শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এর আঁকা ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের সময়কার ছবি।
আমরা আজ অনেকটা সময় পেছনে ফিরে যাব। ১৯৪৩ সালের বাংলা। কলকাতা বিহার উড়িষ্যা তখন বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্গত। খুব অস্থির একটা সময়। মানুষ বুঝতে পারছে হিন্দু মুসলিমরা সম্ভবত আর একসাথে থাকতে পারবে না। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিরতা সর্বত্র। এমন সময়েই এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এই অঞ্চলে আঘাত করলো। মারা গেল ৩০ লক্ষাধিক মানুষ। কোথাও কোথাও সংখ্যাটা পাওয়া যায় ৫০ লক্ষাধিক। সরকারি হিসেবে ১৫ লক্ষ। ‘মা এট্টু ফ্যান দাও’ বলে কাতরাতে কাতরাতে কলকাতা বাংলার রাস্তায় মরে পড়ে থাকত অভুক্ত, কঙ্কালসার, শীর্ণ মানুষেরা। বাংলা ১৩৫০ সালে এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে একে 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' বলা হয়। ঠিক কী ঘটেছিল ১৯৪৩ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই বিশেষ সময়কালে, যখন কোনো যুদ্ধ, এমনকি একটি বুলেট ছাড়াই এ দেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের এ রকম অসহায় মৃত্যু ঘটেছিল?
ক্ষুধার্ত শিশুরা...
১৯৪৩ সাল। ভারতীয় রাজনীতির পটভূমিকায় এই সময়ে নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ বাংলার শাষণভার গ্রহণ করে। দুর্ভাগ্যবশত মন্ত্রীসভা গঠনের অল্পদিনের মধ্যে এ ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই সর্বনাশা দুর্ভিক্ষের জন্য মুসলিম লীগ সরকার দায়ী ছিল না। খাদ্যশস্যের ঘাটতি প্রকৃতপক্ষে আরম্ভ হয় কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রীসভার আমলে এবং লীগ সরকার গঠনের পর আরও অবনতি হয়। তৎকালীন বাংলা সরকার কর্তৃক 'উডহেড কমিশন' যে রিপোর্ট প্রদান করে তাতে এই দুর্ভিক্ষের জন্য ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা ও নাজিমুদ্দিনের লীগ মন্ত্রীসভা উভয়কেই আংশিক ভাবে দায়ী করা হয়। জাপান কর্তৃক বার্মা (বর্তমান) দখলের ফলে সেখান থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। বার্মা থেকে বিতাড়িত বহু উদ্বাস্তু আসার ফলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। অনাবৃষ্টির ফলে দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও হ্রাস পায়। দুর্ভিক্ষের আভাস পেয়ে ভারত সরকার সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্যশস্য সংগ্রহ হরে গুলামজাত করার ফলে খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দেয়। অসাধু ও অর্থলোভী ব্যবসায়ীরাও খাদ্যশস্য গুদামজাত করে। এছাড়া দেশে কর্ডনিং প্রথা চালু ও সর্বপ্রকার যানবাহন সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্য খাদ্যশস্যের অবাধ চলাচলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। পাঞ্জাব সরকার বাংলার এ চরম সংকটে গম ও আটা পাঠাতে রাজি থাকা সত্ত্বেও দেশে কর্ডনিং প্রথার জন্য তা আমদানি করা সম্ভব হয়নি। হিন্দু মহাসভাপন্থী কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী শ্রীবাস্তব বাংলার মুসলীগ লীগ সরকারের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন থাকায় অন্যান্য প্রদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানিতে নানাপ্রকার বাধার সৃষ্টি করেন। বিহার ও উড়িষ্যা সরকার এ সময়ে তাদের উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সরবরাহ করে বাংলা সরকারকে সহযোগিতে করতে অস্বীকার করে। এছাড়া সরকারি আমলাদের কর্তব্যে অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার জন্য অবস্থার আরো অবনতি হয়েছিল।
অসহায় মায়ের কোলে তার মৃতপ্রায় অস্থি কঙ্কালসার শিশু...
