যাই হোক, এরকম বোকাসোকা রবীন্দ্রবাবুর স্বদেশ পর্যায়ের একটি গান আছে--প্রথম লাইনটি হল--সংকোচের এই বিহবলতা নিজেরে অপমান...। পরবর্তীতে তিনি গানাটিকে চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। চিত্রঙ্গদা নাটকটির অতি সার সংক্ষেপ হল--মণিপুরের রাজা তাঁর মেয়ে ‘চিত্রাঙ্গদা’কে বড় করে তোলেন যোদ্ধা হিসেবে। শিকারের সময় অর্জুনকে তিনি যুদ্ধে আহ্বান করেন। ঘটনাপ্রবাহে চিত্রাঙ্গদার মধ্যে নারীত্ব জেগে ওঠে; অর্জুন তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। প্রেমদেবের কাছে চিত্রাঙ্গদা রূপলাবণ্য প্রার্থনা করেন। এই নবরূপের চিত্রাঙ্গদার প্রেমে মোহিত হন অর্জুন। একপর্যায়ে অর্জুনের রূপমোহ ভঙ্গ হয়। চিত্রাঙ্গদাও প্রেমের দেবতাকে তাঁর আগের রূপ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন।
এই কাহিনীর মধ্যে মণিপুরে বন্যার জলের ছোবল নেমে আসে। দুর্বল প্রজারা তাদের রক্ষক চিত্রাঙ্গদাকে খুঁজতে আসে এই বিপদে ত্রাণ করার জন্য। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা যোদ্ধা থেকে ততক্ষণে রূপময়ী নারী হয়ে গেছে। সে কিভাবে প্রজাদের রক্ষাকল্পে হাজির হবে? কিন্তু প্রজারা দুর্বল হলেও তাদের বিশ্বাস, চিত্রাঙ্গদা --স্নেহবলে তিনি মাতা, বাহুবলে তিনি রাজা। তাদের রক্ষা করার জন্য তিনি আসবেন। না এসে পারবেন না। কারণ এটা তার দায়িত্ব। দায়িত্ব যে কঠিন। কঠিনেরে তিনি ভালবাসিয়াছেন।
তাঁর নামে ভেরী বাজা,
'জয় জয় জয়' বলো ভাই রে-
ভয় নাই, ভয় নাই, ভয় নাই, নাই রে।।
এর পরেই সেই গানটি গাইতে শোনা গেল--
সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান ।
সংকটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ ।
মুক্ত করো ভয় ,
আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয় ।
দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো ,
নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো ।
মুক্ত করো ভয় ,
নিজের 'পরে করিতে ভর না রেখো সংশয় ।
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ ।
মুক্ত করো ভয় ,
দুরূহ কাজে নিজেরি দিয়ো কঠিন পরিচয় ।
চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্ট্যটির রচনাকাল ১২৯৯ বঙ্গাব্দে ভাদ্র মাসে। স্বদেশ পর্যায়ের মুল গানটির অবস্থান ১১ সংখ্যক গানে। এই গানটিতে প্রথম লাইনে রয়েছে 'সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান'। নাটকে সংকোচ শব্দটি পাল্টে বসেছে 'সন্ত্রাস'। নাটকের বস্তুঅনুসারে এ ধরনের পরিবর্তন রবীন্দ্রনাথ করেছেন। কিন্তু গানটি কেবল গান হিসাবে গীত হলে সংকোচ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়। রবীন্দ্রনাথ বোকাসোকা লোক বলেই এ ধরনের গোঁজামিল তিনি দিয়েছেন। এবং গোঁজামিলটি এ ভবের সর্বশ্রেষ্ঠ দোররা কাউয়া কবি ব্রাত্য রাইসু ধরে ফেলেছেন। রবীন্দ্রবাবু--তুমি এইবার যাবা কোনহানে? তিনি রবীন্দ্রনাথের এই গানটির পাঠ নিয়ছেন চিত্রাঙ্গদা বহি থেকে। সংকোচ শব্দটির বদলে সন্ত্রাস শব্দটি তার পছন্দের। সন্ত্রাস শব্দটির একটি আলাদা জোস আছে। ব্রাত্য রাইসু তার হযরত পীরে কামিল মজহারের প্রিয় জেহাদী সন্ত্রাস’কে বেছে নিবেন এটাই তো স্বাভাবিক। তিনি কেন বোকা সোকা হবেন। তারপর ঐ কবিতার একটি ভাবসম্প্রসারণ করেছেন। পড়ে খাতার মধ্যে লুকিয়ে রাখেন নাই। পাবলিকের উদ্দেশ্যে নাজেল করেছেন। পাবলিক বলেছেন, মারহাবা। মারথাবা।
ব্রাত্য রাইসুর এই ভাবসম্প্রসারণ পাঠ করে এক অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত বাল্লক থমকে গেল। বলল, মামু—আম্গো ক্লাশে ভাবসম্প্রসারণ করা হয়। পরীক্ষায় ইহার জন্য ১০ নম্বর অবধারিত। আম্মোও এই কবিতাটির একটি ভাবসম্প্রসারণ রচনা করিয়াছি। আপনে এইটা দেইখা লন। তারপর ওনার ভাবসম্প্রসারণটা দিয়েন। বলিয়েন—কেডা কত নম্বর পাইবে?
