মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ সম্পাদিত মাসিক আলকাউসার (alkawsar.com) মার্চ ২০০৮ প্রিন্ট এডিসন এর ’প্রচলিত ভুল’ বিভাগ থেকে।
-----------------------
সর্বপ্রথম একটি দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, বহু মানুষ সফর মাসের শেষ বুধবারকে একটি বিশেষ দিন মনে করে এবং এতে বিশেষ আমল আছে বলে মনে করে। পরে মনে হল, এ ধরনের ভিত্তিহীন রসম-রেওয়াজের উল্লেখ ’মকসুদুল মোমেনিন’ জাতীয় পুস্তক-পুস্তিকায় থাকতে পারে। দেখলাম, ’মকসুদুল মোমেনিন’ ও বার চাঁদের ফজিলত বিষয়ক যেসব অনির্ভরযোগ্য পুস্তক-পুস্তিকা এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে প্রচলিত তাতে এই বিষয়টি রয়েছে। যদি ঐ দৈনিকে দিবসটি সম্পর্কে এভাবে মাহাত্ম্য ও করণীয়ের বয়ান না থাকত তবে সম্ভবত প্রচলিত ভুল শিরোনামেও তা উল্লেখ করার উপযুক্ত মনে করতাম না।
খাইরুল কুরুনের হাজার বছরেরও বহু পরে উদ্ভাবিত এই রসমের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারীদের মতামতও এ ভিত্তিহীন বিষয়ের ভিত্তি অন্বেষণে বিভিন্নমুখী। উপরোক্ত দৈনিকটির ২৩ সফর ১৪২৮ হিজরী বুধবারের সংখ্যায় লেখা হয়েছে, ”আজ চান্দ্রমাস সফরের শেষ বুধবার অর্থাৎ আখেরী চাহার শোম্বা। এদিন দুজাহানের সর্দার মহানবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রোগমুক্তির দিন। আর একারণেই এদিন মুসলমানদের জন্য আনন্দময় ও পবিত্র দিন। হাদীসে বর্ণিত আছে এক ইহুদি কবিরাজ রাসূল (সা.) চুল মোবারক নিয়ে জাদুটোনা করেছিল। ফলে মহানবী (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি কিছুদিন মসজিদে যেতে পারেননি। সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি সুস্থতা বোধ করে গোছল করেন এবং দুজন সাহাবীর কাধে ভর করে মসজিদে নববীতে গিয়ে জামাতে নামায আদায় করেন। আলহামদুলিল্লাহ।
রাসূল (সা.)-এর রোগমুক্তিতে খুশি হয়েছিল মুসলিম জাহান। খুশি হয়ে হযরত ওসমান রা. তাঁর নিজ খামারের ৭০ টি উট জবাই করে গরিব-দু:খীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। খুশিতে ...............................”
অন্যদিকে মকসুদুল মোমেনিনে বলা হয়েছে:
’.......................এই গোছলই হুজুরের জীবনের শেষ গোছল ছিল।.........অতএব এইদিনে মুসলমানদের বিশেষভাবে গোছলাদি করত: নফল নামায এবং রোযা ইত্যাদি আদায় করত: নবী করিম (দা.) এর রুহের উপর ছওয়াব বখশেষ করা উচিত।’
এরপর এ দিন সম্পর্কে বিভিন্ন করণীয় উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন। যেমনটি ভিত্তিহীন উপরোক্ত উভয় বিবরণ।
১. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এক ইয়াহুদি জাদু করেছিল। এটা ছিল হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে মহররম মাসের প্রথম দিকের ঘটনা। এ যাদুর প্রভাব কতদিন ছিল সে সম্পর্কে দুটি বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় ছয় মাসের কথা এসেছে, অন্য বর্ণনায় এসেছে চল্লিশ দিনের কথা। কিন্তু এ দুই বিবরণে কোন সংঘর্ষ নেই। এক বর্ণনায় পুরো সময়ের কথা এসেছে আর অপর বর্ণনায় শুধু এসেছে ওই সময়টুকুর কথা যাতে যাদুর প্রতিক্রিয়া বেশি ছিল। তবে যাইহোক সুস্থতার তারিখ কোন হিসাব অনুযায়ীই সফরের আখেরী চাহার শোম্বা হতে পারে না। - ফাতহুল বারী ১০/২৩৭; আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া ২/১৫৪; শরহুয যুরকানী ৯/৪৪৬-৪৪৭।
২. জাদুর ঘটনা হাদীস ও সীরাত গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে এসেছে। কিন্তু সেখানে না একথা আছে যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে জামাতে শরীক হতে পারেননি, আর না আছে মুআওয়াযাতাইন (সূরা ফালাক, সূরা নাস) দ্বারা যাদুর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার পর তার গোসলের বয়ান।
৩. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্থতার কারণে খুশি হওয়া কিংবা তার সুস্থতার সংবাদ পড়ে আনন্দিত হওয়া প্রত্যেক মুমিনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য, কিন্তু একথা দাবি করা যে, সাহাবায়ে কেরাম বা পরবর্তী যুগের মনীষীগণ সে খুশি প্রকাশের জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, জাহালাত ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা এ দাবির সপক্ষে দুর্বলতম কোন দলিলও বিদ্যমান নেই।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অনেক মুসিবত এসেছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে নাজাত দিয়েছেন। তায়েফ ও অহুদে আহত হয়েছেন আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি, আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। তাঁর সুস্থতা লাভের এইসব আনন্দের স্মৃতিগুলোতে আনন্দ উদযাপনের কোন নিয়ম আছে কি? তাহলে আখেরী চাহার শোম্বা, যার কোন ভিত্তিই নেই, তা কিভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে?
