তখন কার দিনে, বর্তমান সময়ের মত ব্যাংকের ভল্টে সোনা-রূপা সহ নানাবিধ সম্পদ রাখার সুবিধা না থাকার কারণে, অতি চালাক মানুষেরা এসব সোনা-রূপা, তামার মজবুত হাড়ির ভিতরে রেখে তা মাটির নিচে লুকিয়ে রাখত। মাটির নীচে লুকানো এসব সম্পদের কথা তিনি ব্যতীত কেউ জানতেন না। হঠাৎ করে কখনও যদি এ ব্যক্তিটি মারা যেত, তাহলে তার সন্তানেরা এ সব সম্পদের কথা জানতে পারত না। বছরের পর বছর ধরে সে সব সম্পদ মাটির নীচে থেকে যেত। লুকিয়ে রাখা সম্পদের জায়গা অন্য কারো কাছে বিক্রি হবার পর, তিনি যদি বাড়ি বানাতে কিংবা পুকুর খনন করতে যেত, তখন এসব লুকানো সম্পদ বের হয়ে আসত! মূলত এ ধরনের সম্পদ কোনদিন চাষাবাদের জমিতে লুকানো হত না। এসব সম্পদ পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘর, ভিটের জায়গা, বাড়ীর পাশের বাগান, উঁচু স্থান কিংবা বৃষ্টির পানি থামে না এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখা হত। ফলে দেখা যায়, গুপ্ত ধন সর্বদা পুরানো বাড়ীর আশে পাশের পতিত জমি থেকেই বের হয়ে আসে।
অলি মিয়া মুন্সীর চার স্ত্রীর ঘরে চার ছেলে। সকল স্ত্রী পুত্রদের বাড়ীও আলাদা। এক বউয়ের সাথে অন্য বউদের দেখা সাক্ষাতের সুযোগ ছিল না। তাই ঝগড়া ঝাটিও হতনা আবার এক জনের মনের খবর অন্য জনের জানার ও সুযোগ ছিলনা। মুন্সীর এক পুত্র অতি চালাক, একজন শিক্ষিত, একজন কৃপণ, আরেক জন বুদ্ধিমান! কারো যোগ্যতার সাথে কারো মিল নাই, থাকার কথাও নয়। মুন্সী তার সমুদয় সম্পদ মাটির নিচে লুকিয়েছেন। এটা তিনি স্বীকার করতেন এবং স্ত্রীদের বলতেন। কোন বাড়ীর কোন ভিটায় এ সম্পদ লুকায়িত তা মুন্সী কাউকে বলেন নাই। তবে মুন্সী একটি কাজ করেছেন! তিনি কাগজে অঙ্কন করে কিছুটা দূরহ ভাষায়, সম্পদের গোপন স্থান কোথায় তার একটা অস্পষ্ট ব্যাখা রেখে গেছেন! মুন্সীর ইচ্ছা সব ছেলে যেহেতু সমান যোগ্যতার নয়, তাই কাগজের এই কথা উদ্ধার করতে, বাকী ছেলেরা বুদ্ধিমান সন্তানটির শরণাপন্ন হবে। এতে সবাই সম্পদের হিস্যা পাবে। বৃদ্ধের মৃত্যুর পরে, ছেলেদের মাঝে অদ্ভুত সন্দেহ সৃষ্টি হল! এক ছেলে সন্দেহ করত, সম্ভবত পিতা অন্য সৎ মায়ের ভিটায় সম্পদ গোপন করেছেন। সেই মায়ের ছেলে আরেক সৎ মায়ের ভিটের প্রতি সন্দেহ করত! এতে করে সম্পদের আশায়, রাতের আধারে চুরি করে একজনের ভিটা অন্যজন খনন করত! কদাচিৎ ভয়ানক মারামারি লেগে যেত। মারামারি করার জন্য তারা শক্তিশালী মানুষ পুষতেন। নজির আহমেদ ওরপে নজু শাহ ছিল তাদেরই একজনের ঘরের পোষ্য চাকর! নূর জাহান নামের সেই মহিলা ছিল, অন্য ভাইয়ের ঘরের চাকরানী। এই ধরনের পরিবেশে কারো সাথে কোনদিন প্রেম হবার নয়! তাদের বাড়ীতে চাকর-চাকরানী যাই হোক, মারামারি করার দক্ষতাকে এই বাড়ীতে মূল্যায়ন করা হত।