ওকে। তাই হোক। বোকাসোকা রবীন্দ্রনাথের ততোধিক বোকাটে একটি কবিতার ভাবসম্প্রসারণ বাল্লকটিকে দিয়ে শুরু হউক। তারপর আমাদের অতি দার্শনিক ত্রাতা দোররা কাউয়া কবির ভাবসম্প্রসারণটি দেওয়া যাবে। আপনারা পড়িবার কালে মার্কিং করবেন কিন্তু। শুকরিয়া।
........................................................................................................
ভাবসম্প্রসারণ—সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান …
নাম : মুহাম্মদ আতিকুল ইসলাম। অষ্টম শ্রেণী
পূর্ণমান : ১০
আলোচ্য অংশটুকু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মশক্তি নামক কবিতা হইতে লওয়া হইয়াছে। কবি এখানে আত্মশক্তির উদ্বোধনের কথা কীর্তন করিয়াছেন।
কবি বলিয়াছেন, মানুষের দুইটি সত্বা রহিয়াছে। এক. ব্যক্তিসত্বা। দুই. সামাজিক সত্বা। সংকোচ বা ভয় থাকিবার কারণে মানুষের এই আত্মশক্তির স্ফুরণ ঘটে না। ফলে সে এক ধরনের দুর্বল হইয়া জীবনাতিপাত করিয়া থাকে। এইরূপ জীবনযাপন অপমানজনক। কবি বলিয়াছেন, মানুষকে তাহার আত্মশক্তিকে জাগাইতে হইবে। সকল ভীরুতাকে জয় করিয়া নিজেকে জয় করিতে হইবে। আত্মউন্নয়ন ঘটাইতে হইবে।
তাহার পরে তাহাকে সামাজিক সত্বাটির প্রতি দায়িত্বপালন করিতে হইবে। সমাজে যাহারা দুর্বল তাহাদের রক্ষা করিবার দায় বহন করিতে হইবে। আর দুর্জনদের প্রতিহত করিতে হইবে। এ জন্য নিজের অপার শক্তিধর আত্মশক্তিতে নির্ভর করিতে হইবে। তাহা হইলে তাহার ভয় বা সংশয় কোনো কিছুই তাহাকে কাবু করিতে পারিবে না। এবং সর্বদা প্রস্তুত থাকিতে হইবে যেন যে কোন মহৎকাজের ডাক আসিলে ঝাপাইয়া পড়িতে হইবে। কঠিন পণ করিয়া সেই সকল কঠিন কাজগুলোতে নিজের সামর্থ্যকে উর্ধে তুলে ধরিতে হইবে।
.................................................................................................................
ভাবসম্প্রসারণ : সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান …
ব্রাত্য রাইসু। শ্রেণী : অজানা।
পূর্ণমান : ১০
আহা কী দুর্বল এই গান! গানের বাণী অনুসরিলে এর লেখকরেও রক্ষাকল্পে আগাইয়া যাইতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু তিনি অলরেডি অ-ভবলীলায়িত।
রবীন্দ্রনাথের আমলে বানান নিয়া শুচিতা প্রায় সকলেরই আছিল। শুচিবাইগ্রস্ত ব্রাহ্মণদের প্রভাব মেবি! তাই তাঁরও বানান সঠিক রাখার কসরৎ অত্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু তুলনীয় ভাবে লক্ষণীয় তাঁর চিন্তার গোঁজামিল। ভাইবা দেখা দরকার পুরা বাংলা তাল্লুকই এই রকম কাছা-আলগা আছিল কিনা। লালনে, পরমহংসে ভিন্নতা থাকা বাঞ্ছনীয়, কারণ অ-হীনম্মন্যতা। কিন্তু ছোট আত্মার বাঙালীরা গোজামিল আর পরিশুদ্ধতায় এখনও অগ্রসরমান।
যা নিয়া বলতেছিলাম। এই গানে রবীন্দ্রনাথ কী করতেছেন? " আপনা-মাঝে শক্তি ধরো" বলতেছেন। কে শক্তি ধরবে? যে দুর্বল, যার শক্তি নাই বইলা প্রতীয়মান হয়, নাকি? তো সেই দুর্বলরেই আবার রবি আহবানিছেন, "দুর্বলেরে রক্ষা করো"; কী ঘটতেছে তাইলে? দুর্বলরে বলতেছেন, তারে রক্ষা করার লোক আছে। যদি দুর্বলরে অন্যে রক্ষা করবে তাইলে সেই দুর্বলরেই "আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়" বলার কারণ কী? যিনি দুর্বলরে রক্ষা করতে বলতেছেন, তিনিই, সেই দুর্বলরেই, আবার আপনা মাঝে শক্তি ধরতে বলতেছেন--মানে কিছু দুর্বল আপনা মাঝে শক্তি ধইরা অন্য দুর্বলদের রক্ষা করবে। বাস্তবে এমন হয় অবশ্য। কিন্তু প্রেরণা মূলক গানে সব দুর্বলরেই শক্তি ধরতে দিতে আপত্তি কেন! কিছু দুর্বলরে কেন শক্তিমানদের অপেক্ষায় ওয়েটিং লিস্টে হোয়াইয়া রাখা। নাকি গান লিখতে হইব, তাই লিখছিলেন?
