শহরে এসেছিলো নতুন গল্পওয়ালা। সে সবাইকে ধরে ধরে গল্প শোনাতো। নিতান্তই সাধারণ সেই গল্প, সেই গল্পে ছিলো আকাশ ছিলো মেঘ, ছিলো শিশির ভেঁজা ঘাস আর ছিলো বিশাল বিশাল পাইন গাছ। সাথে ছিলো পাহাড়ের গল্প নদীর গল্প। মানুষ তাকে বড় ভালোবাসতো। গল্প ওয়ালা ছিলো পথিক কিন্তু মানুষের ভালোবাসাতে রয়ে গেলো সেখানে বহুদিন। গল্প বলে বলে বেশ চলে যায় তার জীবন।
কিন্তু তা আর সইলো না সেখানের লেখক সমাজের। লেখক-কবিরা যেখানে পড়াশোনা করে লেখক হয়েছে, বই বের করেছে তাদের কিনা বিন্দুমাত্র সম্মান নেই! এ কেমন রীতিনীতি। এ তো মানা যায় না। কোথাকার কোন লোক এসে জেঁকে বসেছে আর যাচ্ছে টাচ্ছে না। কি সমস্যা। লুকিয়ে লুকিয়ে তারা মিটিং করলো, কি করে তাকে ধরাশায়ী করা যায় তাও ভাবনা চিন্তা হলো।
উল্টোদিকে গল্পওয়ালার নেই কোনো চিন্তা, সে ফুলের গল্প বাতাসের গল্প বলতো, বলতো নিছক পোকার গল্প, মাছির গল্প। মানুষ তাও ও আনন্দ পেতো! কি যন্ত্রণা !!! লেখক গুলো ঠিক করলো রাজার কাছে তার নামে একটা খারাপ কথা বলে দিলে কি হয়?!!! বলেও দিলো উল্টোপাল্টা নানান কথা। লেখক-কবি-মন্ত্রী-উজির-নাজির সবই তো এক দলের হয়ে গেছিলো সেই কবে থেকেই। রাজা বিশ্বাস করে ফেললো সেই সব কথা। শহরের ছেলে বুড়োরা কেঁদে চোখ ভাসালো। কত আন্দোলন হলো কত কি হলো। কিছুতেই কিছু হলো না। গর্দানের আদেশ এসে পড়লো গল্পওয়ালার।
গল্পওয়ালার এক প্রেমিকা ছিলো শহরে কেউ জানতো না। সে কেঁদে কেঁদে বললো চলো পালিয়ে যাই। উওরে সে জানালো সে পালাবে না। সে পালালে শহরবাসীদের যে অপমান হবে! তার গল্পে তো কেউ কখনো পালায়নি। গর্দান হোক আমার, দেখো আমার গল্পে যেভাবে গাছ ভালোবেসেছিলো শিশিরভেঁজা ঘাসের মাঠকে আমিও তোমাকে ঠিক তেমনি ভালোবেসেছি। গাছ বার বার ভালোবেসে তাকে দিয়েছিলো তার ঝড়ে পড়া পাতা আমিও বার বার ফিরে আসবো আমার গল্প হয়ে। চোখ মুছে বিদায় নিলো তারা।
গর্দানের দিন সেই লেখক সমাজের আনন্দে তর সইছিলো না। মৃদু হাসছিলো গল্পওয়ালা। তাকে জল্লাদ জিজ্ঞেস করলো হাসছ যে বড়! উত্তরে গল্প ওয়ালা জানালো "আমি কোনোদিন বই লিখি নি জানো তো তাই না? আমি শুধু গল্প ফেরী করে বেড়িয়েছি। আমি ছিলাম চলমান গল্প। আজ আমার ও বই হবে।" জল্লাদ ভাবলো কি সব আবোল তাবোল কথারে বাবা। মৃত্যু ভয়ে বেচাড়া কি বলছে এসব। জল্লাদ ও পছন্দ করতো যে তাকে। তার বাচ্চারা বড় ভালোবাসতো গল্পওয়ালাকে।
এরপর সেই সময় এসে পৌছুলো। জল্লাদ বললো, "ভাই মনে কিছু নিও না। আমি নিজ ইচ্ছেয় কিছু করছি না। আমার করতে হচ্ছে!" গল্পওয়ালা বলে, "সমস্যা নেই। করে ফেল তাড়াতাড়ি। আর যে তর সইছে না।" জল্লাদ মোক্ষম এক কোপ বসালো তার ধারালো অস্ত্র দিয়ে, কিন্তু এ কি!!!!! এ যে অবাক কান্ড। কোনো রক্ত নেই যে!! উপস্থিত সবার চোখ বড় বড় হয়ে পড়লো। রক্তের বদলে তার ধর থেকে বের হচ্ছে অসংখ্য অক্ষর। অসংখ্য অসংখ্য অক্ষর। যত টা অক্ষর কল্পনা করা যায় তার থেকেও বেশি। ভেসে গেলো রাজপ্রাসাদ, ভেসে গেলো রাস্তা। গল্পওয়ালা কত গল্প জমা রেখেছিলো তার শরীরে তা তো কেউ জানে নি, কত জীবন সে ঘুরে বেড়িয়েছে তাও তো কেউ জানতো না। অক্ষরগুলো ভেসে ভেসে জমা হতে থাকলো সাদা কাগজে। এভাবে শেষ হয়ে গেলো শহরের যত কাগজ সব। সেই লেখক উজির নাজির ওরা কিছুই করতে পারলো না, কি করে করবে বলো? সৈন্য-সামন্ত ?? ওরা তো আগেই গল্পকারের বই পড়ছে। শহরের সবাই সেদিন গল্পওয়ালার বই পড়েছিলো। রাজপ্রাসাদ অচল হয়ে গেলো, কারণ যত চাকর বাকর দাসী সৈন্য সবাই বই পড়ছিলো সব কাজ বাদ দিয়ে। লেখক উজির রা রাগে মাথা চাপড়ালো, রাজা হতাশা পোষন করলেন,ভাবলেন বিশাল ভুল হয়ে গেলো যে।
কেউ টের পেলো না, একজন মানুষ ঘর ছেড়েছিলো সেদিন। সে ছিলো সেই গল্পওয়ালার প্রেমিকা। সেও সেই গল্পগুলো আবার বিলি করে বেড়াতে লাগলো এই পৃথিবীর শহরে শহরে। এভাবে গল্পকারের গল্পগুলো আজীবন চলমান হয়ে রইলো এখানে সেখানে ওখানে।