================
বহুদিনের পুরনো প্রশ্ন- মুসলিম বিশ্ব কেন পিছিয়ে আছে?
বহু দিনের মুখস্থ উত্তর – ‘ইসলামের কারণে’।
.
প্রাচ্যবিদ, পশ্চিমা নব্য রক্ষনশীল কিংবা ওবামার [১] মত লোকের কাছ থেকে এমন উত্তর আসলে সেটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল অনেকে মুসলিমদের মধ্যেও এমন চিন্তাভাবনা কাজ করে। নিজের মুসলিম পরিচয়কে ঘৃণা করা, হীনমন্যতায় ভোগা মুসলিমদের অনেকেই ঔপনিবেশিক যুগের শুরু থেকে এ প্রশ্নের জবাবে তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের সাথে সুর মিলিয়ে বলে আসছে - ‘ইসলামই হল মূল সমস্যা আর অগ্রগতির একমাত্র উপায় হল ইসলামকে বাদ দেয়া’।
.
তবে পরাজিত মানসিকতার মুসলিমরা এ কথাটা সরাসরি বলে না। তারা একটু ঘুরিয়ে বলে। যেমন এদের কেউ কেউ বলে, “ইসলামের সংস্কার দরকার”, অথবা বলে, “আমাদের উচিৎ পুরনো ফিকহগুলোকে আবার খতিয়ে দেখা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা এবং প্রয়োজন মত নতুন নতুন ইজতিহাদ করা” অথবা তারা বলে “আগেকার আলিমদের মধ্যে নারীবিদ্বেষী প্রবণতা ছিল”।
.
‘ইসলামই সমস্যা’ – এ কথাটা সরাসরি না বলে, মুসলিম মর্ডানিস্টরা এভাবে ঘুরিয়ে বলে। এদের অনেকে সনাতন পদ্ধতিতে শিক্ষিত হয়ে থাকে। পোশাক-আশাকের দিক থেকেও বাহ্যিকভাবে এদের অনেককে দেখে আলিম মনে হয়, যেমন জামালুদ্দিন আফগানী, মুহাম্মাদ আবদুহ, আলি জুমা কিংবা আব্দুল্লাহ বিন বায়্যাহ। সব মর্ডানিস্ট আদনান ইব্রাহিমের মতো সুট-টাই পরে না।
.
ইসলাম, আলিম ও ইলমের প্রতি সাধারন মুসলিমদের মনে থাকা গভীর শ্রদ্ধাবোধকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় পোশাক, শিক্ষা এবং শব্দ ব্যবহার করে এ মর্ডানিস্টরা খুব সহজে তাদের প্রভাবিত করে ফেলে। একারণে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা শুরু থেকেই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ ধরণের আলিমদের ব্যবহার করে আসছে [২]। এবং আজো করছে।
এখন আসুন “পিছিয়ে পড়ার” প্রশ্নটা খতিয়ে দেখা যাক।
নিজেদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য মুসলিমরা যখন ইসলাম ও ইসলামী ঐতিহ্যকে দায়ী করে, তখন কে আসলে লাভবান হয় বলুন তো?
কী? প্রশ্নটা বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে? আচ্ছা তাহলে পৃথিবীর পিছিয়ে পড়া অন্যান্য অঞ্চলগুলোর দিকে একটি তাকানো যাক।
.
সম্প্রতি ভেনেজুয়েলা নিয়ে অনেক খবর আমরা দেখতে পাচ্ছি।
ভেনেজুয়েলার মত দেশগুলো কেন পিছিয়ে আছে? নিউইয়র্ক টাইমসের মত পশ্চিমা লিবারেল বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নের উত্তর দেয় এভাবে –
.