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এর আঁকা দুর্ভিক্ষের সময়কার আরো কিছু ছবি।
দুর্ভিক্ষের সময়টার ইতিহাসের গভীরে ঢুকলে আরো অনেক কিছু বের হয়ে আসে যার জন্যই মূলত এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। জার্মানপ্রবাসী বাঙালি গবেষক মধুশ্রী মুখার্জি প্রায় ৮ বছর ধরে ঔপনিবেশিক অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষ ও বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা এবং চার্চিল সম্পর্কে অপ্রকাশিত প্রচুর দলিলপত্রের সাহায্য নিয়ে একটি দুর্দান্ত বই লিখে ফেলেন যা আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চাকে একটা অত্যন্ত উচ্চমানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ইংরেজি ভাষার এ বইটির নাম ''Churchill's Secret War: The British Empire and the Ravaging of India during World War II'' মধুশ্রী মুখার্জি এই বইটিতে প্রমাণ করেছেন, বৃটেনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সরকারের বেশ কিছু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পদক্ষেপের কারণে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে অখণ্ড বাংলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মর্মান্তিকভাবে মারা যায়।
রিলিফ সেন্টারে সামান্য খাবারের আশায় ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর সারি...
১৯৪২ সালে জাপান তৎকালীন বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) দখল করে নেয়ার পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। এর ফলে বার্মা থেকে ভারতে চাল আসা বন্ধ হয়ে যায়।১৯৪৩ সালে নজিরবিহীন মন্বন্তরে যখন বাংলার মানুষ বেঘোরে মরছিল চার্চিল তখন তাদের সাহায্যের জন্য হাত বাড়াননি। শুধু তাই নয়, অন্যেরা যেন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে না আসে সে বিষয়েও চার্চিল ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বলে মধুশ্রী মুর্খাজি তার গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মৃত্যুতে চার্চিল সামান্য দয়া অনুভব করেননি বরং তিনি সে সময় মন্তব্য করেছিলেন, ''ভারতবাসীরা খরগোসের মত বাচ্চা দেয়।'' চরম খাদ্যসঙ্কটের আরও একটি কারণ দেখিয়েছিলেন চার্চিল। এত বড় একটা যুদ্ধ চলছে, অনেক দেশেই খাদ্যাভাব রয়েছে, ভারতের মানুষকে তো ভুগতে হবেই। চার্চিলের ভারতবাসীদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ছিল। তা এ সব কর্মকাণ্ড ও কথার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। কয়েক জাহাজ খাদ্যশস্য পাঠানোর মাধ্যমে চার্চিল অনায়াসে ভয়াবহ এ দুর্ভিক্ষ প্রতিহত করতে পারতেন তা 'চার্চিল'স সিক্রেট ওয়ার' বইতে প্রমাণ করা হয়েছে। বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য খাদ্যশস্য পাঠানোর জন্য ভারতের দুই ভাইসরয়, চার্চিলের ভারত বিষয়ক সচিব এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত চার্চিলকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু, চার্চিল তাদের সে আহবান বা অনুরোধে সাড়া দেননি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম বীর নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সে সময় বার্মা থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার জনগণের জন্য চাল পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু, সে খবর ভারতের কোনো পত্রিকায় প্রকাশ করতে দেয়নি বৃটিশ সেন্সর কর্তৃপক্ষ।
রিলিফ সেন্টারে সামান্য খাবারের আশায় ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর সারি...
জাপানিরা তখন চট্টগ্রামে ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। ১৯৪১ সালের ১৪ নভেম্বর চার্চিল ঘোষণা করলেন ‘পোড়ামাটি নীতি’ অর্থাৎ যেসব অঞ্চল ইংরেজরা ছেড়ে চলে যাবে, তা নির্মমভাবে ধ্বংস করতে হবে। অবশ্য এই নীতির একটা ভদ্রস্থ নাম দেওয়া হয়েছিল—‘ডিনায়াল পলিসি’। জাপানিরা সাগরপথে উপকূলে এসে নামতে পারে—এই আশঙ্কায় কলকাতার ২০ মাইল দক্ষিণ থেকে টানা লাইন টেনে উপকূলীয় এলাকার সব নৌকা ধ্বংস করা হলো। ফলে যখন দুর্ভিক্ষ শুরু হলো, পাশের উদ্বৃত্ত জেলা থেকে ধান-চাল আনার কোনো উপায়ই আর রইল না। নৌকা কেড়ে নেওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো জেলে সম্প্রদায়।
রাস্তায় পড়ে থাকা কিছু চাল বা গম কুড়িয়ে নিচ্ছেন এক মা...
