যেখানে দাড়িয়ে আছি সেখান থেকে বাড়ির কেউ আমাকে দেখার কথা নয়! এটা আমার আত্মীয়ের বাড়ী, তবে কোনদিন তাদের ওখানে যাওয়া হয়নি। তাছাড়া এই রাস্তা ধরে খালার বাড়ীতে যাবার কালে কদাচিৎ আসা যাওয়া হয়। এই গ্রামে আমার আম্মার এক চাচাত বোনের শ্বশুর বাড়ী আছে বটে, তবে তাঁর গলার স্বর আমার মুখস্থ, তাঁকেও খালাম্মা বলে ডাকতাম। সন্দেহের ঘোর না কাটতেই, সেই মহিলা কণ্ঠ আমার পিতার নাম ধরে আমাকে ভাগিনা বলে পুনঃ ডাকতে থাকলেন। অনিচ্ছা স্বত্বেও বাড়ীটির দিকে পা বাড়ালাম।
বাড়ীতে ঢুকার মুহূর্তেই আমার সেই খালাম্মার সাথে দেখা! তিনিও সেই মহিলার ডাক শুনে কৌতূহলে বাড়ীর বাহিরে এসেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম কেউ যেন আমার পিতার নাম ধরে আমাকে ডেকেছেন! তিনি হেসে বললেন, হ্যাঁ তোমাকে এমন একজন ডেকেছেন যার সাথে তোমার পরিচয় নাই! তিনি আমার ‘জ্যা’! বড় ভাসুর, চেয়ারম্যানের স্ত্রী! তাঁর মুখে তোমার ও তোমার পিতার নাম শুনেই আমি বাড়ির বাহিরে এসেছি। তিনি ঘরের ভিতর থেকেই তোমার নাম ধরে ডাকছেন। বাড়ীর বাহিরে কে হেটে যায় তা, বাড়ির আঙ্গিনা থেকে দেখার কথা নয়। আর তিনি ঘর থেকেই তোমাকে ডাকছেন শুনে ধারনা করালাম হয়ত তোমাকে পেয়ে যাই কিনা! বাকিটা তো তুমিই দেখলে!
খালাম্মা আমাকে তাঁদের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। বাড়ীতে ঢুকা মাত্র দেখতে পেলাম এক মহিলা ঘরের ভিতরে খোলা জানালার রড ধরে দাঁড়িয়ে। ঘরটি বাহির থেকে বন্ধ, তিনি আমাকে যেন বহুকাল ধরে চিনেন এমন বাক্য ব্যবহার করে আমার নাম ধরে বললেন, ‘তুমি আমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে নাও। দরজাটি খুলে দাও, তারা অনর্থক আমাকে বাড়িতে বন্ধী করে রেখেছে’। কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম!
সম্বিৎ ফেরে পেলাম, আগেই জানা ছিল জ্বিনের ভর করা মানুষদের কে কিছু তথ্য এভাবে জ্বিনেরাই দিয়ে যায়। একটু পরেই দেখলাম তিনি নিজে নিজে বকাবকি করছেন। আমাকে হুমকি দিয়ে বললেন, যদি দরজা না খুল তাহলে আমার চরম ক্ষতি হবে। পর মুহূর্তে আবার নিজে নিজেই হাঁসতে রইলেন। খালাম্মার সাথে কথা বলতে জানতে পারলাম, তাঁকে জ্বিনে ধরেছে, কোন মতেই জ্বিন মুক্ত করা যাচ্ছেনা। চেয়ারম্যানের বাচ্চারা এখনও ছোট, অনেক টাকা কড়ি খরচ করেছেন, কোন কুল কিনারা হয়নি। জ্বিন তাড়াতে আজ বিকেলে তাদের বাড়িতে একজন বৈদ্য আসবেন। এই খবর ওনাকে কেউ না বললেও, হয়ত জ্বিনের মাধ্যমে খবরটা তিনি জেনেছেন, ফলে আজ তিনি পাগলামির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন!
মৌলভী বাচা মিয়া, জ্বিন ভুত তাড়ানোতে সিদ্ধ হস্ত। নিজের সন্তানাদি জন্মের পর বাঁচেনা বিধায় তিনি এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। অগত্যা চেয়ারম্যানের অনুরোধ, কান্নাকাটি ও পীড়াপীড়ির জন্য তাঁকে শেষবারের মত অগত্যা আবারো বৈদ্যের বোঁচকা হাতে নিতে হচ্ছে! এই খবরে আমি যেন হাতে আসমান পেলাম!
আমার নিজেরও বদনাম আছে জ্বিনে আক্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে! জ্বিন তাড়ানোর বৈদ্য, জ্বিন আক্রান্ত রোগী এবং জ্বিন তাড়ানোর পদ্ধতি সবটাই এক সাথে দেখতে পাব এই আশায় খালাম্মাকে ধরলাম, যাতে করে তিনি আমাকে এসব দেখতে সুযোগ করে দেন। আমার চিকিৎসা দেখায় চেয়ারম্যানের আপত্তি ছিলনা, তিনি আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু, সহপাঠি এবং কয়েক দিকের প্যাঁচানো আত্মীয়। বৈদ্য বিকালেই আসবেন, সে হিসেবে আমিও যথারিতী হাজির। জ্বিন তাড়াতে দীর্ঘক্ষন ধরে বৈদ্যের বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা দেখলাম। নিজের চোখের সামনেই দেখলাম একজন অসুস্থ মানুষকে কিভাবে ঘটনাস্থলেই সুস্থ করতে তুলল বোচা বৈদ্য। বোচা বৈদ্যের কাজের প্রক্রিয়া শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আদ্যোপান্ত আমার মগজে গেঁথে রাখলাম! আমি চিন্তা করতে থাকলাম এটা কি দেখলাম। তাছাড়া এটা কোন নাটক নয়, সরাসরি চেয়ারম্যান সাহেবের বউ। সে সময়ে চেয়্যারম্যানদের যথেষ্ট ইজ্জত সম্মান ছিল। এখানে নাটক, যোগ সাজস করার কিছুই ছিলনা। তাছাড়া একটি ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমিতো উপস্থিত ছিলাম!
আগের পর্ব: জ্বিন ধরতে হাঁটের আয়োজন! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-৪ দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:০৯