মি. মাদুরোকে (ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট) ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে, এটা বেশকিছু ধরেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। ২০১৩ তে বামপন্থী একনায়ক হুগো শাভেজের স্থলাভিষিক্ত হবার পর থেকে তার অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতি এবং তেলের মূল্য হ্রাস( যেটা ভেনেজুয়েলার আয়ের মূল উৎস) দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলেছে। মাত্রাতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতির কারণে বেতনের টাকা পরিণত হয়েছে একটা অনর্থক, অর্থহীন জিনিসে। লোকজন ক্ষুধা আর চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে আশপাশের দেশগুলোতে।
.
দেখুন, দেখুন! পশ্চিমা দেশগুলো ভেনেজুয়েলার লোকগুলোর জন্য কী দরদটাই না দেখাচ্ছে। তারা কতো চিন্তিত! ভেনেজুয়েলার লোকগুলো না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে! তাদের প্রয়োজনীয় ঔষধ নেই! তারা মাত্রাতিরিক্ত মূদ্রাস্ফীতিতে ভুগছে! আমাদের কিছু একটা করা দরকার! আমাদের উচিৎ ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তন (regime change) সমর্থন করা!! হয়তো আমাদের ভেনেজুয়েলা আক্রমনও করা উচিৎ! এই পরিস্থিতিতে এটাই ভেনেজুয়েলার নিপীড়িত মানুষদের সাহায্য করার একমাত্র মানবিক উপায়!!
.
কিন্তু তারা যা বলে না তা হল - এই ক্ষুধা, ঔষধপথ্যের অভাব আর মাত্রাতিরিক্ত মূদ্রাস্ফীতির মূল কারন হল বছরের পর বছর ধরে ভেনেজুয়েলার উপর চলা অর্থনৈতিক অবরোধ। বছরের পর বছর ধরে একটা দেশের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হলে, সেই দেশের মানুষ অর্থনৈতিক সংকটে তো পড়বেই, তাই না? আপনি প্রথমে অর্থনৈতিক অবরোধ দেবেন। তারপর সংকট দেখা দিলে নিজের অপছন্দের রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে সরকার পরিবর্তন কিংবা সামরিক অভিযানের কথা বলবেন। খুব মজা না?!
.
নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ অন্যান্য পশ্চিমা মিডীয়া দীর্ঘদিন ধরে এধরনের চক্রাকার যুক্তি ব্যবহার করে সামরিক অভিযান আর সরকার পরিবর্তনের পলিসি সমর্থন করে আসছে।
.
ভেনেজুয়েলাই এ কূটকৌশলের একমাত্র স্বীকার না। ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশকেই এভাবে অ্যামেরিকান ‘মানবতার’ মাধ্যমে নতজানু করা হয়েছে। বিশ্বের এই তথাকথিত ত্রানকর্তা(!) অ্যামেরিকা এসকল পিছিয়ে পড়া দেশকে তাদের অক্ষমতা থেকে এভাবেই রক্ষা করছে! এটাই নাকি একমাত্র পদ্ধতি!
.
TruthDig এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী,
নিউইয়র্ক টাইমসের আর্কাইভের একটা জরিপে দেখা গেছে যে, ল্যাটিন অ্যামেরিকাতে হওয়া অ্যামেরিকা সমর্থিত ১২টা সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদনা পরিষদ ১০টাকেই সমর্থন দিয়েছে। যে দুটো অভ্যুত্থানকে তারা সমর্থন দেয়নি, তার একটি হল ১৯৮৩ সালের গ্র্যানাডা আক্রমন আর ২০০৯ সালে হন্ডুরাসের অভ্যুত্থান। এ দুটি ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান ছিল অস্পষ্ট কিংবা অনিচ্ছুক বিরোধিতার।
.
সিআইএ, অ্যামেরিকার সেনাবাহিনী আর এদের সাথে যুক্ত কর্পোরেশানগুলো কেন বারবার ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশগুলোকে টার্গেট করছে জানেন? কারণ এ দেশগুলো অ্যামেরিকান পুঁজিবাদ ও তাদের কৌশলগত উদ্দেশ্যের জন্য হুমকি। এই কারনেই বারবার এ দেশগুলোতে সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে। দেশগুলো অগনতান্ত্রিক হবার কারণে না। তাই নিউইয়র্ক টাইমসের কিছু কিছু কথা সত্য হলেও, বাস্তবে যা হচ্ছে তার কোন গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা এগুলো থেকে পাওয়া যায় না।
.
