somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাধবীর স্মৃতি কথা লতা পাতা

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গ্রীষ্মের ক্লান্ত দুপুর। লাল ইট বিছানো রাস্তার দুই পাশে ক্লান্ত কড়ই গাছগুলোতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সকল পাখি। বাসা বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে কেউ কেউ রেডিওতে সিনেমার গান শুনছেন, কেউ কেউ ঘুমোচ্ছেন বা শুয়ে শুয়ে আলস্য করছেন। অথচ এই ভর দুপুরে মাধবী সেলাই মেশিনে খট খট করে কিছু সেলাই কাজ করছেন। সাথে একই কাজ, সুই সুতা নিয়ে হাতে সেলাই করছেন তার চার কন্যা - স্মৃতি, কথা, লতা, পাতা! 1970। DACCA, EAST PAKISTAN.

মাধবীদের পরিবার সনাতন ধর্মের অনুসারী। তিনি স্বামী পরিত্যক্তা। মাধবীর স্বামী সুমন বাবু ভারতের আসাম গিয়ে আর ফেরত আসেন নি, সেখানেই নতুন সংসার করেছেন। মাধবী অথৈ সাগরে পরে গেলেন। কিন্তু মনের শক্তিতে হোক আর শরীরের শক্তিতে তিনি সংসারের হাল ছাড়লেন না। চার কন্যা নিয়ে তিনি তার বাবার বাড়িতে উঠে এসেছেন। এখন, এই বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে জীবন যাপন করছেন। আর পাড়া প্রতিবেশী মহল্লাবাসী মনে হয় মাধবীদের পেয়ে বসেছেন - বাড়ির এমন কোনো সেলাই কাজ নেই! - যা কিনা মাধবীদের দিয়ে করাচ্ছেন না। পুরোনো বাসী নষ্ট ছেঁড়া ফাটা যতো কাপড় চোপড় আছে সব মাধবীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারো বাচ্চা হবে - পুরোনো শাড়ি কাপড় দিয়ে কাঁথা বানানো সহ বিছানার চাদর বালিশের কাভার সেলাই, লেপের কাভার, সালোয়ার কামিজ সেলাই, রিপু হাবিজাবি যা-তা অবস্থা। দেখে মনে হতে পারে মাধবীদের বাড়িটি কোনো মানুষ জন থাকার বাড়ি নয়, এটি একটি বাতিল রদ্দি কাপড়ের স্টোরহাউজ।

এমনিতে মাধবীদের বাড়ির অবস্থাও ভয়াবহ! সবুজ শেওলায় ছেঁয়ে যাওয়া একতলা বাড়িটির জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। বাড়ির দেয়ালে জানালার কার্নিসে কিভাবে যেনো বটগাছ ফুটে উঠেছে। এখন দেয়ালে দেয়ালে সেই বটগাছের লতানো শিকড় দেখে বাড়িটিকে কারণে-অকারণে ভৌতিক মনে হয়। অথচ কয়েক বছর আগেও মাধবীদের বাড়িটি বেশ ঝকঝকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ছিলো। দক্ষিন দিকের লাইনের শুরুতে নারকেল গাছওয়ালা যেই হলুদ বাড়িটি, সেটিই মাধবীদের বাড়ি। মাধবীর বাবা সোমনাথ বাবু বাজারের বড় আড়তদার ছিলেন। মাধবীর মা মোহনা পুরোকায়স্থ ছিলেন অত্যন্ত শৌখিন একজন গৃহিনী।

মাধবীর স্বামী সুমন বাবু যখন আসামে চলে গিয়েছেন তখন জানা গেলো তিনি তাঁর শশুর মশাইয়ের ক্যাশ নিয়ে পালিয়েছেন! এইদিকে এত্তোবড় আড়তদার সোমনাথা বাবু টাকার শোকে হোক আর একমাত্র কন্যা ও নাতনীদের চিন্তায় হোক - এই যে বিছানায় পড়লেন আর উঠতে পারেননি। সোমনাথ বাবুর মৃত্যুর পর দেখা গেলো সবাই সোমনাথ বাবুর কাছে পাওনাদার! অথচ সোমনাথ বাবু কারো কাছে কানা কড়িও পাবেন বলে কেউ সারা শব্দ দিলেন না। দিনে দিনে দেনা বেড়ে গেলো, আড়ত ব্যবসাও লাটে উঠ গেলো। মাধবীদের আত্মীয় পরিজন ছিটকে তাঁদের থেকে ১০০ হাত দূরে নয়, মনে হয় ১ লক্ষ হাত দূরে সরে গেলেন!