মুন্সীর চালাক ছেলেটি, আমার সাথে গোপনে যোগাযোগ করে একটি লোভনীয় ও আকর্ষণীয় প্রলোভন দেয়! তিনি বলেন, তাদের বাবার রেখে যাওয়া গুরুত্ব পূর্ণ দলীলের কিছু তার কাছে রয়েছে। সম্ভবত সেখানে সোনার হাড়ির তথ্য দেওয়া থাকতে পারে। তিনি বহু বছর এসব পড়ে দেখেছেন, তবে মাথা মুণ্ডু কিছুই উদ্ধার করতে পারে নাই। আমি যদি দেখতে আগ্রহী হই, তথ্য গোপন রাখার শর্তে, তিনি তার কিছু অংশ আমাকে দেখাবেন। আমার দৈব জ্ঞান কিংবা জ্বিনের জ্ঞান কিংবা তন্ত্রের জ্ঞান ব্যবহার করে আমার সমুদয় প্রজ্ঞার সাহায্যে যদি এসব সম্পদ উদ্ধার করে দিতে পারি তাহলে উদ্ধার কৃত সম্পদের এক পঞ্চমাংশ তিনি আমাকে দিবেন! এসব কাগজ দেখার জন্য, কাউকে কিছু না জানিয়ে, আমাকে কষ্ট করে তাদের বাড়ীতে যেতে হবে! দারুন যুক্তি বটে! এ বয়সে এই ধরনরে একটি প্রলোভন পেয়ে দিশাহারা হয়ে গেলাম। চিন্তায় কেমন জানি এডভেঞ্চার ভাব আসতে লাগল! ভাবলাম, দূর ছাই, জ্বিনের সাহায্যের কি দরকার! আমার যা বুদ্ধিমত্তা! সেই কাগজ দেখলেই তো বের করে ফেলতে করতে পারব। শুধু দেখার বাকী মাত্র। কারো সাথে পরামর্শ করা যায়, ব্যাপার খানা এমন নয়। তাই বলে দিলাম আগে কাগজ গুলো দেখান তারপর দেখা যাক কি করতে পারি।
এই বাড়ীতে কাগজ দেখতে গিয়েই তো নজির আহমদকে ঝাড়ু পিটার দৃশ্যে পেয়েছিলাম, যা আগের পর্বে উল্লেখ করেছি! চিন্তা করলাম আগে মুন্সী বাড়ীর, চালাক ছেলের বাড়ী ঘরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে হয়ত কাগজের কথা বুঝতে অনেক সহজ হতে পারে। পরিশেষে আমাকে দুটি কাগজ দেখানো হল, যা দেখে আমিও কিছু বুঝি নি! বাকি কাগজ কই প্রশ্ন করাতে তিনি বললেন, বাকি গুলো আস্তে আস্তে দেখাবেন। হতাশ হলাম, যে বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম, হয়ত সেই সোনা-রূপা উদ্ধার সম্ভব হবেনা! ভদ্রলোক আমাকে সকল কাগজ না দেখিয়ে, মাত্র দুটি কাগজ দেখিয়ে হয়ত আমার মতলব আন্দাজ করতে চাচ্ছিলেন! তার কৌশল ছিল, জ্বিনদের মাধ্যমে খবর পাবার জন্য এই দুটি কাগজই যথেষ্ট ছিল। যেহেতু আমি কোন মন্তব্য করতে পারলাম না, তাছাড়া আমার দ্বারা জ্বিনদের সহযোগিতা নেবার কোন লক্ষণও তিনি দেখছেন না। তাই বাকী কাগজ দেখানোর জন্য তিনি সময় নিবেন বলে চিন্তা করলেন!
