খেলাঘর
--তৌফির হাসান উর রাকিব
প্রচণ্ড দাবদাহ একটু একটু করে যেন সবার জীবনীশক্তি শুষে নিচ্ছে। কি মানুষ, কি পশু-পাখি, সকলেরই প্রাণ ওষ্ঠাগত। কুকুরগুলো এখানে ওখানে বসে লম্বা জিভ বের করে হাঁপায়। গরু ছাগলগুলো ছায়ায় দাড়িয়ে জাবর কাটে, মাঠে চরতে যায়না! গিয়েই বা কি হবে? পুরো মাঠ জুড়ে এতটুকু ঘাসও কি কোথাও আছে? সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেটুকু বাকি ছিল, সেটুকু তো খাওয়া শেষ বহু আগেই। বিস্তীর্ণ জমির বুকে, এখানে ওখানে অজস্র ফাটল। সেই ফাটল দিয়ে একটু একটু করে প্রতিদিন বাস্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে জমির অশ্রুজল! অভিমানে মাটি দিনকে দিন আরও বেশি রুক্ষ হচ্ছে। শুকিয়ে গেছে বেশিরভাগ জলাশয়। আর কয়দিন পর খাওয়ার পানিরই আকাল পড়বে কিনা কে জানে!
একটুখানি বৃষ্টির প্রত্যাশায়, গায়ে কাদা মেখে, আল্লাহ্ মেঘ দে পানি দে বলে বিলাপ করে ফিরে ছেলে ছোকরার দল। উঠোনে উঠোনে গড়াগড়ি খায়। কিন্তু সকল কিছুই বৃথা যায়, একটুকরো মেঘের দেখাও মিলে না আকাশে! বড় অকালে এসেছে এবার খরা। কবে যে কাটবে, একমাত্র আল্লাহ্ই শুধু বলতে পারে।
রুক্ষ খেতের নগ্ন আলের উপর দিয়ে ছোট ছোট কদমে এগিয়ে আসছে হারান মিয়া। গামছাটা মাথায় দিয়ে প্রখর রোদ থেকে একটুখানি আড়াল পাবার বৃথা চেষ্টা! এদিকে যে উদাম শরীর দগ্ধ হচ্ছে, সেদিকে যেন কোন ভ্রুক্ষেপই নেই তার! দু-কাধ রীতিমত ঝুলে পড়েছে তার হতাশায়। দিনটা ভাল যাচ্ছে না তার, কিছুতেই ভাল যাচ্ছে না! আরও যে কি আছে আজ কপালে, কে জানে!
চৌধুরী সাহেবের ছেলের সাথে অনেকক্ষণ বচসা করে এসেছে হারান। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি, তর্কাতর্কির পরও সিদ্ধান্ত বদলায়নি ছোট চৌধুরী! দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়েই যে যার ঘরে ফিরেছে কৃষকের দল। হারানের মত তারাও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে অদৃষ্টের লিখন।
ব্যাপার আর কিছুই নয়, ফসলের ভাগ। গেল বছর বন্যায় গোটা এলাকা তলিয়ে গিয়েছিল, ফসল ঘরে তুলতে পারেনি কেউই। হারানের মত বর্গা চাষিরা হারিয়েছিল তাদের সর্বস্ব। কঠোর পরিশ্রম করে জমির বুকে সোনা ফলিয়েছিল তারা। কিন্তু সেই সোনা ঘরে তুলবার সুযোগ দেবেনা সর্বগ্রাসী বন্যা, কে ই বা ভাবতে পেরেছিল? সকলের অবস্থা বুঝতে পেরে সেবার আর ফসলের অর্ধেক পাওনা আদায় করতে আসেন নি চৌধুরী সাহেব। সবাইকে নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। উল্টো নিজের মজুত থেকে সবাইকে ধার হিসেবে ফসলের বীজও দিয়েছিলেন। আল্লাহ্র দেয়া বন্যার বিরুদ্ধে কারই বা কি করার আছে? তাই ধার দেনা করে কোনমতে বছরটা কাটিয়েছে সবাই। ভেবেছিল এবার ফসল উঠলে সব শোধ করে দেয়া যাবে। কিন্তু কপালের লিখন, না যায় খণ্ডন! এবারও প্রচণ্ড খরার জন্য ফসল ফলাতে পারেনি কেউ। সেচ যে দেবে, সেই উপায়ও নেই! পানি ই তো নেই খালে বিলে, দেবে কোত্থেকে?
