বাংলাদেশে অপসংস্কৃতির নতুন সংযোজন ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’ উদযাপন। এ দিবসকে কেন্দ্র করে ইদানিং বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ও তরুণ-তরুণীদের উৎসাহ বিশেষভাবে চোখে পড়ার মত। ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ উপলক্ষে একাধিক দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ, বেসরকারি রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার, হোটেল-রেস্তোরাগুলোর বিশেষ আয়োজন, বিভিন্ন কার্ড বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর ভালবাসার আবেদন সম্বলিত রঙিন কার্ড ছাপানো ও বাজারজাত করা, সিনেমা, নাটক, টিভি সিরিয়াল ইত্যাদি সর্বত্রই যেন পশ্চিমা সংস্কৃতিকে আকষর্ণীয়ভাবে উপস্থাপনের তীব্র প্রতিযোগিতা। এসব দেখে আমাদের দেশের বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ বিশেষকরে তরুণ প্রজন্ম পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধে এক ধরনের পরিবর্তন আসছে। তারা পশ্চিমাধাচের নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা ও বিবাহবহির্ভূত প্রেমকে নিজেদের জন্য সুখকর মনে করছে। তারা ভাবছে, জীবনে সুখী হওয়ার জন্য বিবাহপূর্ব ভালবাসার কোন বিকল্প নেই। এ বিশ্বাস থেকে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা বিবাহপূর্ব ভালবাসার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের মধ্য দিয়ে তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের অজান্তেই পরবর্তী জীবনে এক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাদের রোমান্টিক প্রেমের সাথে বাস্তব জীবনের যে কত বড় অমিল রয়েছে তা হয়ত তারা উপলব্ধি করছে না। বিবাহবহির্ভূত প্রেম ও নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা থেকে চারিত্রিক স্খলনের সূত্র ধরে মানুষের জীবনে যে কত বড় মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে তা হয়ত তারা ভেবে দেখে না। এ অবাধ প্রেমই যে পরবর্তীকালে মানুষের জীবনের সব সুখ কেড়ে নিতে পারে তা তারা চিন্তা করে না। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ থেকে এমন চিত্রই ফুটে ওঠে।
প্রেমসূত্রে বিবাহ বনাম পারিবারিকসূত্রে বিবাহ
কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় প্রেমসূত্রে বিবাহ(Love marriage) ও পারিবারিকসূত্রে বিবাহ (settled marriage) এর উপর এক জরিপ চালায়। জরিপে দেখা গেছে, প্রেমের সূত্র ধরে যে বিয়ে হয় তার ৮৮% পরবর্তীতে ভেঙ্গে গেছে। অর্থাৎ, সফলতার হার মাত্র ১২%। পক্ষান্তরে, পারিবারিকসূত্রে বিবাহ এর প্রায় ৭৭% ক্ষেত্রে বিবাহ টিকে থাকে অর্থাৎ সাফল্যের হার ৭৭%। অন্য কথায় বলা যায়, প্রেমসূত্রে বিবাহ এর তুলনায় পারিবারিকসূত্রে বিবাহ এর সফলতার হার ৬ গুণ বেশি। আমেরিকার Syracase University এর জরিপে একই কথা বলা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, ভালবাসা অথবা প্রেম সফল দাম্পত্য জীবনের গ্যারান্টি নয় বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হয়।
‘রোমান্টিক প্রেম’ বনাম ‘বাস্তব প্রেম’
উল্লেখিত জরিপের উপর মন্তব্য করতে যেয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক সোল জর্দান বলেন, “যখন তুমি কারো প্রেমে মগ্ন থাকবে তখন পৃথিবীর সবকিছুই তোমার কাছে একজনকে ঘিরে আবর্তিত হবে। বিবাহের পর এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তোমার সামনে চলে আসবে যা তোমার সব কল্পনাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিবে। কেননা, তখন তুমি ভিন্ন পৃথিবী দেখতে পাবে, যা এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। পারস্পরিক সমঝোতা, মূল্যবোধ, অভ্যাস এসবের গুরুত্ব তুমি আগে ওভাবে কখনো চিন্তা করনি।”