ফজলুল হক ১৯৪২ সালে হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলেন যে, ‘বাংলায় চালের দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে।’ কিন্তু চার্চিল বা ইংরেজ সরকারের সেসবে কর্ণপাতের সময় ছিল না। অস্ট্রেলীয়রা চাইছিল ক্ষুধার্ত ভারতের জন্য যতটা প্রয়োজন গম পাঠাতে। কানাডাও চাইছিল যে অন্তত একটা জাহাজভরা গম ভারতে পাঠাতে। কিন্তু চার্চিল এ কাজে কোনো জাহাজ ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। তাতে ব্রিটেনের ‘মর্যাদা’থাকে না। বাংলার আসন্ন দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে জাহাজ দিতে কমান্ডার-ইন-চিফ ওয়াভেল ও ভাইসরয় লিনলিথগো বারবার বলা সত্ত্বেও চার্চিল গোঁ ধরে রইলেন যে, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না! অস্ট্রেলিয়া থেকে খাদ্যভরা জাহাজ তাই শ্রীলঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হলো, কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার কোনো বন্দরে সে জাহাজ ভিড়ল না! সময়মতো অস্ট্রেলীয় বা কানাডার গম এলে প্রায় ২০ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেত।
রাস্তার পাশে পড়ে থাকা এক মৃত মহিলার লাশ। তখন প্রতিদিনকার একটি সাধারণ চিত্র।
দুর্ভিক্ষের সে দিনগুলোতে মানুষ কচুঘেঁচু, পাতা-লতা এমনকি দূর্বাঘাস খেয়েও বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। মেদিনীপুরের এক বৃদ্ধ জানাচ্ছেন, সে সময়ে মাঠে কোনো কচি ঘাস আর ছিল না। ক্ষুধার্ত মানুষেরা খেয়ে সব শেষ করে ফেলেছিল! যে সময় রিলিফ কেন্দ্র থেকে খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছিল, তার পরিমাণও ক্রমেই কমে আসছিল। প্রথমে তিনজন মানুষের জন্য ছিল আধা সের চাল, পরে তা কমতে কমতে এসে দাঁড়াল চার আউন্সে, যা আসলে মাত্র ৪০০ ক্যালরির সমান এবং বরাদ্দের যে পরিমাণটা ছিল বুখেনভাল্ড ক্যাম্পের সেই সব বন্দীর বরাদ্দের সমান, নাৎসিদের কাছে যাদের মৃত্যু ছিল সুনিশ্চিত। ক্ষুধার্ত মানুষেরা অমানবিক সব আচরণ শুরু করে। ক্ষুধায় উন্মাদ হয়ে একজন দরিদ্র কৃষক নিজের বাবা, মা, বউ ও সন্তানদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেন। এক ক্ষুধার্ত অসহায় বাবা তার কোলের বাচ্চাটিকে অনেকের কাছে বিক্রি করতে চাইলেন। কেউ কিনতে রাজি না হলে শিশুটিকে একটা কুয়ার মধ্যে ছুড়ে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যান! মৃত মায়ের স্তন থেকে দুধ খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে শীর্ণকায় শিশু—এ দৃশ্য কলকাতার রাজপথে প্রায়ই দেখা গেছে। কলকাতার ফুটপাতে যাদের মৃত্যু ঘটেছে, তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কিছু প্রচার পেলেও গ্রামের মৃত্যুগুলো নীরবে ঘটেছে এবং অন্ধকারেই রয়ে গেছে। গ্রামের শিয়াল ও কুকুরেরা এসব মৃতদেহ টেনে নিয়ে গিয়েছে।
খাদ্যবোঝাই মালগাড়ি থেকে কিছু বের করার চেষ্টায় একদল শিশু...
হঠাৎ করে বাংলার খাদ্যশস্য উধাও হয়ে সব গেল কোথায়? বাংলা সরকার পাঁচ হাজার লাইসেন্স দিয়েছিল খাদ্য সংগ্রহের।উপকূলীয় এলাকাগুলো থেকে চাল কেনার জন্য সরকার ২০ লাখ রুপি অগ্রিম দিল মির্জা আহমেদ ইস্পাহানিকে। যেহেতু সরকারের পক্ষে কাজ করছে, ফলে ইস্পাহানির ক্ষমতা ছিল কেউ তার দেওয়া দামে চাল বেচতে রাজি না হলে সে চাল জোর করে নেওয়ার। ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন যে জিন্নাহর বশংবদ ইস্পাহানি ছিল মুসলিম লীগের অন্যতম বড় চাঁদাপ্রদানকারী ও ব্রিটিশদের বিশেষ খয়ের খাঁ। ইস্পাহানি ছাড়াও লাইসেন্সগুলো পেয়েছিল কিছু ইংরেজ ব্যবসায়ী এবং মুসলিম লীগ সরকারের কাছের সব লোকজন। তারা খাদ্য মজুদ করেছিল, ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে চলছিল এবং অঢেল অর্থ পকেটে ভরছিল। সরকারি অফিসাররাও কম দায়ী ছিলেন না। যেমন যশোর জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তিন লাখ ৭০ হাজার টন চাল কিনে রেলওয়ে প্লাটফর্মে রেখে দিয়েছিলেন। চরম দুর্ভিক্ষের দিনেও সে চাল বাইরে যেতে দেননি। তেমনি ৯০ হাজার টন চাল কলকাতার কাছে বোটানিক্যাল গার্ডেনে মজুদ করে রাখা ছিল। সেসব চাল পরে পচে যায় এবং খালের পানিতে ফেলে দিতে হয় একসময়।
রিলিফ সেন্টারে শিশুদের কে দেয়া হচ্ছে দুধ...