মাধবীর স্বামী সুমন বাবু দেখতে অনেকটা নায়ক বুলবুল আহমেদের মতো টকটকে ফর্সা সুন্দর গোলগাল নাদুস নুদুস ছিলেন। ইস্ত্রি করা শার্টপ্যান্ট আর কালি করা পলিশ জুতো পরে ফিটফাট চলাফেরা করতেন। তিনি নিজে কি কাজ করতেন তা কেউ জানতো না। মাধবীর জানামতে বা সুমন বাবুর দেওয়া উড়ো তথ্য মতে - সুমন বাবু সিলেটে চা পাতার ব্যবসায়ী ছিলেন।

মাধবীর সংসারের ভয়াবহ অভাব অনটনের কারণে, সুমন বাবুকে মনে রাখার মতো আর কোনো কারণ রইলো না। মাধবীর মা মোহনা পুরোকায়স্থ বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারাদিন কাকে যেনো অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। উঠে বসার শক্তি গায়ে নেই, কিন্তু ভগবান মুখটি রেখেছেন হয়তো গালাগালি করার জন্য! তিনি এই কাজটি সঠিকভাবে করে যাচ্ছেন। দিনে এক দুইবার জাউ ভাত খান। খেয়ে হাপাতে হাপাতে কাশতে কাশতে আবার গালাগালি শুরু করেন। বাদবাকী সময় মরার মতো বিছানায় পড়ে থেকে যমদূতের জন্য অপেক্ষা করেন! যমদূত কতোদিকে কতো বাড়িতে হানা দিচ্ছেন কিন্তু এই বাড়িতে মোহনার দিকে তাঁর ভুলেও চোখে পড়ে না!

দেখতে দেখতে মাধবীর চার কন্যা স্মৃতি, কথা, লতা, পাতা গাছের লতা পাতার মতোই লক লক করে বেড়ে উঠেছে। আর কখন যে বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে তা হয়তো, মাধবী মা হয়ে নিজেও লক্ষ্য করেননি। যখন লক্ষ্য করেছেন তখন জানতে পারলেন পাড়া প্রতিবেশী বলাবলি করছেন “মেয়ে দেখতে তো সবগুলো সুন্দর হয়েছে, কিন্তু বয়স তো বিশ পেড়িয়ে গিয়েছে”! সবাই হাতের আঙুল গুনে গুনে বয়স গুনে নেন। কিন্তু বিয়ের জন্য ভালোমন্দ কোনো প্রস্তাবই আসে না।

সময় এক ভয়ংকর খাদক। এতো বড় ভয়ংকর খাদক পৃথিবীতে আর নেই। সময় সবাইকে ভক্ষণ করে নেয়, রাজা বাদশাহ থেকে শুরু করে সৈন্য সামন্ত সব - সব। সময়ের সাথে ঝুলে থাকতে থাকতে সবাইকে চুরান্ত বিরক্ত করে চলে গেলেন মাধবীর মা মোহনা পুরোকায়স্থ। আর বড় অসময়ে কাউকে সামান্যতম জানান না দিয়ে হঠাৎ করেই একদিন সবাইকে আবারও জলে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন চিরো দুঃখী মাধবী পুরোকায়স্থ!

সমাজের সভ্য কয়েকজন নারী যারা ক্লাব সমিতি করে থাকেন। নাটক থিয়েটার পাড়ায় ঘুরে থাকেন। সমাজ নিয়ে ভেবে থাকেন। নারী স্বাধীনতা নিয়ে ভেবে থাকেন ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে থাকেন! তাঁদের কয়েকজন মিলে সোমত্ত মেয়ে স্মৃতির জন্য বিয়ে না এনে, কথার জন্য বিয়ে না এনে! - বিয়ে নিয়ে এসেছেন সবার ছোট পাতার জন্য! পাত্রের ও পাত্রের মায়ের চাওয়া পাওয়ার সাথে কোনোভাবেই মিলাতে না পেরে স্মৃতি ও কথার দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অসম্ভব বিরতিহীন চেষ্টার পরও সবার ছোট লতা ও পাতার বিয়ে আর হলো না।

দেখতে দেখতে সময় পেড়িয়ে যায়। অথচ মনে হয়, এইতো সেইদিনের কথা মাত্র!
তারপর কি?
তারপর! তার আর পর নেই!




কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সামহ্যোয়ারইন ব্লগ
ছবি: ফটোশপে তৈরিকৃত





সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৪
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×