টেলিন বিশ্ববিদ্যায়ের মনোবিজ্ঞান বিষয়ক অধ্যাপক ডঃ ফ্রেডারিক কোনিং বলেন, “রোমান্টিক প্রেম অত্যন্ত প্রবল ও আবেগময়। কিন্তু সেটা খুব স্থায়ী হয় না। অথচ ‘বাস্তব প্রেম’ জীবন ও মাটির সাথে সংযুক্ত এবং সেটি অভিজ্ঞতার সামনে টিকে থাকতে সক্ষম।” তিনি আরো বলেছেন, “রোমান্টিক প্রেমের ক্ষেত্রে প্রবল আবেগ বশে আনা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়না।” উক্ত লেখক যেটাকে ‘বাস্তব প্রেম’ বলেছেন তিনি হয়ত জানেন না,পবিত্র কুরআন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সে ভালবাসার কথাই বলেছে।
পবিত্র কুরআনে প্রেম প্রসঙ্গ
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহর তায়ালার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে, তিনি তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও এবং তোমাদের পরস্পরের মাঝে হৃদ্যতা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আর-রুম আয়াত-২১)। দাম্পত্য জীবনের ভালবাসাকে বুঝাতে পবিত্র কুরআনে ‘মাওদ্দা’ ও ‘রাহমাহ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ, সফল দাম্পত্য জীবনের জন্য রোমান্টিক প্রেমের পরিবর্তে ‘বাস্তব প্রেম’ ও পরস্পরের প্রতি দয়া, সহমর্মিতা ও সহনশীলতাপূর্ণ প্রেম বেশী প্রয়োজন, যেখানে দু’জনের মধ্যে ভোগ করার প্রতিযোগিতা থাকবে না; থাকবে পরস্পরকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা। এ জন্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে হৃদ্যতা ও দয়ার। তা কেবল রোমান্টিক প্রেম, প্রবল প্রেমপিপাসা, তীব্র আসক্তি ও কামনার সম্পর্ক নয়। সেটা হবে আবেগঅনুভ’তিপূর্ণ প্রশান্ত ভালবাসা ও পারস্পরিক দয়ার সম্পর্ক।
তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তীব্র আবেগ-অনুভূতিকে ইসলাম অবহেলা করেছে। এ ক্ষেত্রে উজ্জল দৃষ্টান্ত হলো স্ত্রী-পরিজনের প্রতি আমাদের নবী করিম (সাঃ) এর ভালবাসা। রাসূল (সাঃ) সে পেয়ালায় পানীয় পান করতে অত্যন্ত পছন্দ করতেন যে পেয়ালায় তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) পান করতেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে অসুস্থ অবস্থায় তিনি তার স্ত্রীর মিসওয়াক দিয়ে মুখ পরিষ্কার (মিসওয়াক) করতেন; এমনকি তাঁর স্ত্রীর কোলের উপর তিনি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার এটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ভালবাসার ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলাম ভালবাসাকে শুধু একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং ভালবাসার সীমানাকে অনেক বেশি প্রসারিত করেছে। আল্লাহর প্রতি ভালবাসা, রাসূল (সাঃ) ও সাহাবিদের প্রতি ভালবাসা, ভাল ও নেক লোকদের প্রতি ভালবাসা ও আখিরাতের প্রতি ভালবাসা, পিতা-মাতা, সন্তান, ভাই-বোন ও স্ত্রী-পরিজনের প্রতি ভালবাসা, অসহায় মানুষের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি। পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ও স¤প্রীতির ব্যাপারে ইসলাম যতটা তাগিদ দিয়েছে ততটা পৃথিবীর আর কোন ধর্মে পাওয়া যাবে না। ইসলামে ভালবাসা প্রকাশের কোন নির্দিষ্ট দিন ও ক্ষণ নেই। সব সময় অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও ভালবাসা প্রকাশকে উৎসাহিত করেছে ইসলাম। মহানবী (সাঃ) বলেছেন: ‘‘তোমাদের কেউ যখন তার ভাইকে ভালবাসবে তার উচিত এ ভালবাসার কথা তাকে জানানো” (আবু দাউদ, তিরমিযি)। মহানবী (সাঃ) আরো বলেছেন, “যার হাতে আমার জীবন সে মহান সত্তার শপথ করে বলছি, তোমরা বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করতে সক্ষম হবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরের প্রতি ভালবাসা পোষণ কর। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজের কথা বলব যেটি করলে তোমাদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে? তোমরা পরস্পরকে সালাম দেয়ার প্রচলন কর” (মুসলিম)। এ হাদিসে ভালবাসাকে জান্নাতে প্রবেশের পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি ইসলাম প্রাণহীন জড় বস্তুর প্রতিও ভালবাসা পোষণের কথা বলে। তাই তো মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “এটা ওহুদ পাহাড়। এ পাহাড়কে আমরা ভালবাসি আর এ পাহাড়ও আমাদেরকে ভালবাসে।”
