বৃহন্নলা
কদিন আগে কলকাতায় গিয়ে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হলো। জ্যোতিদা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আনন্দদা, আনন্দ গোপাল সেনগুপ্ত। ৯১ বছরের এক টগবগে তরুন। তাঁর কথায় যথা সময়ে আসা যাবে। এইখানে তাঁর শুধু একটা কথা বলবো। অনেক্ষন আড্ডা দিয়েছিলাম তাঁর সাথে। এক পর্যায়ে কোন একটা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে "বাঘের বাচ্চা বলিস না। ওটা একটা স্ল্যাং", খুব লেগেছিল কথাটা। এই একটা কথাই আমার অনেক চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে এর পর। আসলেই তো! কুকুরের বাচ্চা, শূকরের বাচ্চা বা গাধার বাচ্চা যদি নির্ভেজাল গালি হয়, তাহলে বাঘের বাচ্চা গালি হবে না কেন? বাঘের তো মানব সভ্যতায় কোন বদান নেই! তো তার বাচ্চা বলাটা এতো গৌরবের কেন? আর কুকুর যাদের সন্তানসম, সেই পশ্চিমা সভ্য মানুষেরা পর্যন্ত কুকুরের বাচ্চা বা "সান অব আ বিচ" বাক্যটাকে গালি হিসেবে ব্যাবহার করে। তাহলে বাঘের বাচ্চা গালি থেকে প্রশংসা হলো কিভাবে। ওদিকে ইতিহাসের কোথাও বাঘের বাচ্চা বা সিংহের বাচ্চাকে গালি বলে উল্লেখ পাই নি! অবশ্য বাঘ, সিংহ এরা নমস্য প্রানী, মামা বলে কথা...
প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি, তবে প্রসঙ্গে আসার আগে আর একটি ঘটনা বলি। এটাও ইতিহাসের কথা। আজ থেকে ২০০ থেকে ১০০ বছর আগে কোলকাতার কথ্য ভাষায় মহিলারা নিজেদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাগী শব্দটা ব্যাবহার করতেন। এই যেমন "আমি তো বুড়ী মাগী", বা "তার মতো জোয়ান মাগী..." একই ভাবে মাগ শব্দটাও সমান্তরালে ব্যাবহৃত হতো। কালের বিবর্তনে মাগী শব্দটা এখন একটা তৃতীয় শ্রেণীর গালি আর মাগ শব্দটার ব্যাবহার শূণ্যের কোঠায় হলেও এটা এখন গালি। কদিন আগে(সেটাও বছর ১০/১২ হয়ে গিয়েছে) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার প্রথম আলো উপন্যাসে ১০০ বছর আগের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেই সময়ের বিখ্যাত ডাক্তার ডাঃ মহেন্দ্র চৌধুরীর একবার দেবী কালী সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাকে "সাঁওতালী মাগী" বলে সম্বোধন করেছিলেন। তখন কিছু হয়েছিল বলে শুনি নি, তবে সুনীল এই কথাটি তার উপন্যাসে অবিকৃত ভাবেই উল্লেখ করেছিলেন। মা কালীকে মাগী বলার অপরাধে পুরো কোলকাতা উত্তাল হয়ে গিয়েছিল তখন তার বিরুদ্ধে। অথচ ১০০ বছর আগে কিছুই হয় নি।
ভাষা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়। সেই পরিবর্তনের ধারাতেই এক সময়ের বুলি আর এক সময়ের গালিতে রুপান্তরিত হয়ে যায়। মাগী শব্দটার থেকে বড় উদাহরন মনে হয় আর নেই।
আমরা প্রকৃতির খেয়ালে কেউ পুরুষ বা কেউ নারী। আমাদের ১০০ বছর আগের পরিভাষায় মাগ আর মাগী। আবার সেই প্রকৃতির খেয়ালেই কেউ কেউ জন্মগ্রহন করেন, যারা পুরুষও না, আবার মহিলাও না। তারা বৃহন্নলা। প্রচলিত অর্থে তাদের আমরা হিজড়া বা খুব শুদ্ধ করে হিজড়ে বলি। মাগ বা মাগী শব্দদুটোর মতো হিজড়া বা হিজড়ে শব্দটাও হয়তো খুব স্বাভাবিক সম্মানার্থে ব্যাবহৃত হতো এক সময়, কিন্তু এখন সেটা গালি। এখন এটা ব্যাবহৃত হয় চরম তুচ্ছার্থে বা অপমানার্থে।
