাই, আজ দেখলেন তো! বিদেশীরাও আপনার কাজকে মূল্যায়ন করে ফটো নিয়ে গেছে। তিনি দুই গাল মেলে পরিতৃপ্তির হাসি ছাড়লেন।

মৌমাছির বাসা বানাতে গিয়ে আমি আমি কার্পেন্ট্রি শিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। বাবা বলেছিলেন, শুধু মৌমাছির বানানোর লক্ষ্যে যাতে, কাজটিকে আয়ত্ত না করি। একটি কাজ জানার মনোবৃত্তি নিয়েই যেন কাজ শিখি। যার ফলে এই কাজ শিখাটা আমার বিফলে যায়নি। কিছু যন্ত্রপাতি কিনে নিয়েছিলাম এবং আমার অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে, আমার সময় বয়সী গৃহ ভৃত্যকে সাথে নিয়ে আমাদের খামারে একটি নতুন বাড়ী বানিয়ে ফেলেছিলাম। ব্যক্তিগত প্রাত্যহিক জীবনে এই কাজটি আমাকে অনেক সহায়তা করে।

মৌমাছির বাসা বানানো হলে পর সেসব কাঠ মিস্ত্রী দেখতে এসেছিল! বাসা দেখে অট্টহাসি দিয়ে হেঁসে বলল, ও,… এই সেই বাসা! এ ধরনের বাসা বানানো তো মামুলী ব্যাপার। তুমি ব্যাটা ব্যাপারটা আমাদের ভাল করে বুঝাতে পার নাই। এসব অকর্মা মানুষ শুধু তর্কেই জিততে চায়। শহরে এক কর্মকর্তার অর্ডারে কিছু বাসা বানিয়ে শহরে পাঠিয়েছিলাম। তার পর দিন থেকে দেখি কাঠের দোকানে নতুন কথা ঝুলে আছে, ‘আমাদের এখানে মৌমাছির বাসা বানানো হয়’!

চলবে..................
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৩
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×