সংক্ষেপে এটাই অ্যামেরিকার কৌশল। এভাবেই তারা কাজ করে। তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ। কাকে দিয়ে অ্যামেরিকার স্বার্থ পূরণ হবে? কারা অ্যামেরিকা এবং অ্যামেরিকান কর্পোরেশানগুলোর কাছে সস্তায় মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদগুলো বিক্রি করবে? অধিকাংশ দেশের সরকারগুলো সোৎসাহে, সাগ্রহে অ্যামেরিকাকে স্বাগতম জানায়। তবে সমসময় কিছু না কিছু লোক থাকে যারা ঝামেলা করে। অ্যামেরিকা এই ঝামেলার সমাধান কীভাবে করে? নিষ্ঠুর, কঠোর অর্থনৈতিম নিষেধাজ্ঞা আর অবরোধের মাধ্যমে। যেগুলোর কারণে জীবন দিতে হয় একটা বিরাট জনগোষ্ঠীকে। ম্যাডেলিন অলব্রাইট বলেছিল, অ্যামেরিকার চাপানো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ৫ লক্ষ ইরাকী শিশুর মৃত্যু ‘দরকারী’ ছিল – মনে আছে?
.
একদিকে অ্যামেরিকার সরকার এসব করে বেড়ায়, অন্যদিকে অ্যামেরিকান মিডিয়া রিপোর্ট করে, “দেখুন, এই দুস্থ লোকগুলো মারা যাচ্ছে! এই ক্ষুধার্থ শিশুদের জন্য আমাদের কিছু একটা করা উচিৎ!”
তবে হ্যা, যখন অ্যামেরিকার বন্ধুভাবপন্ন কোন স্বৈরশাসকের দুঃশাসনের কারনে জনদুর্ভোগ তৈরী হয়, তখন আর তাদের কোন মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায় না, কোন পদক্ষেপও নিতে দেখা যায় না।
.
অতএব, এই পিছিয়ে পড়াদের তালিকায় মুসলিম বিশ্ব একা না। উত্তর অ্যামেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের অনেক অঞ্চলই একই রকম অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার। তাহলে ইসলামের ওপরই কেন বারবার অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হবে? কেন ইসলামিক ঐতিহ্য এবং সোনালি যুগের আলিমদের দোষারোপ করা হবে? এটার কোন অর্থ হয়?
.
আসলে কী ঘটছে, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। অ্যামেরিকা পুরো পৃথিবীকে জিম্মি করে রেখেছে। দেশগুলোর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। আর এ অবস্থায় কিছুদিন থাকার পর জিম্মি তার অপহরনকারীকে ভালোবাসতে শুরু করছে।
.
যখনই দেখবেন মুসলিম বিশ্বের পিছিয়ে পড়ার জন্য কেউ ইসলামকে দায়ী করছে, পিছিয়ে পড়া কাফির দেশগুলোর অবস্থা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিবেন। সেই দেশগুলোর কেন এ অবস্থা? তারা তো মুসলিম না, তারা তো ইসলাম মানে না।
.
পুরো পৃথিবীর মধ্যে অল্প কিছু পশ্চিমা দেশই কেবল অনাহার আর দারিদ্র্য থেকে বেচে থাকার ম্যাজিক ফর্মুলা আবিস্কার করেছে? আর বিশ্বের বাকি ৯০% মানুষ একেবারে অথর্ব??
নাকি মিডিয়ার টেনে দেয়া পর্দার আড়ালে অন্য কিছু ঘটছে?
.
-----
[১] Click This Link
[২] https://www.rand.org/pubs/monographs/MG574.html
.
মূল - ড্যানিয়েল হাকিকাতজু
( সত্যকথন )
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০৫