অর্থাৎ রাজ্যের দায়িত্ব তিনি নিয়া নিছিলেন। এরে বলে জমিদারি চিন্তা। জমিদারের চিন্তা জমিদারি মূলকই হবে!
.................................................................................................................
আশা করি শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত লোকজন যারা এই ভাবসম্প্রসাণখানা পূর্বে পাঠ করিয়াছেন এবং হুক্কা হুয়া করিয়া উঠিয়াছেন দোররা কাউয়া কবির সঙ্গে তাহারা, এবং যাহারা গেলি শব্দে নিন্দা বর্ষণ করিয়াছেন তাহারা এবং যাহারা অতীতে দেখেন নাই—এক্ষণে দেখিতে পাইয়াছেন তাহাদের সকলকে রবিবাবুর বোকাসোকা কবিতা বা গান যাহাই বলুন না কেন—তাহা নতুন করিয়া পাঠ করিয়া ১০ নম্বরের মধ্যে মূল্যায়ন করিতে অনুরোধ করা হইল। সেই সঙ্গে মুল্যবান মন্তব্য প্রার্থনীয়।
এই অবসরে ব্রাত্য রাইসুর দোররা কাউয়া কবিতা এবং আরেকজন কবি মুজিব মেহদী কৃত ভাবসম্প্রসারণটিও এতদসঙ্গে সংযোজন করা হইল। ইহা ফাউ। এবং ফ্রি। একটা পড়িলে আরেকটি ফ্রি পাইবেন ভিত্তিতে অত্র বিজ্ঞপানটি প্রচারিত। আমেন।
কবিতা : দোররা কাউয়া
কবি ব্রাত্য রাইসু
দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে
দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে কা কা করে রে
দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে হিঃ হিঃ কী কী করে রে
পাতা ঝরে পাতা ঝরে পেয়ারার পাতা ঝরে রে
দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে কু কু করে রে
দোরা কাউয়া পাতি কাকের গোয়া মারে রে
পেয়ারা গাছে পাতি কাকের গোয়া মারে রে
ওরে আমার দোরা কাউয়া, দোরা কাউয়া রে,
পেয়ারা গাছে পেয়ারা গাছের পাতা ঝরে রে
ওরে আমার ঝরা পাতা, পাতাঝরা রে ।।
.......................................................................................................
ভাবসম্প্রসারণ : মুজিব মেহদী
এই লেখায় গোয়া মারামারির মধ্যে এই নিহিত বার্তাটাকে মাত্র খুঁজে পাই যে বড়োরা ছোটদের সুযোগ পাইলে গোয়া মারে। এখানে বড়োরা ও ছোটরা কথাটা বহুঅর্থে নিতে হবে।
হাফপ্যান্ট পরে খেলাধুলার বয়সে দেখেছি ছেলেপুলেরা এরকম ধাঁচের বাক্য বলে আর লাফায়। আমিও বলি নি কি? এমনকি ঝগড়াঝাটি করে ক্ষণসংঘ ভেঙে ঘরে ফিরে যাবার বেলায় 'দোরা কাউয়া' আর 'পাতি কাকের' স্থলে অন্য নাম ব্যবহার করে 'গোয়া মারে'ও বলতে শুনেছি। তো এসব বাক্য একখানে জড়ো কইরা রাখলেই কবিতা হয় নাকি?
ব্রাত্য রাইসুর এই লেখাটাকে আমার কবিতাই মনে হয় না। তো যে/যাঁরা এই লেখাটাকে শূন্য দশকে এ যাবৎ যত কবিতা লেখা হয়েছে তার চাইতে ভালো কবিতা বলে দাবি করেন, তাঁরা এই লেখার মেরিটটা কোথায় তা একটু খোলাসা করলে পারেন। উল্লেখ্য, 'গোয়া মারে' শব্দবন্ধকে আমি অশ্লীল মনে করি না।
Click This Link
..............................................................................................................
পাঠকবৃন্দ, আপনেরাও এই অজর কবিতাখানার ভাবসমাপ্রসারণ করিয়া অশেষ নেকি হাসেল করিতে পারেন। দশে দশ পাইবেন। বিফলে মুল্য ফেরত।
-
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৩:২০