পাশ্চাত্য কালচার ও দাম্পত্য জীবনে সুখ প্রসঙ্গ
পক্ষান্তরে, ভালবাসার নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার যে পশ্চিমা কালচারের প্রতি আমাদের যুব সামাজ আকৃষ্ট হচ্ছে পশ্চিমাধাচের সে ভালবাসা বাস্তব জীবনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতারণায় পর্যবশিত হয়। প্রেমের সূত্র ধরে পরবর্তীতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তারা দাম্পত্য জীবনে সুখ পায় না। পশ্চিমা দেশগুলোর পরিচালিত কয়েকটি জরিপ থেকে এমন তথ্যই পাওয়া যায়।
১. আমেরিকান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক স্টাডিতে দেখা গেছে, স্বামী অথবা বন্ধুদের কর্তৃক প্রহৃত হয়ে ১৭% নারীকে জরুরি চিকিৎসা সেবা নিতে হয়েছে এবং ৮৩% নারীকে প্রহৃত হয়ে অন্তত একবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। তাছাড়া আরো বহু সংখ্যক নারী যারা প্রহৃত হয়ে হাসপাতালে না গিয়ে ঘরেই চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন।
২. আমেরিকান সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এর এক রিপোর্টে দেখা গেছে, আমেরিকায় গড়ে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন স্ত্রী তার স্বামীর হাতে প্রহৃত হয়ে থাকে। (রিচার্ড জে. গ্যাল্স, ইউনিভার্সিটি অব রেজডি আইল্যান্ড, ফ্যামিলি ভায়োলেন্স রিসার্চ প্রোগাম,১৯৯৫)
৩. আমেরিকান টাইমস্ পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়েছে, স্বামী কর্তৃক প্রহৃত ৬০ লক্ষ স্ত্রীর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার জন প্রহারের কারণে মৃত্যুবরণ করে থাকে।
৪. জার্মানিতে পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী প্রায় ১ লক্ষ নারী তাদের স্বামী অথবা ছেলে বন্ধুদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।
৫. ফ্রান্সে প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ নারী স্বামী অথবা ছেলে বন্ধুদের দ্বারা প্রহৃত হয়ে থাকে।
৬. অল চায়না উইমেন ফেডারেশন পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ১৬ শতাংশ চাইনিজ নারী তাদের স্বামী কর্তৃক প্রহৃত হয়ে থাকে। (বেইজিং টাইম, নভেম্বর ৩০,২০০৩)
৭. এক জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকায় প্রায় ৬১% মেয়ে ১২ বছর বয়সের পূর্বেই তাদের কুমারিত্ব হারিয়ে ফেলে।
শেষকথা
পশ্চিমা দেশগুলো নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও অশ্লীল সংস্কৃতি চর্চার ফলে আজ তারা অসংখ্য সামাজিক সমস্যায় ভুগছে। তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চেয়ে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক করতে বেশি আগ্রহী। ফলে, তাদের পরিবার ব্যবস্থা (ঋধসরষু ঝুংঃবস) ভেঙ্গে পড়েছে। মেয়েরা সন্তান গ্রহণকে ঝামেলা মনে করছে। তাই সেসব পশ্চিমা দেশে আজ মানুষের জন্মের চেয়ে মৃত্যু হার বেশি। এরূপ নানা জটিল সমস্যায় তারা ভুগছে। পারিবারিক ব্যবস্থা পুনর্জীবিত করার জন্য তারা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে । সেখানে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন বিনষ্টকারী ও নারী-পুরুষের অবাধ সম্পর্কের শ্লোগানধারী তথাকথিত ভালবাসা দিবসের মত অপসংস্কৃতিকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না।
মুলঃ মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা
লেখক একজন গবেষক, ঠিকানা: পুরানা পল্টন, ঢাকা।