তাই সবাই মিলে গিয়েছিল চৌধুরীদের কাছারিতে। ভেবেছিল, চৌধুরী সাহেব নিশ্চয়ই একটা পানির পাম্প বসিয়ে দেবেন, তাহলেই কৃত্রিম সেচ দিয়ে ফসল ফলানো যাবে। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি! দেশেই নেই চৌধুরী সাহেব, মক্কায় হজ্ব করতে গেছেন।
ছোট চৌধুরী কিছুতেই পাম্প বসাতে রাজী হলনা। এটা নিয়ে তর্ক করতে গেল, হারান মিয়া সহ আরও কয়েকজন। বারবার বলতে লাগল, ছোট চৌধুরী তার বাবার মত উদার হয়নি! এতে ছোট চৌধুরী ভীষণ রেগে গেল। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে উল্টো গতবছরের বীজের টাকা ফেরত চেয়ে বসল! তার এক কথা, ফসল হোক বা না হোক, এটা তো তাদের দেখার বিষয় না! তাদের জমি দেয়ার কথা ছিল, জমি দিয়েছে। সেই সাথে ফসল ফলানোর জন্য বীজও দিয়েছে। এখন এগুলো দিয়ে কৃষক ফসল ফলাবে, নাকি কি করবে, সেটা কৃষকের ব্যাপার! তারা তো আর জমি নিয়ে যায় নি, সারা বছর জমিতো কৃষকের কাছেই ছিল! কোন কারনে ফসল না ফললে, তার দায় কি জমির মালিকের?
ভালকরে শাসিয়ে দিল, এই টাকা আগামী দুই মাসের মধ্যে শোধ না করলে, সামনের বছর থেকে আর কাউকে একটুকরো জমিও দেয়া হবে না! অর্থই যদি না আসে, তাহলে আর শুধু শুধু জমিকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি?
শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছে সবাই! নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে ছোট চৌধুরীকে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি, সিদ্ধান্ত থেকে এক চুল নড়ানো যায়নি তাকে!
ঘরের দাওয়ায় এসে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল হারান। হারানের বউ সখিনা, একবার ফিরে তাকিয়েই ব্যাপার কিছুটা আঁচ করতে পারল, তাই মুখে কিছু বলল না। ভাবলেশহীন দৃষ্টি মেলে বেড়ার ফোঁকর দিয়ে বাড়ির সামনের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে রইল হারান মিয়া। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। ঘরে একমুঠো চালও নেই। আনবে কোত্থেকে?
এতদিন শুধু খুদ ভেঙ্গে জাউ রেধে খেয়েছে ওরা। গতকাল তাও ফুরিয়ে গেছে। অভুক্ত বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকানো যায়না। শুকনো ফুলের মতই নেতিয়ে পড়েছে ওরা। অথচ এই কিছুদিন আগেও নতুন কুঁড়ির মতই ঝলমল করে ঘুরে বেড়াতো।
হারান মিয়া শুনতে পায়, সখিনার কাছে বারবার খাবার চাচ্ছে বাচ্চারা। অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল সখিনা, তারপর আর সহ্য করতে না পেরে বাচ্চাদের গালে প্রচণ্ড শব্দে চড় কষায় সে! সখিনার এই রাগের কারন আর কিছু নয়, সীমাবদ্ধতা! ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে দুই ভাইবোন।
হারান একবার ফিরে তাকায়, তারপর নিরবে উঠে যায় সেখান থেকে। হাটতে থাকে পুকুর ঘাটের দিকে, জোহরের নামাজটা পড়ে নেবে। ওযু করতে করতে হঠাৎই মনটা বিষিয়ে ওঠে তার! কখনও খোদাকে ভুলে থাকেনি সে, সাধ্যমত ডেকে গেছে সবসময়। বিনিময়ে কি পেয়েছে খোদার কাছ থেকে? অথচ খোদাকে এক ওয়াক্ত না ডেকেও দিব্যি সুখে আছে কত শত মানুষ! এ কোন আজব খেলা খেলছে খোদা হারানের সাথে? কবে ভাঙ্গবে এ খেলাঘর!
