নগদ টাকা বিনিয়োগ করলেই ১০ মাসে দ্বিগুণ হবে , অনলাইনে বড়লোক হবার ব্যবসা!! এমন হরেক কথা ঘুরছে ফিরছে কুষ্টিয়ার মানুষের মুখে মুখে। শহর থেকে দূরগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে বিনিয়োগের দৌড়ঝাঁপ। লোভী মানুষ ব্যাঙ্কের ডিপোজিট, ফসলি জমি, স্ত্রী-কন্যার সোনার গহনা বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে নিয়ে ছুটছে ইউনি পেটুইউ এর এজেন্টদের আস্তানায়। সেখানে টাকার বিপরীতে তারা অনলাইনে ইউনিপেটুইউ’র সদস্যভুক্ত হচ্ছেন, হাতে পাচ্ছেন শুধু সদস্য নাম্বার আর পাসকোড। এতেই আলাদীনের চেরাগ হাতে পাওয়ার খুশি নিয়ে ফিরছেন বাড়ীতে। বাড়ীতে ফিরে এসেও অলস বসে না থেকে, পরিচিত সবার মগজ ধোলাইয়ে লেগে পড়ছেন, কারণ অন্য কেউ টাকা জমা দিলেও তার একটা অংশ সে নিজে পাবে এই আশায়।
এত লাভ জনক ব্যবসার খোজ পাবার পর, নিজেও বড়লোক হবার আশায় তাদের সম্পর্কে খোজ খবর নেওয়া শুরু করতে গিয়ে, যা যা পেলাম তার বিস্তারিত হল-
কোম্পানীটি এম এল এম পদ্ধতিতে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে। ওয়েবসাইটে তারা নিজেদের মালয়েশিয়া ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠী হিসাবে উল্লেখ করেছে (যদিও তারা তাদের who.is -এ পর্যন্ত নিজেদের ওয়েব সাইটের তথ্য গোপন রেখেছে)। ভারত, ফিলিপাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে তাদের অফিস রয়েছে বলেও তারা দাবি করেছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় তাদের ১০০টিরও বেশি এজেন্টদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা গ্রাহকদের প্রস্তাব দিচ্ছে- সর্ব নিন্ম ২১০০০টাকা থেকে শুরু করে, যে কোন পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করলেই ১০ মাসে এর দ্বিগুণ ফেরত দেবে, তাও মাসে মাসে। এখন চলছে বিশেষ অফার, তাতে কেবল ২ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলেই একজন গ্রাহক মাসে পাবেন ৪৮ হাজার টাকা। সদস্য ফি লাগবে ৮ হাজার ৪শ’ টাকা। এই টাকা আবার মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য ১২০ ডলার হিসেবে ইন্টারনেটের অ্যাকাউন্টে জমা হবে।
ওদের ব্যবসা লস হলে নাকি FORXE ওদের লস দিয়ে দিবে কারন FOREX এর সাথে ওদের ইন্সুরেন্স করা আছে!! (বিষয়টা পুরোপুরি মিথ্যা কারন FOREX কোন ইন্সুরেন্স কোম্পানী না , এটা হল বিশ্বের অন্যতম মুদ্রা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। যে কেউ ওখানে একাউন্ট খুলে ব্যবসা করতে পারে !!)