ওয়ার ক্যাবিনেটের যেকোনো সভায় বাংলার দুর্ভিক্ষ বা ভারত প্রসঙ্গ এলেই চার্চিল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন। এ ক্ষিপ্ততার একাধিক কারণ ছিল। ইতিহাসের দেয়াললিখন তত দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে যুদ্ধের পরে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সিংহের থাবা থেকে বেরিয়ে যাবে। তা ছাড়া বাঙালিদের প্রতি চার্চিলের বিদ্বেষ ছিল। বাঙালিরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে। উত্তর-পশ্চিমের প্রদেশগুলোর লম্বা-চওড়া মানুষগুলোর মতো ব্রিটেনের অনুগত নয়। ১৯৪৪ সালে দুর্ভিক্ষের যখন প্রায় শেষ পর্যায়, তখনো খাদ্য চেয়ে ওয়াভেলের টেলিগ্রামের কোনো জবাব দিলেন না চার্চিল; বরং এক টেলিগ্রামে জানতে চাইলেন, ‘গান্ধী এখনো মরছে না কেন!’
রাস্তা ঘাটে পড়ে থাকা মৃতদেহ গুলোকে গাড়িতে তোলা হচ্ছে...
মৃত্যুর আগে অসুস্থ অবস্থায় চার্চিল অবশ্য তাঁর ডাক্তারকে বলেছিলেন, ‘ভারতের ব্যাপারে আমি ভুল করেছি!’ খুবই দেরিতে আত্মোপলব্ধি!! চার্চিল সব সময় বলতেন যে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের যুগটাই ইতিহাসে ‘স্বর্ণ যুগ' হয়ে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে এটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য একটা কলঙ্ক হয়েই থাকবে যে, ভারতে তাদের সাম্রাজ্য শুরু হয়েছিল ছিয়াত্তরের ভয়াবহ মন্বন্তর দিয়ে; আর শেষও হলো আরেক মর্মান্তিক মন্বন্তরে, যেখানে কোন ধরনের যুদ্ধ, কোন বুলেট ছাড়াই হারিয়ে গিয়েছিল ৩০ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ, চিরকালের জন্য ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন। স্বর্ণযুগই বটে!!
অস্থি কঙ্কালসার এক বৃদ্ধ...
দেশের এই মহাদুর্যোগের সময় তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী দেশের খাদ্যাভাব দুরীকরণের এবং বিপন্ন জনগণকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেননি। অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দীর তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন জেলায় খাদ্যশস্য প্রেরণ করা হয়। সরবরাহ বিভাগ কে তিনি জরুরি বিভাগ ঘোষণা করেন এবং অভিজ্ঞ অফিসার নিয়োগ করে পরিস্থিতিব মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন। সরকারি প্রচেষ্টায় বহু রিলিফ সেন্টার খোলা হয়। কলকাতা ও অন্যান্য শহরে রেশনিং প্রথা চালু করা হয়। কিন্তু এ প্রচেষ্টা গুলো ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল এবং সাধারণ গরীব মানুষদেরকে সেগুলো মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরাতে পারেনি।
পঞ্চাশের সেই ভয়াবহ মন্বন্তর নিয়ে গবেষণা ও চর্চা আজও শেষ হয়নি। এত বছর আগের সেই বিনাশ-কালের ভয়াবহ স্মৃতিতে আজ হয়তো বা উদাসীনতার ধুলো পড়েছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের মানুষের মৃত্যুর হাহাকার আমাদের ইতিহাসের পাতাকে সব সময় অভিশপ্ত করে রাখবে।
মাঠে পড়ে রয়েছে কোন এক মৃত মানুষের কংকাল..
(All the photographs are taken from Life archive hosted by Google. The photographer was William Vandivert)
পঞ্চাশের মন্বন্তরের উপর ভিত্তি করে লেখা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৩ সালে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেছিলেন অন্যতম বিখ্যাত চলচ্চিত্র ''অশনি সংকেত''। এই চলচ্চিত্রে "অনঙ্গ বৌ" চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ববিতা আন্তর্জাতিক শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেন এবং ব্যাপক প্রশংসিত হন। চলচ্চিত্রটি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কার(১৯৭৩) এবং শিকাগো চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন হিউগো পুরস্কার (১৯৭৪) লাভ করে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৯:৪৫