এই যে চৌধুরী সাহেব এবার হজ্বে গেল, হজ্বে গেলেই তো সব গুনাহ মাফ! বড়লোকদের এ কি সুবিধা দিয়ে রেখেছেন তিনি? সারাজীবন ইচ্ছামত গুনাহ করবে, আর শেষ বয়সে টাকা খরচ করে হজ্বে যাবে! ব্যাস, হিসাব পরিষ্কার! দুনিয়াতেও সুখ, মরলেও সুখ! আর গরিবেরা? পদে পদে হোঁচট খাবে আর খোদাকে ডাকবে, বিনিময়ে আরও অথৈ পানিতে ডুবাবে খোদা তাদের! এ কেমন আজব বিচার?
এসব ভাবতে ভাবতেই ওযু শেষ করে ফিরে এল হারান। বারান্দায় হোগলা বিছিয়ে নামাজ পড়ল। সালাম ফেরাতেই ভিতর থেকে আবার ভেসে এল শুভ আর সাথীর কান্নার আওয়াজ! সখিনা নিশ্চয়ই আবার মেরেছে ওদের। অতটুকুন বাচ্চাগুলো আর কতক্ষন ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করবে? বিরক্ত তো করবেই। দুহাত তুলে খোদার কাছে ফরিয়াদ জানায় হারান, রক্ষা কর মাবুদ, দয়া কর!
আজকের দিনে দ্বিতীয়বার মার খেয়ে অভিমানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল দু-ভাইবোন। পিছনের আমতলায় গিয়ে ইচ্ছেমত অনেকক্ষণ ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। ওদের একেক ফোটা চোখের পানি মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে কেঁপে ওঠছে গোটা পৃথিবী! মাথার উপর আমগাছটা ছাড়া আর কে কে সেই কান্নায় কেঁদেছিল, কে জানে!
একসময় কান্নার ঝড় থামলে, শুভ চোখ মুছতে মুছতে বলে, “পাকঘর থাইকা ছোড জালডা আনতে পারবি বইন?”
কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছিল সাথীর পিঠ। হাত দিয়ে চোখদুটো মুছে নিয়ে আস্তে আস্তে জবাব দেয়,
: পারুম...
: যা তাইলে। লইয়া আয়। তয় সাবধান কইলাম... মায় যেন না দেহে।
বুঝতে পারে সাথী। এক দৌড়ে বাড়ি যায় সে। লুকিয়ে আগে দেখে নেয় বাবা-মায়ের অবস্থান! দুজনেই ঘরের দাওয়ায় নিশ্চুপ বসে আছে। পা টিপে টিপে রান্নাঘর থেকে ছোট জালটা নেয় ও। ঢেঁকির পাশের দেয়ালে একটা গজালে ঝুলানো ছিল জালটা। চোখের পলকে ভাইয়ের কাছে ফিরে যায় সাথী। গোপন কিছু করতে পারার আনন্দে ঝলমল করে ওঠে শিশু দুটির মুখ। ওদের এখন দেখলে কে বলবে, একটু আগেও কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিল ওরা!
