আবদুল কাদের দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে থামলেন, এই সুযোগে বলে বসলাম: আমার জ্বিন সাধন করার কোন ইচ্ছা নাই, তবে টোটকা চিকিৎসা হিসেবে, জ্বিন তাড়ানোর মন্ত্র-তন্ত্র জানা থাকলে নিজের, দেশের ও দশের উপকার হয়। এটা কি আমাকে শেখানো যায়?
তিনি বললেন, এই কাজটি একটু কঠিন এবং অভিজ্ঞতার আলোকে করতে হয়। তুমি তো দেখেছো তোমার মেঝ ভাইকে কিভাবে ছাড়িয়েছি? তিনি বলতে রইলেন, জ্বিন মানুষের ইচ্ছা শক্তিকে দখল করে। মানুষের মুখ দিয়ে জ্বিন কথা বলে। তখন মানুষের চোখ দিয়ে জ্বিনেরা দেখে থাকে, মানুষের কান দিয়ে জ্বিন শুনে। জেনে রাখবে, জ্বিনে আক্রান্ত ব্যক্তি কখনও হ্যাঁচ্ছো দেয় না! দিতে পারে না। যদি কোনভাবে হ্যাঁচ্ছোটা বের করা যায় তাহলে চিকিৎসা ছাড়াই জ্বিন ভূ-পৃষ্টে আছড়ে পড়বে ও মারা যাবে। সে জন্য জ্বিনে ধরা রোগীর নাকে সরিষার তৈল লাগানো হয়! মরিচ পোড়া গন্ধ ঢুকানো হয়, যাতে তার শরীরে হ্যাঁচ্ছোর উদ্রেক হয়। রোগীকে জোড়ে ধমক দিলে কিংবা মৃদু পিটালেও জ্বিন আঘাত প্রাপ্ত হয়। সে জন্য ওঝা-বৈদ্যকে ভয়ঙ্কর চেহারার অধিকারী হলে সুবিধা হয়। জ্বিনদের উপস্থিত জ্ঞান বুদ্ধি মানুষের মত প্রখর নয়! মানুষের মত দূরদর্শীতা, মেধা, প্রজ্ঞা জ্বিনদের নাই বললেই চলে। তাই কখনও কড়া হুমকি দিলে, জ্বিন ভড়কে যায় এবং পালাতে বাধ্য হয়!
জ্বিনে আক্রান্ত রোগীকে পিটালে, মারের ব্যথা রোগী ও জ্বিন দু’জনেই অনুভব কর। এতে অনেক সময় জ্বিন পালিয়ে যায়। জ্বিন পালিয়ে গেলে মানুষ বেহুশ হয়ে যায়। হুশ আসার পরে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেন আমি এখানে কেন? শরীরে এত ব্যাথার কারণ কি? এমনকি তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমি এখানে কেন বা আপনাদের কি হয়েছে ইত্যাদি! তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, নাকে তৈল লাগিয়ে, মরিচ পোড়া গন্ধ নাকে ঢুকলে জ্বিন পালাবার আগেই মানুষটি মারা যেতে পারে। কেননা বুঝতে হবে একজন সুস্থ মানুষ কি পরিমাণ ঝাঁঝ সহ্য করতে পারে। তাই জ্বিন তাড়ানোর উছিলায়, মানুষের দেহে এটার প্রয়োগ হলে শারীরিক ক্ষতি হবেই।
অনেক মানুষ শারীরিক পাগল, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মানুষকে জ্বিনে ধরা পাগল মনে করে, এসব ব্যবহার করে এবং কখনও মানুষ অপ চিকিৎসায় মারাও যায়। যাক, সরিষার তৈল ও মরিচ পোড়া হল এক প্রকার প্রাথমিক চিকিৎসা। মরিচ, সরিষা, গোলমরিচের নাম শুনলে যদি রোগীর চিল্লানো ভাব বেড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সহজে কাজ হবে। অন্যতায় এই পদ্ধতিকে সর্বদা ব্যবহার করতে নাই।
জ্বিনেরা কখনও মানুষের আকৃতিকে উপলব্ধি করতে অতি কৌতূহলে কারো উপর ভর করে। সেই জ্বিন বিতাড়ন করা সহজ। কখনও মানুষের আচরণের ভুলে জ্বিন ক্ষিপ্ত হয় এবং তার উপর ভর করে। সেই জ্বিন বিতাড়ন করা আরেকটু কঠিন। কিছু জ্বিন নালা, নর্দমায়, ডোবায় বসবাস করে এরা উন্মাদ ও পাগল। এ ধরনের জ্বিনকে তাড়ানো তার চেয়েও বড় কঠিন। জ্বিনকে যেভাবেই তাড়ানো হোক না কেন, রোগীর উপর যাতে শারীরিক নির্যাতন না হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। কেননা জ্বিন পালিয়ে গেলে, রোগীর মন সুন্থ হবার পর, তার শারীরিক নির্যাতনের ব্যথা দূর করতে তাকে আবারও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে!