আমি এই বাড়ীতে এসেছি এবং বাড়ীটি চারিদিকে ঘুরে দেখেছি, খবরটি মুহূর্তেই সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। অনেক মানুষ আসল, কেউ একে অপরকে প্রশ্ন করে জানতে চাইল আমাকে কি জন্য আনা হয়েছে! আমাকে নিয়ে মানুষের এত কৌতূহল, ইতিপূর্বে কখনও লক্ষ্য করিনি।
কিছুদিন পরে আমার এক বাল্য বন্ধুর সাথে দেখা। একদা প্রাইমারী স্কুলে পড়েছি, এক সাথে ফুটবল খেলতাম, হালদা নদীতে সাতার কাটতাম। এক সময় তার পিতা পুরো পরিবার সহ এই এলাকায় চলে আসে। ফলে বহু দিন তার সাথে দেখা হয় নি। তার সাথে হঠাৎ সাক্ষাতে বুঝলাম আন্তরিকতার ঘাটতি হয়নি। সে আমাকে একটি অতি আশ্চর্য জনক জায়গা দেখানোর আহবান জানাল। আমি সে জায়গা দেখতে রাজি হলাম! তার পরদিন বিকেল বেলায় সে জায়গা দেখতে বের হলাম। সারি সারি গর্জন গাছের বাগানের ফাঁক দিয়ে সে আমাকে নিয়ে চলল! এ ধরনের সুন্দর বাগান আমি ইতিপূর্বে দেখিনি। স্বভাবগত ভাবে আমি বাগান পছন্দ করি, গহিন বনে ঘুরতে ভালবাসি, বনের সৌন্দর্য আমার কাছে অপূর্ব লাগে। আগেই বলেছি, একটি মামুলী গাছও আমার কৌতূহলী নজর দারী থেকে এড়িয়ে যায় না। এক পর্যায়ে আমরা দুজন, একটি গোলাকার গর্তের নিকট এসে দাঁড়ালাম! বুঝা যাচ্ছে, কয়েকদিন আগেই এটি খোঁড়া হয়েছে! অন্যূন তিন মিটার গভীর ও দেড় মিটার গোলাকার হবে। পাহাড়ের এই জায়গায়, জনবসতি বিহীন স্থানে, এত মসৃণ ও সুন্দর করে গর্ত করার কারণ কি? তাছাড়া এই গর্তের খনন করা মাটি কাছাকাছিও দেখা যাচ্ছে না!
বন্ধুকে প্রশ্ন করলাম, এই গর্তটি এত নিখুঁত করে বানানোর কারণ কি? তাছাড়া এই গর্তই বা কে করেছে? কেন করেছে? বন্ধুর চেহারায় অজানা এক দুষ্টামির হাঁসি! সন্দেহ আসাতে তাকে বললাম, অপেক্ষা না করে, চল তোমার সেই আশ্চর্য জনক জায়গাটা আগে ঘুরে আসি! সে বলল, আসলে আমার কাছে কোন আশ্চর্য জনক জায়গা নাই! এই স্থানে তোমাকে নিয়ে আসাই আমার লক্ষ্য ছিল! শুনে বুক কেঁপে উঠল, ভাবলাম কোন অজানা ফাঁদে পা দিলাম কিনা? আমার ভাবনার মাঝেই বন্ধুটি প্রশ্ন করল, ‘বল এই গর্তটিতে তুমি কি কি পেয়েছ’? যেন, আকাশ থেকে পড়লাম! সে বলল তুমি কেন নাটক করছ? আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না তবে আমার একটি উপকার তোমাকে করতেই হবে।
আমার মাথায় কাজ করছিল না, কিছুই বুঝতে ছিনা কি করব। এই স্থানে আমার অবস্থান, আরো কিছু মানুষ বুঝে ফেলেছিল, এখনও ছোট নদীর ওপাড়ে, তারাও দল পাকিয়ে এদিকে আসছে, পৌছতে সময় লাগবে। আমি ভাবছি কোন এক অজানা চক্রান্তে আমি আটকে গেছি, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কলিজা ফাটিয়ে চিৎকার দিলেও কেউ কোনদিন শুনবে না, মরে গেলেও কেউ জানবে না। মুহূর্তে ভাবলাম হয়ত সবাই মিলে আমাকে এই গর্তে জীবিত কবর দিবে। তাই তাকে বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব হলে তোমার উপকার করব, আমাকে ব্যাপারটি খুলে বল।