৪. কোন দিনকে বিশেষ ফযীলতের মনে করা; কিংবা বিশেষ কোন আমল তাতে বিধিবদ্ধ রয়েছে এমন কথা বলা; কিংবা তাকে ধর্মীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা এই সবগুলো হচ্ছে মুসলমানদের জন্য শরীয়তের বিধানের অন্তর্ভুক্ত। অতএব এগুলো শরয়ী দলীল ছাড়া শুধু মনগড়া যুক্তির ভিত্তিতে সাব্যস্ত করা যায় না। এটা শরীয়তের একটা অবিসংবাদিত মূলনীতি। এজন্য উপরোক্ত তথ্য ইতিহাসের দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ হলেও এ দিবসকে ঘিরে ওইসব রসম-রেওয়াজ জারী করার কোনো বৈধতা হয় না।
৫. মকসূদুল মোমেনিন পুস্তিকায় যা বলা হয়েছে তা-ও সঠিক নয়। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়েছে সোমবারে। এর চার পাঁচ দিন পূর্বে তাঁর সুস্থতার জন্য যে সাত কুঁয়া থেকে সাত মশক পানি আনা হয়েছিল এবং সুস্থতার জন্য তার দেহ মোবারককে ধৌত করা হয়েছিল তা কি বুধবারের ঘটনা না বৃহস্পতিবারের?
ইবনে হাজার ও ইবনে কাছীর একে বৃহস্পতিবারের ঘটনা বলেছেন। -ফাতহুল বারী ৭/৭৪৮, কিতাবুল মাগাযী ৪৪৪২; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৪/১৯৩; সীরাতুন নবী, শিবলী নুমানী ২/১১৩।
যদি বুধবারের ঘটনা হয়ে থাকে তবে সফর মাসের শেষ বুধবার কিভাবে হচ্ছে। রসমের পৃষ্টপোষকতাকারীগণ সকলে ইন্তেকালের তারিখ বারোই রবীউল আউয়াল বলে থাকেন। সোমবার যদি বারোই রবীউল আউয়াল হয়ে থাকে তাহলে এর পূর্বের বুধবার তো সফর নয়, রবীউল আউয়ালেই হচ্ছে।
তাছাড়া এই তথ্যও সঠিক নয় যে, বুধবারের পর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোসল করেননি। কেননা এরপর একরাত ইশার নামাযের পূর্বে গোসল করার কথা সহীহ হাদীসে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। -সহীহ মুসলিম হাদীস ৪১৮; (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৬৮১ এর সাথে মিলিয়ে পড়–ন – আররাহীকুল মাখতূম, সফীউদ্দীন মোবারকপুরী পৃ ৫২৫)।
আর একথাও ঠিক নয় যে, বুধবারের পর অসুস্থতায় কোনরূপ উন্নতি হয়নি। বরং এরপর আরেকদিন সুস্থবোধ করেছিলেন এবং জোহরের নামাযে শরিক হয়েছিলেন-একথা সহীহ হাদীসে রয়েছে। - সহীহ বুখারী হাদীস নং ৬৬৪, ৬৮০ ও ৬৮১; সহীহ মুসলিম হাদীস ৪১৮; আররাহীকুল মাখতূম পৃ ৫২৬; রাহমাতুল্লিল আলামীন মনসূরপুরী।
সোমবার সকালেও সুস্থবোধ করেছিলেন, যার কারণে আবুবকর সিদ্দীক রা. অনুমতি নিয়ে নিজ ঘরে চলে গিয়েছিলেন। -সীরাতে ইবনে ইসহাক পৃ ৭১১-৭১২; আর রওযুল উনুফ ৭/৫৪৭-৫৪৮।
৬. সারকথা এই যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য এবং তার পবিত্র সীরাত ও সুন্নতের অনুসরণ, তার জীবনাদর্শে আপন জীবন গঠন, তার শরীয়তের প্রচার-প্রসার ইত্যাদি হকসমূহ, যা উম্মতের জন্য অবশ্যপালনীয় এগুলো থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া এবং গাফলতির এই প্রকৃত ব্যাধি সম্পর্কে অসচেতন রাখার জন্য এসব ভিত্তিহীন রসম-রেওয়াজের উৎপত্তি।
আল্লাহ তাআলা উম্মতকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং রসম ও মুনকারাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করুন। আমিন।
৭. ইসলামী শরীয়তে ছুটির যে নীতিমালা রয়েছে সে আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ তারিখের ছুটি থাকা ঠিক নয়।