আবদুল কাদের আরো যোগ করলেন, কোরআন হাদিস মতে জ্বিন তাড়ানোর ভিন্ন পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতিকে জ্বিন বেশী ভয় করে। পাহাড়ি মানুষেরা জ্বিনে আক্রান্ত মানুষকে পানিতে ভিজাতে থাকে, যাতে করে সর্দি আসে। সর্দি আসলে হ্যাচ্ছো আসবে, হ্যাচ্ছো দিলে জ্বিন পালাবে। যদি পাগল রোগী হ্যাচ্ছো দেয় এবং তাতেও যদি রোগ ভাল না হয়, তাহলে বুঝতে হবে এটা অন্য রোগ। বেশীর ভাগ জ্বিনের সাথে কথা বলে, আল্লাহ ও পরকালের ভয় দেখিয়ে কিংবা ইসলামী পন্থায় বিদায় করানো যায়।
ভুত, প্রেত গুলো মূলত নোংরা চরিত্রের অধিকারী। অভদ্র মানুষকে শিখাতে যেমন অভদ্র আচরণ দরকার হয়। ভুত-প্রেতের জন্যও তেমনি অভদ্র ব্যবস্থার দরকার হয়। মনে রাখতে হবে কারো জ্বিন ছাড়াতে গেলে, তোমাকে সেই জ্বিনের শত্রু হতেই হবে। তাই এই রাস্তা হল শত্রু তৈরির রাস্তা। যে শত্রুকে দেখা যায় না, চিনা যায়না। বিপদে পড়লে শুধু তার পরিণতি বুঝা যায়। তিনি আরো বললেন, আমার অভিজ্ঞতায়, পারত পক্ষে এই রাস্তায় কারো পা না বাড়ানো উচিত।
আমি তন্ময় শুনতে রইলাম, রাত গভীর হয়েছে, ততক্ষণে হারিকেনের তেল শেষ হয়ে শুধুমাত্র ফিতার উপর নির্ভর করেই আগুন মিট মিট করে জিবীত আছে। এই গুরুত্বপূর্ন তথ্যগুলো গিলে নিলাম, কথাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে রাখেছিলাম। একদা মুসিবতে পড়ে, কয়েক বন্ধুর অনুরোধে, আবদুল কাদেরের বিদ্যা বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে, এক ধনীর ব্যক্তির স্ত্রী থেকে ঝেঁটিয়ে জ্বিন বিদায় করেছিলাম। এই ঘটনা আমাকে ব্যাপক পরিচিতি করে তুলে। গ্রামে গ্রামে শোর উঠে গেল, জ্বিন বৈদ্য থেকে বিদ্যা শিখে আমি এখন নিজেও একজন ‘বালক পীরে’ পরিণত হয়েছি। নিশ্চিত হলাম, আবদুল কাদেরের বিদ্যা বুদ্ধি বিফলে যায় নাই।
কলেজ জীবনে পড়ার সময়, মাদ্রাসার মসজিদে রীতিমত মাগরিবের নামাজ আদায় করতাম। কখনও নামাজ শেষে মাদ্রাসার ছোট ছাত্রদেরকে অদ্ভুত আচরণ করতে দেখতাম। আমি জানতাম কেন এমনটি হয়! মাদ্রাসার পাশেই বিরাট ময়লার ড্রেন। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজে বড়দের ভিড়ে, টয়লেটে স্থান না পেয়ে কদাচিৎ বাচ্চা বয়সের ছাত্ররা এই ড্রেনে প্রস্রাব করে দিত। বেয়াড়া, বেতমিজ ভুত গোস্বায় সেই ছেলেটির উপর ভর করত। প্রতি সপ্তাহে কারো না উপর না কারো উপর এটা ঘটতে দেখতাম। মাদ্রাসায় ছিল এক বুড়ো আলেম, তিনি পান খেতে পছন্দ করতেন, তাই সর্বদা পকেটে আস্ত পান রাখতেন। কোন ছাত্র পাগলাটে আচরণ করা মাত্রই তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া হত। তিনি সহসা পানের বৃন্তটি ছাত্রের কানে ঢুকিয়ে দিতেন! ঘটনাস্থলেই ভুত জান ছেড়ে পালাতেন, তবে বেয়াড়া ভুত ও নাছোড় বান্দা! সেও বারবার কাউকে না কাউকে বিরক্ত করেই ছাড়তেন!
বৃদ্ধ আলেম, শুধুমাত্র সুরা ফাতিহা, ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়তে থাকতেন। ভুত মাগো, বাবারে বলে পালিয়ে যেত! কলেজ জীবনে এটা দেখে ভাবতাম আর হাঁসতাম; এটা দেখে যে, আবদুল কাদেরের চেয়েও, ইসলামী পন্থায় আরো সহজে জ্বিন ভুত তাড়ানোর পদ্ধতি আছে! কলেজ জীবনে একদা আবদুল কাদেরের খবর নিয়ে জানতে পারি, তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে সদলবলে নিরুদ্দেশ হয়েছেন বহু বছর আগেই। চলবে......
আগের পর্ব: বদমাশ জ্বিনের কবলে আবদুল কাদের! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-৭ দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:০২