ইউনিপে টুইউ মোতালেব প্লাজায় ‘লেভেল ৬-এ রুম নং ৫-সি, ৮/২ পরীবাগ, হাতিরপুল, শাহবাগ’- এ ঠিকানায় অফিস খুলে বসেছে। ম্যানেজমেন্টের সবার জন্য রুম রয়েছে। ফুল ফার্নিশ করা। তবে তারা কেউ নেই। তারা এক রকম পলাতক। আজ পর্যন্ত কোন কাস্টমার তাদেরকে দেখার সুযোগ পায়নি।এমনকি অফিসে তাদের কোন ছবি পর্যন্ত নাই। ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে নেটেও তাদের কোন ছবি পাওয়া যায় নি ।
টাকা অন্যদেশে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনোরকম ছাড়পত্র বা অনুমোদন নেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করেনি কোম্পানীট। একটি সাধারণ ট্রেড লাইসেন্স, জয়েন্ট স্টক কোম্পানির একটি নিবন্ধন (নং-সি-৮০০৫৩/০৯) ও আমদানিকারক (নিবন্ধন নং-০১৯৮৪২৫) হিসেবে প্রতিষ্ঠানের নাম লিপিবদ্ধ করাই তাদের মূল পুঁজি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এই কোম্পানি এখন যেভাবে ব্যবসা করছে তাতে আশঙ্কা জাগে- এক সময় এই কোম্পানি পালাতে পারে এ দেশ ছেড়ে। কারণ, তারা টাকার বিপরীতে ডলার নিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারণে টাকা বিদেশে পাঠাতে না পারায় তারা এখন এই নতুন কৌশলে কাজ করছে। তারা যে কোন সময়ে তাদের কোম্পানির সার্ভার বন্ধ করে দিতে পারেন।
শুধুমাত্র একটি ওয়েবসাইটকে পুঁজি করে প্রতাণনার এ অভিনব ও ভার্চুয়াল পদ্ধতিকে, ইন্টারনেট সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিরা ‘ডিজিটাল প্রতারণা’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন।
ইউনিপেটুইউ গত প্রায় এক বছর ধরে গোপনে নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে আসছিল । এজন্য তাদের ১ম টার্গেট ছিল বিভিন্ন ব্যাংকের মার্কেটিং বিভাগের কিছু এক্সিকিউটিভ, সেই সাথে সমাজের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি, যাদেরকে সাইনবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করতে পারলে, সাধারন মানুষের কাছ থেকে খুব সহজেই টাকা খসাতে পারা যাবে। ফলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল, ডাক্তার, পুলিশ কর্মকর্তা, সাধারণ ব্যবসায়ীকে যেমন ভেড়াতে পেরেছে, তেমনি এ চক্রে নাম লিখিয়েছে শিক্ষার্থী থেকে গাঁয়ের গৃহবধূরাও। বিভিন্ন ভাবে লোভ দেখিয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তীদেরকে তারা দলে ভেরাতে সক্ষম হয়, এজন্য ঢাকার পাঁচতারকা হোটেলে একদিন থাকা, খাওয়া , ডিনার অথবা লাঞ্চ। কক্সবাজারে যাওয়া-আসার ট্রিপসহ নানা লোভনীয় অফারও দেওয়া হয়। এছাড়াও মেম্বার হলে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগও রয়েছে । বলা হয়, সেখানে গিয়ে ইউনিপে টুইউ’র অফিস ও কাজও দেখে আসা যাবে। এছাড়াও চাইনিজ রেস্টুরেন্টে তারা নিয়মিত বসছে। এক একজন গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে তিনজনকে ফাঁদে ফেলতে সক্ষম হন। অনেকে এর বেশিও করেন। নতুন সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের অজান্তেই এ প্রতারণা ব্যবসার চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তারাও লোভনীয় ও অবাস্তব সব প্রস্তাব নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন মানুষের ঘরে ঘরে।
গত বছর অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে ইউনিপে টুইউ-এর কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ইউনিপেটুইউ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাসুদুর রহমান, মাঝে মাঝে মোহাম্মদ শহিদুজ্জামানকেও চেয়ারম্যান বলা হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির হোসেন।
