সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘দেশে-বিদেশে’ পড়ার পর থেকে ভ্রমন কাহিনী পাঠ আমার একটি প্রিয় কাজ। অনেক লেখক চাক্ষুস যা দেখছেন হুবহু তাই দিনপঞ্জীর মতো লিখে যান। অনেকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে যা দেখেন, মন দিয়ে যা অনুভব করেন সেটাই লেখায় তুলে আনেন। দুটোই উপভোগ্য। ভ্রমনকাহিনী লিখতে হলে আপনাকে অবশ্যই নোট রাখতে হবে। কেবলমাত্র স্মৃতিশক্তির ওপর ভর করে পরে সবকিছুর সঠিক বর্ণনা দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। ব্লগে অনেককে অত্যন্ত মোহনীয়ভাবে তাদের ভ্রমনের বর্ণনা দিতে দেখেছি। অনেকে আবার ভাষা কম ব্যবহার করে চমৎকার সব ছবির মাধ্যমে নিজের ভ্রমনটি ফুটিয়ে তুলেছেন। এর একটিও করার যোগ্যতা আমার নেই। আমি একান্তই অলস প্রকৃতির। নোট রাখা তো দুরের কথা, ক্যামেরা বহন করাও আমার স্বভাববিরুদ্ধ। সুতরাং আমার পক্ষে কখনোই কোন ভ্রমনকাহিনী লেখার দুঃসাহস দেখানো সম্ভব নয়। তবে কুঁজোরও কিন্তু চিৎ হয়ে শোবার শখ হতে পারে। দেশে-বিদেশে ঘুরে বেরানোর সময় কোনো কোনো জায়গার কথা কেমন যেনো মনের মধ্যে গেঁথে যায়।মনে হতে থাকে জায়গাগুলোর কথা নিয়ে কারো সাথে গল্প করি। নিচের লেখাটুকু সেরকমই একটি গল্প করার (অপ)চেষ্টা। এমনকি সামনে এরকম আরো গল্প আসবে কি-না অধমের পক্ষে সেটাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
সুইজারল্যান্ডের বানিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী জুরিখের একেবারে কেন্দ্রস্থলে প্লাৎসপিটজ পার্ক নামে একটি মনোরম পার্ক আছে। একসময় এটি নিডল পার্ক নামে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। আশির দশকে জুরিখের হেরোইনসেবীরা নিয়মিতই পার্কটিতে জড়ো হতো। ওটা ছিল তাদের মিলনস্থল। ড্রাগ কেনা-বেচা, সেবন, আড্ডা আর ঝগড়াঝাটির জায়গা। আইন-শৃঙ্খলার স্বার্থে পুলিশ প্রায়ই তাদের সেখান থেকে তাড়ালে জুরিখের অন্যান্য অংশে গিয়ে তারা আবার জড়ো হতো। এতে দেখা গেলো আসক্তদের ওপর নজরদারি, বিশৃঙ্খলতা নিয়ন্ত্রণ কিংবা ড্রাগ ওভারডোজে অসুস্থদের চিকিৎসা দেয়াটা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।কারণ আসক্তরা এক জায়গার বদলে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে তখন এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নেয় নগর কর্তৃপক্ষ। তারা পার্কটিকে ড্রাগ আসক্তদের একপ্রকার অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। ঘোষণা করে পুলিশ ওখানে ঢুকে কাউকে অ্যারেস্ট করতে পারবে না। পার্কটি পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কর্মী, বাইরে পুলিস প্রহরা, জরুরী চিকিৎসা দেয়ার বন্দোবস্ত করা হলো। একই নিডলের ব্যবহারের মাধ্যমে এইডস্ ছড়ানো থেকে ড্রাগসেবীদের বাঁচানোর জন্য পরিস্কার নিডল-সিরিঞ্জও সরবরাহ করা হতো ওখানে। ওদের এক জায়গায় রেখে নিয়ন্ত্রনে সুবিধার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের একটি মানবিক যুক্তিও ছিল। সেটা হলো- ড্রাগ আসক্তিকে অপরাধের চেয়ে বরং অসুস্থতা বা রোগ হিসেবে দেখা হলে এর নিরাময় বা উচ্ছেদ বেশী কার্যকর হবে। যদিও শেষকালে দেখা গেছে সে আশার গুড়ে বালি!
এ ঘোষণার পর শুধু জুরিখের ড্রাগ আসক্তরাই কেবল নয়, সারা ইওরোপের ড্রাগ ডিলার আর আসক্তরা এ অভয়ারণ্যে জড়ো হতে থাকে। তাদের সংখ্যা একসময় ২০,০০০-এ গিয়ে পৌছায়। তুরস্ক, যুগোশ্লাভিয়া (তৎকালীন) এমনকি লেবাননের ড্রাগ ডিলাররা সেখানে হাজির হয়ে লোভনীয় এ বাজার দখলে তৎপর হয়ে ওঠে। বিশ্বের সকল ড্রাগ আসক্তদের চোখে স্বর্গ্ কিন্তু জুরিখের অন্যান্য নাগরিক বিশেষ করে আশেপাশের বাসিন্দাদের চোখে পঙ্কিলতায় পরিপূর্ণ্ নরক হিসেবে পরিগনিত হতে থাকে পার্কটি। পার্কে জনসংখ্যা বাড়ার গানিতিক হারের সাথে পাল্লা দিয়ে পরিত্যক্ত সিরিঞ্জ-নিডল, মনুষ্য বর্জ্য্, ড্রাগসেবী আর ডিলারদের মধ্যে মারামারিতে আহত-নিহত, এলাকায় ভাংচুর ও চুরি-চামারির ঘটনা, ওভারডোজের রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। রীতিমতো নরক গুলজার যাকে বলে আরকি!
১৯৮৭ হতে ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারী মাস অবধি এ অবস্থা চলতে থাকে। ক্রমে পুরো বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাওয়ার মতো অবস্থা হলে ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ৫ তারিখ পুলিশ ভেতরে ঢুকে সবাইকে বের করে পার্কটিতে লৌহবেষ্টনী দিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য, এমন সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ড্রাগসেবীরা স্বাভাবিকভাবেই খুবই মন খারাপ করেছিল। পরে তাদের কী হয়েছিল সেটা অবশ্য ভিন্ন কাহিনী। তবে ছোট্ট প্লাৎসপিটজ পার্কটি এখন খুবই দৃষ্টিনন্দন, সবুজ। একপাশে লিমাট আর অন্যপাশে সি্হ্ল নদী কুলকুল রবে বইছে।
প্লাৎসপিটজ পার্কের পাশে সিহ্ল নদীর ছবিটি ২০১০ সালের এপ্রিলে জুরিখ ভ্রমনের সময় আমার সেলফোনের ক্যামেরায় তোলা।
তথ্যসূত্রঃ নিউইয়র্ক টাইমস্।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৩:৪৭