কিন্তু তাদের আমরা তুচ্ছ করি কেন? প্রতৃতি তাদের নারী বা পুরুষ কোন গোত্রে ফেলেনি বলেই কি? মেডিকেল সায়েন্সের সূত্র ধরে বলা যায়, লিঙ্গ নির্ধারন করে বাবা, তার মানে ক্লীব হবার দায়টাও বাবার। এই রকম একটা সন্তান জন্মগ্রহনের দায় ভার কেউ নিতে চায় না, তাই জন্মের পর পর তারা হয় পরিত্যাক্ত। তাদের ঠাঁই হয় সমাজের নিকৃষ্টতম স্থানে, অস্বাভাবিক যৌনকর্মী হিসেবে। নারী যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য সেবার জন্য এখন রাষ্ট্র সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে, কিন্তু এই বৃহন্নল্লা শ্রেণীর সেই সুযোগটুকুও নেই, বিশেষ করে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে। অথচ ওরাই যৌনকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ শ্রেণী।
কোথাও ঠাঁই তো হয়ই না, কোন ন্যুনতম সম্মানজনক পেশাগত জীবন যাপন করাও সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। যেখানেই যাক না কেন, তাদের কপালে কেবল অবহেলা আর অপমান। সরকারী ভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে তাদের পূনর্বাসন করা হবে কবে, বা কিভাবে, সেটা আমাদের জানা নেই। তবে এইটুকু বলতে পারি, আমাদের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করার পূর্ণ অধিকার তাদের আছে। আছে অন্য সবার মতো শিক্ষা লাভ করে বড় কিছু হবার স্বপ্ন দেখার অধিকার। কিন্তু যারা জন্মের পর থেকে তাদের জন্ম দাতা-জন্মদাত্রীদের কাছ থেকেই চরম অবহেলা আর অপমান পেয়ে পথে পথে ঘুরে বেরাচ্ছে, অন্যরা যে আর কতোটুকু দিবে সেটা আর উল্লেখ নাই বা করলাম।
আমরা তাদের জন্য হয়তো কিছুই করতে পারবো না। একজন বৃহন্নলাকেও হয়তো স্বাভাবিক জীবনেরত স্বাদ দেবার সামর্থ আমাদের নেই, কিন্তু ন্যুনতম সম্মান দেখানোর সামর্থও আমাদের নেই, সেটা একদমই মিথ্যে কথা; এটা অনেকে জানেন, অথবা জানেন না সেটা হলো তাদেরকে এখনকার উপযোগী একটি সুন্দর ও সম্মানজনক নামে সম্বোধন করা, আমরা চাইলেই পারি।
হিজড়া শব্দটা এক সময় স্বভাবিক শব্দ হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এখন কেবলি একটি অপমানজনক শব্দ। কিন্তু প্রজননে অক্ষম এই জনগোষ্ঠীর কি আর কোন সুন্দর বা গ্রহনযোগ্য উপাধি নেই? নিশ্চই আছে। খুব সুন্দর আর ধর্মীয় ভাবে সম্মানিত নাম সেগুলো। এই যেমন বৃহন্নলা। মহাভারতে পান্ডবদের ১২ বছরের বনবাস কাটিয়ে ১ বছরের অজ্ঞাতবাসের সময় অর্জুন নপুংশক হিসেবে বৃহন্নলা নাম ধারন করেন। আর একটি নাম আছে, কিন্নর। স্বর্গের গায়ক/গায়িকা দের বলা হয় কিন্নর বা কিন্নরী। তাদেরও প্রজননের ক্ষমতা নেই। দেবতাদের গান শুনিয়ে আনন্দদান করেই তাদের জীবন কেটে যায়। আমাদের এই বৃহন্নলা শ্রেণীর জীবনও এভাবেই কাটে। মানুষের বিনোদন দিয়েই পার হয়ে যায় তাদের জীবন, উলটো স্বাভাবিক মানুষ বিনোদনের বিনিময়ে তাদের দিয়ে আসে মরন ব্যাধী। আমরা তাদের কিন্নর নামেও ডাকতে পারি।
আসল কথা হলো তাদের অপমানজনক হিজড়া সম্বোধন না করে আমরা তাদের বৃহন্নলা বা কিন্নর বলে ন্যুনতম সম্মানটা দিতে পারি।
বৃহন্নলারা তো কোন অপরাধ করেনি, তাহলে আমরা কেন তাদের প্রতিনিয়ত বিনা অপরাধে অপমান করে যাবো, শাস্তি দিয়ে যাবো? রাস্তার ঘেয়ো নেড়ী কুকুরও তো তাদের থেকে বেশী আদর পায় প্রজনক্ষম মানুষের কাছ থেকে, তাহলে প্রকৃতির খেয়ালে প্রজননে অক্ষম মানুষ পাবে না কেন??