ইউনিপে টুইউ বাংলাদেশ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসীর হোসেন এর আগেও নিউওয়ে নামের একটি কোম্পানিতে কাজ করতেন। এর আগে তিনি নিজেই জিজিএন নামে একটি কোম্পানি খুলেছিলেন। ওই সময়ে তার কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠাই সরকার জিজিএন-এর কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়। পরে তিনি আবার নিউওয়ে কোম্পানি করেন। এখন আবার খুলেছেন ইউনিপেটুইউ বাংলাদেশ নাম দিয়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, মানি লন্ডারিং আইন অমান্য করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা লেনদেন করছে- এ অভিযোগ পাওয়ার পরই ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। উল্লেখ্য, গত ১৩ মে অবৈধ লেনদেনের কারনে ইউনিপে-টুইউ এবং ইউনিপে-টু-ইউ বাংলাদেশ লিমিটেড কোম্পানি ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (১) মো. মুনতাসীর হোসেন, পিতা মো. মোস্তাফিজুর হোসেন, মাতা হাসিনা মোশাররফ (২) পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান, পিতা মো. মাহবুবুর রহমান, মাতা মাজেরা বানু এবং (৩) পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান, পিতা মো. হাজী আবুল মাজেদ, মাতা মৃত মেহেরুন্নেছা- এদের পরিচালিত সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেয় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের অভিযোগ থাকায় আরও বেশি বিপাকে পড়ে কোম্পানিটি।
আদালত শুধুমাত্র গ্রহকদের কে ফেরত দেবার জন্য, তাদের একাউন্ট থেকে ৩ কোটি টাকা তোলার অনুমতি দেয়।
এদিকে পরিচালকদের অ্যাকাউন্টের ওপর নজরদারি থাকায়, বাংলাদেশের গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ ও তা ইউনিপ-টুইউ’র কর্পোরেট অফিস মালয়েশিয়ায় পাঠাতে শীর্ষ পর্যায়ের ২০ এজেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা এসব টাকার সিংহভাগই হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানোর চেষ্টা করছে।
ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ ও মামলা চলার পরও আমাদের কুষ্টিয়াতে ইউনিপেটুইউ এর কার্যক্রম এখনো চলছে। যেখানে আমাদের দেশীয় ব্যাংকের সুদের হার ১৩-১৫% আর আন্তর্জাতিক ভাবে আরো অনেক কম, সেখানে ইউন পেটু ইউ এর ১২০+% সুদের অবান্তর গল্প বিশ্বাস করে কুষ্টিয়ার সাধারন মানুষ এখনো তাদের ফাদে পা বাড়াচ্ছে।
দূণিতীদমন কমিশনেও ইউনিপে টু ইউ এর বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়টা প্রক্রিয়াধীন আছে। তার পরও ইউনিপেটুইউ বন্ধে আদালতের চুরান্ত রায় আসার আগেই আরো হাজার হাজার মানুষ প্রতারিত হবে। আর এই সমস্ত প্রতারকরা বরাবরের মতই থাকবে ধরাছোয়ার বাইরে। সেই সাথে আবার কয়েক বছর পর নতুন রুপে নতুন নামে এসে সহজ সরল মানুষকে লোভ দেখিয়ে আবারো প্রতারনা করবে।
আর ইউনিপেটুক যদি সত্যিকারেই বিদেশি প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকে। তবে ওখানে বিনিয়োগ করাটা কখনই শুধু মাত্র যারা বিনিয়োগ করছে তাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার না। কারণ আপনার বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত না পেলেও হইত আপনি খুব সহজেই ক্ষতিটা কাটিয়ে উইতে পারবেন। কিন্তু দেশের যে টাকাগুলো অনর্থক বিদেশে চলে যাবে তার দায়ত আপনাকে আমাকে এমনকি আমাদের দেশের সবচাইতে গরিব মানুষটাকেও ভোগ করতে হবে। কাজেই এটা কখনই কোন ব্যাক্তিগত ব্যাপার হতে পারে না।
এই জাতীয় প্রতারনা বন্ধে সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন এখন সময়ের দাবী।
***লেখাটাতে বেশ কয়েকটা পত্রিকা থেকে কপি পেষ্ট করা হইছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৫:৪৬