জালটা ছোট, দু একজায়গায় ছেড়া। হাতলের কাছটায় একটা কাল রঙের কাপড় দিয়ে তালি দেয়া। অনেক ছোট মাছই এই জালের ফাঁকফোকর দিয়ে পালিয়ে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা পেয়েই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল দু-ভাইবোন। বিপুল উৎসাহে মাছ ধরতে চলল। কোত্থেকে একটা পলিথিন ব্যাগ জোগাড় করেছে শুভ, মাছ পেলে এতে রাখবে!
রেল লাইনটা পার হয়ে একটু সামনে গেলেই হাতের বাদিকে পরপর তিনটা ডোবামত গর্ত আছে। তার একটায় এখনও কিছুটা পানি রয়ে গেছে। ওটাতে নেমে প্রথমেই নিচ থেকে কাদা তুলে চারপাশের ছোট গর্তগুলো বন্ধ করে দিল শুভ, যাতে সেচে ফেলা পানি আবার ডোবায় ফিরতে না পারে। তারপর ছোট ছোট হাতে পানি সেচতে লাগল, আর সাথী জালটা খাড়া করে ধরে রইল। ধরা পড়ার ভয় না থাকলে ঘর থেকে পানি সেচার জন্য অন্তত একটা বাটি আনা যেত। খালি হাত দিয়ে একবারে কতটুকুই বা পানি সেচা যায়?
মাছ ধরতে ধরতে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ল। ওরা কল্পনাও করতে পারেনি যে এতগুলো মাছ পাওয়া যাবে। আশেপাশের সব পানি শুকিয়ে যাওয়ায়, মাছগুলো সব এসে ভিড় করেছিল ছোট্ট ডোবাটায়! শুভর আনা পলিথিন ব্যাগ ভর্তি করার পরও আরও মাছ রয়ে গেল। সেগুলো জালটাতে ভাল করে জড়িয়ে নিল। একেকজন তখন কাদায় এতটাই মাখামাখি যে, চেহারা দেখলে ভুত পালাতেও দিশা পাবে না!
খুশির চোটে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি ফিরে চলল ওরা। আজ বহুদিন পর মাছ দিয়ে ভরপেট ভাত খেতে পারবে। ভরপেট খাবারের যে কি আনন্দ, যারা কোনদিন অভুক্ত থাকেনি, তারা কখনও তা বুঝবে না!
বাড়ির কাছাকাছি এসে আকস্মাৎ থমকে দাঁড়াল শুভ। ভাইকে দাড়াতে দেখে সাথীও দাড়াতে বাধ্য হল।
: কি হইল ভাই?
: ঘরে ত চাইল নাইরে বইন। মাছ কিতা দিয়া খাইবি?
উচ্ছল মুখটা মুহূর্তেই হাড়ির তলার মত হয়ে গেল সাথীর! ভাই ঠিক বলেছে, ঘরে চাল নেই। মাছ নিয়ে গিয়েও কোন লাভ হবে না। খালি মাছ কি খাওয়া যায়? নাকি খেতে ভাল লাগবে?
হঠাৎ চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল শুভর। দেখে রীতিমত অবাক হয় সাথী, ভাই এত খুশি হল কেন? ভাইয়ের মনে কি কোন বুদ্ধি এসেছে?
: চল মাছগুলান বাজারে নিয়া বেচি। হেরপর হেই টেহা দিয়া চাইল ডাইল কিনুম...
সাথী তৎক্ষনাত রাজী হয়ে যায়, ভাইয়ের মত তার মুখও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারপর কাদামাখা শরীর নিয়েই অদূরের বাজারে রওনা হয় দু-ভাইবোন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে, বাজারে মাছ বিক্রি বলতে গেলে একেবারে শেষের দিকে। মাত্র দুএকজন বিক্রেতা সারাদিনের অবিক্রীত কিছু পচা মাছ নিয়ে মুখ ভার করে বসে আছে। আর একটু পরপর হাতের গামছা দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। অন্যদের দেখাদেখি শুভও নিজেদের মাছগুলো ছোট ছোট ভাগে সাজায়। বাজারের পাশের বাগান থেকে দুটো কলাপাতা কেটে এনেছে সাথী। সেগুলোকেই ডালা বানিয়ে মাছ বিক্রি করতে বসে যায় শুভ। একটু দূরে দাড়িয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসে সাথী, তার ভাইকে দেখতে একদম কাদার ভুতের মত লাগছে। নিজের চেহারা যে এই মুহূর্তে ভাইয়ের চেয়েও ভয়ংকর, তাতো আর সে জানেনা!