সে বলল, এই যে গর্ত থেকে তোমার নেতৃত্বে গত মঙ্গলবার রাত্রে একটি বিরাট আকৃতির স্বর্ণের হাড়ি উদ্ধার হয়েছে! সবাই ধারনা করছে এটা অলি মিয়া মুন্সীর সম্পদই হবে। তুমি কয়েকদিন আগেই মুন্সী বাড়ীতে গিয়েছ এবং সোনা কোথায় সে খবর জেনে এসেছ। এখন তাদের ছেলেদের না জানিয়ে নিজেই পুরো ‘ডেগ’ তথা এক হাড়ি স্বর্ণ মেরে দিয়েছ! পুরো এলাকার মানুষ এটা নিয়ে কথা বলছে! মানুষ আরো বলাবলি করছে তুমি এত গুলো স্বর্ণ সম্ভাব্য কোথায় লুকিয়ে রাখতে পার? মুন্সির ছেলেরা তোমার পিছনে মানুষ লাগিয়ে রেখেছে। তারা তোমার উপর ক্ষিপ্ত। এসব স্বর্ণের হদিসের জন্য অনেক সাধারণ মানুষ তোমাকে অনুসরণ করছে। তুমি এত গুলো সোনা-রূপা তোলে আনার পরও আমার কাছে না জানার ভান করছ! যেন তুমি এসবের কিছুই জান না। আমিতো তোর ছোট কালের বন্ধু, আমাদের পারিবারিক অবস্থাও ভাল নয়। তুই যে পরিমাণ স্বর্ণ পেয়েছিস, সেখান থেকে একটি ছোট টুকরা দিলেই আমাদের কাজ সেরে যাবে। তোর তো এত স্বর্ণের দরকার নাই! আমার দাদী সব খবর নিয়েই, তোর কাছে আমাকে পাঠিয়েছে। একথা বলেই, সে আমার হাত ধরে ফেলল। তুই আমাদের জন্য একটু দয়া কর!
মাথায় যেন আসমান ভেঙ্গে পড়ল! মুহূর্তেই ব্যাপারটি আঁচ করলাম। তাকে বললাম, এসব কথা এখানে দাড়িয়ে না বলে, চল বাড়ির দিকে যাই। তোকে বিস্তারিত জানাব। আমি চাচ্ছিলাম কৌতূহলী মানুষের দলটি এখানে পৌছার আগেই যাতে আমি সড়ে যেতে পারি। নিরাপদ এলাকাতে এসে তাকে জানালাম, এসব গর্তের কোন খবর আমার কাছে নাই, এমন কি অলি মিয়া মুন্সীর ছেলেদের কোন সোনা-দানা আমার কাছে নাই। আমি ওসবের কিছু জানিনা। সুতরাং তোমাকে সোনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ও না। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানালাম, বন্ধুটি আমার দ্বারা হয়ত উপকৃত হতে চেয়েছিল, ক্ষতি করার চিন্তা ছিল বলে মনে হল না। তবে এলাকার মানুষ যে, অতি লোভে পড়ে আমার পিছু নিয়েছে, এই খবরটা না জানলে আমার জন্য চরম খারাপ পরিণতি ঢেকে আনতে পারত। এমন কি সোনা-দানার লোভে আমাকে মেরেও ফেলতে পারত। তাই অধিকতর সতর্ক হলাম এবং বুঝলাম এই এলাকাটা আমার জন্য দিন দিন অ-নিরাপদ হয়ে উঠবে।
মুন্সীর চালাক ছেলে তো জানত আমাকে কি কাগজ দেখিয়েছে! সেই কাগজ দিয়ে যে তার পিতার সম্পদ উদ্ধার সম্ভব নয় সেটা সে নিশ্চিত জানে। তবে জ্বিনের মাধ্যমে যদি কিছু একটা করে ফেলি সেটা অন্য কথা। সে চালাক হলেও চিত্র দেখে সম্পদ উদ্ধার করবে এমন বুদ্ধিমান ছিলনা। আবার যে বুদ্ধিমান ছিল, সে এসব কাগজ চোখেও দেখেনি যে, তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাবে। বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও, চালাক ছেলেটি অবশেষে পিতার গুপ্ত সম্পদ উদ্ধারের আশায়, তান্ত্রিক বিদ্যায় মনোনিবেশ করল! আমার নিকট থেকে এ বিষয়ের উপর কিছু নোট আগেই জোগাড় করেছিল। জ্বিন হাজির করার বিদ্যার প্রতি আসক্ত হল। তাবিজ লিখা, যাদু মন্ত্র করার প্রতি নিজের সময়কে ব্যয় করল। বৃদ্ধ বয়সে সাদা দাড়ি মোচে একাকার সেই ধনী ব্যক্তি এখন এ অঞ্চলের একজন সেরা তান্ত্রিক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করল। অবশেষে তিনি সেটাকে পেশা হিসেবেও বাছাই করল এবং এখনও তিনি সেই পেশাতেই কর্মরত আছে!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৩৫