ভারতবর্ষে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষিত হিন্দুদের অবস্থাটা কিছুটা যেন কনফিউজড । আধুনিক প্রগতিশীল বাঙালি হিন্দুরা প্রায়ই নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিতে চান না বা দিতে লজ্জা পান । তাঁদের অনেকরই বক্তব্য যে তাঁরা কোন ধর্মে বিশ্বাস করেন না এবং বিশ্বাস করতে চানও না । তাঁরা অনেকই বলবেন যে তাঁরা ভারতীয় হিসাবে গর্বিত বা বাঙালি হিসাবে গর্বিত কিন্তু তাঁরা কখনই বলবেন না যে তাঁরা হিন্দু হিসাবে গর্বিত ।
অদ্ভুত ব্যাপার হল আমি যদি নিজেকে একজন হিন্দু বলে পরিচয় দিই তাহলে যেন আমি যেন একজন সাম্প্রদায়িক অথবা বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, এস এস এর বা বজরং দলের দালাল । আর আমি যদি বলি যে আমি কোন ধর্মে বিশ্বাস করি না তাহলেই আমি একজন প্রগতিশীল এবং আধুনিক মানুষ ।
অথচ ভারতে যদি কোন মুসলমান নিজেকে মুসলমান হিসাবে পরিচয় দেন অথবা একজন খ্রীস্টান নিজেকে খ্রীস্টান হিসাবে পরিচয় দেন তাহলে ধরে নেওয়া হয় সেটাই স্বাভাবিক ব্যাপার । এবং কেউই তাঁদের কোন রাজনৈতিক বা অন্য কোন পরিচয় খুঁজতে যায় না । কিন্তু একজন হিন্দু যদি নিজেকে হিন্দু হিসাবে পরিচয় দেন তাহলেই যেন তার যত দোষ ।
অথচ এই প্রগতিশীল হিন্দুরাই জাতপাত দেখে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেন অথবা তাঁদের যদি শিডিউল কাস্ট বা শিডিউল ট্রাইব সার্টিফিকেট থাকে তবে তার উপযোগিতা নিতে তাঁরা পিছপা হন না । এবং কথায় কথায় আফসোস করেন যে কেন শুধু মুসলমানদেরই চারটি বিয়ে করার অধিকার থাকবে ।
এই প্রগতিশীল মানুষদের অনেকরই বক্তব্য হিন্দু ধর্ম বলে কিছু হয় না, যারা আগে সিন্ধুনদের তীরে বসবাস করত তারাই নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিত । হিন্দুধর্মের কোন প্রতিষ্ঠাতা নেই, এতে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী ইত্যাদি ।
কিন্তু তাঁরা ভুলে যান যে হিন্দুধর্ম কখনও কোন মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় নি। যুদ্ধজয় করে কোন দেশের মানুষকে বাধ্য করা হয় নি একে গ্রহন করার জন্য । অথবা সামান্য কিছু খাবারের লোভ দেখিয়ে গরীব মানুষদের রূপান্তরিত করা হয়নি এই ধর্মে ।
বরং হিন্দুরাই অন্য ধর্মের আচার আচরন এবং দেবদেবীকে নিজেদের বলে গ্রহন করেছে । যেমন প্রাচীন বৈদিক আর্যরা আস্তে আস্তে গ্রহন করেছিল শিব ও শক্তিকে । আবার পরবর্তীকালে বুদ্ধকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বিষ্ণুর অবতার বলে ।
হ্যাঁ এটা অবশ্যই মেনে নেওয়া দরকার যে হিন্দুধর্মের ভিতরেও কালক্রমে নানারকমের কুসংস্কার প্রবেশ করেছিল । কিন্তু সেগুলিও ছিল কিছু মানুষের ষড়যন্ত্র । যেমন সতীদাহ প্রথা । শোনা যায় বেদের কিছু শ্লোকের ভুল অর্থকরে সতীদাহ প্রথা চালু করা হয়েছিল । এর আসল উদ্দেশ্য ছিল মহিলাদের সম্পত্তি দখল করা । আবার পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর প্রমান করেছিলেন যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত । আর জাতিভেদ প্রথার মূল লক্ষ্য ছিল সমাজে কে কি কাজ করবে তা ঠিক করে দেওয়া । সমাজের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা এর উদ্দেশ্য ছিল না । আর যদি এটা বৈষম্যই সৃষ্টি করে থাকে তাহলে এখনও কেন ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার নানা রকমের সংরক্ষন চালু রেখে জাতিভেদ প্রথাকে জিইয়ে রেখে দিয়েছেন ?
সমস্ত মানুষই যে এক তা প্রমান করার চেষ্টা হিন্দুদের মধ্যে থেকে বারবারই হয়েছে । চৈতন্যদেব এবং বিবেকানন্দই তার প্রমাণ ।
কমিউনিস্টরা কোন ধর্মে বিশ্বাস করেন না । কিন্তু তাঁরাও স্বীকার করেন চৈতন্যদেব এবং বিবেকানন্দের দর্শনকে ।
বিবেকানন্দের লেখায় পড়েছি যে হিন্দুধর্ম শ্রেষ্ঠ কারন একমাত্র এই ধর্মই শেখায় অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে । রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন যে যত মত তত পথ । অর্থাৎ তিনিও অন্য ধর্মের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন । এমনকি এরকমও শোনা যায় যে তিনি মুসলমান হয়েও সাধনা করেছিলেন ।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উপরেও হিন্দু দর্শনের প্রচুর প্রভাব ছিল । অনেক বিপ্লবীই ইংরেজদের বিরূদ্ধে মনোবল সংগ্রহ করতেন গীতা পড়ে ।
অতএব জন্মসূত্রে আমি হিন্দু এবং আমি যদি আমার এই পরিচয় সম্পর্কে গর্ববোধ করি তাতে দোষের কিছু নেই ।