শেষ বিকেলে তাজা মাছ পাওয়া দায়! তাই তাজা পেয়ে লোকজন ভিড় করতে থাকে শুভর কলাপাতার ডালার পাশে। ওরা সঠিক দাম জানেনা বুঝতে পেরেও কেউ ঠকায় না ওদের। ন্যায্য দাম দেয় সবাই। নিমেষেই শেষ হয়ে যায় সবগুলো মাছ। অন্য বিক্রেতাদের কালো মুখগুলো আরও খানিকটা কালো হয়! আর শুভ-সাথীর মুখগুলো উজ্জ্বল থেকে উজ্জলতর হয়।
জীবনে এই প্রথম টাকা রোজগার করেছে ওরা। বারবার টাকাগুলো গোনে, আর বোনকে দেখায় শুভ।
হারান মিয়া প্রায়ই একটা কথা বলে, “টেকা গোনা সবচাইতে খুশির কাম, যদি টেকা নিজের হয়। আর টেকা গোনা সবচাইতে কষ্টের কাম, যদি টেকা মাইনসের হয়।”
এত কঠিন কথা বোঝেনা ওরা। ওরা শুধু বোঝে, টাকা থাকলে মন ভাল থাকে। টাকা থাকলে সুখ থাকে। কারন, টাকা দিয়ে খাবার কেনা যায়!
চাল ডাল নিয়ে ওরা যখন বাড়িতে পৌঁছল, তখন সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে। গোধূলির রক্তিম আভায় সবকিছুই যেন অপার্থিব আর বড় বেশি রহস্যময়! হারান মিয়া তখনও ঘরের দাওয়ায় ঠায় বসা! সখিনা ঘরের ভিতর টুকটাক কাজে ব্যাস্ত। খুশিতে চিৎকার করতে করতে বাড়িতে ঢুকে ওরা। ঢুকেই বিমর্ষ বাবাকে দেখে থমকে দাড়ায়। হাতের জিনিসগুলো পিছনে আড়াল করবার চেষ্টা করে। ভাবে, বাবাকে খাবারগুলো দেখিয়ে চমকে দেবে। তখন কি আর বাবা এত মন খারাপ করে থাকবে?
কিন্তু হারান মিয়ার চোখ ফাঁকি দিতে পারেনা ওরা। ঠিকই দেখেছে হারান, কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে বাচ্চারা। কি যেন সন্দেহ হয় তার মনে! দৌড়ে ছুটে আসে বাচ্চাদের কাছে। জোর করে বের করে আনে লুকিয়ে রাখা খাবারগুলো। ধরা পড়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে শুভ আর সাথী। ধুর ছাই, বাবা তো দেখেই ফেলল। একদম পুরো মজাটাই শেষ!
ওদের হাতে চাল ডাল দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় হারান। চট করে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় তার কাছে। হ্যাঁ, তার সন্দেহই ঠিক। চুরি করেছে ওরা, নিশ্চয়ই চুরি করেছে। খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বাজারের কোন দোকান থেকে চুরি করেছে ওগুলো। নিশ্চয়ই দোকানের পিছনের নালায় লুকিয়ে বসেছিল। দোকানীর একটুখানি বেখেয়ালের সুযোগে চাল ডাল তুলে নিয়ে ছুটে চলে এসেছে। ওইতো গায়ে মুখে কাদা লেগে আছে ওদের!
আর নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা হারান মিয়া। পাগলের মত দৌড়ে গিয়ে গোয়ালঘর থেকে মোটা একটা বেত নিয়ে আসে! জমি চাষের সময় এটা দিয়ে হালের বলদগুলোকে শায়েস্তা করত ও। বেয়াড়া গরুগুলোও এই বেতের বাড়ি খেয়ে একদম সোজা হয়ে যেত। সেই বেতের বাড়ি সপাং সপাং করে পরতে লাগল শুভ আর সাথীর সারা শরীরে! ব্যাথার তীব্রতায় বাইন মাছের মত মোচড় খেতে লাগল ক্ষুদ্র দুটো শরীর। প্রচণ্ড ক্রোধে বারবার চিৎকার করে বলতে লাগল হারান, “ক্যান করলি এই কাম? ক্যান করলি তোরা?”
বাচ্চাদের চিৎকারে ভিতর থেকে ছুটে এল সখিনা। কিন্তু স্বামীর এমন রুদ্রমূর্তি দেখে, এগুনোর সাহস করল না আর। প্রচণ্ড মারের চোটে কি যেন বলতে চেয়েও বলতে পারল না বাচ্চা দুটো।
অবশেষে যখন হারান মিয়ার বেত থামল, ততক্ষনে মাটিতে গড়াগড়ি করছে ওরা। হাতের চাল ডাল কখন খসে পড়েছে বলতেও পারবেনা কেউ। থলে ছিড়ে গিয়ে সারা উঠোনে ছড়িয়ে পড়েছে।
বেতটা ফেলে ঘরে গিয়ে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল হারান মিয়া। অভাবে ফেলে তার এত আদরের ছেলেমেয়েগুলোকে চোর বানাল! সে এখন চোরের বাবা? আর কি বাকি রইল এ জীবনে? হারানের সাথে সাথে সখিনাও অঝোরে কাঁদতে লাগল!
মাটি থেকে ততক্ষণে উঠে পড়েছে শুভ। বোনকেও কোন রকমে টেনে তুলল ও। হাত ধরে নিয়ে গেল বাড়ির পিছনের আমতলায়। বেতের বাড়ির জায়গাগুলো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে তার। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, একদম হাতই দেয়া যায় না! অভুক্ত শরীরে অমন মার সহ্য হবে কেমন করে?
নিজের শার্টটা খুলে পানিতে ভিজিয়ে নিল শুভ। তারপর আস্তে আস্তে বোনের শরীর মুছে দিতে লাগল। প্রচণ্ড অভিমানে বুক ফেটে কান্না আসছে তার।
ফোঁপাতে ফোঁপাতে হঠাৎ বলে উঠল সাথী, “ভাই। খুব খিদা লাগছে। খাওনের কষ্ট থাইকা একবারে বাঁচনের কোন উপায় নাই?”
চমকে ওঠে শুভ। বোনের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হয় তার। মুখে কিছু বলে না, চুপচাপ কি যেন ভাবে! তারপর বোনের হাত ধরে হাটতে থাকে। দুপুরে মাছ ধরার সেই ডোবাটার পাশের রেললাইনে এসে থেমে যায় শুভ। বোনকে দুহাতে জড়িয়ে শক্ত হয়ে বসে থাকে লাইনের উপর। জ্বর আর ব্যাথার তীব্রতায়, আর সচেতন থাকতে পারে না সাথী, ভাইয়ের বুকে ঘুমিয়ে পড়ে।
অনেকক্ষণ পর দূরে আগমনী ট্রেইনের হুইসেল শোনা যায়। রক্তচক্ষু মেলে অন্ধকারে তাকিয়ে অপেক্ষায় থাকে শুভ, একটু পরেই সব জ্বালা থেকে মুক্তি মিলবে!
----------------------------০-------------------------------
২০১২ এর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত "এক" নামক বইটি থেকে সংগৃহীত!