মা রুমে এসে জিজ্ঞাসা করলো -
- কিরে এখনো ব্যাগ গোছানো হয়নি ?
- এই তো মা , আর একটু ।
- গাড়ি কয়টায় ?
- ১০ টায়
- কি বলিস ? এখন বাজে সারে নয়টা ।
- কি বলো !! মাত্র না দেখলাম ৮ টা বাজে !
- তোর মাথা খারাপ , নইলে তোর ঘড়ির মাথা খারাপ ।
- হ্যা , তাই তো । দুইটার ই মাথা খারাপ ।
- তারাতারি বের হ , নইলে গাড়ি মিস করবি ।
- হ্যা মা , টাকা টা তারাতারি দাও ।
টাকা টা মার কাছ থেকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম , রাস্তায় আসতেই রিক্সা পেয়ে গেলাম । ২০ টাকা ভাড়া মিটিয়ে বললাম মজমপুর শ্যামলী কাউন্টার যাবো ।
রিক্সাওয়ালাকে বললাম -
- মামা খুব দ্রুত যেতে হবে , ডিসি কোর্ট হয়ে যাবেন ।
- না মামা ওই দিকে যাওয়া যাবে না
- কেন ?
- রাস্তার কাজ চলছে ।
- ওহ শিট ! তাহলে ?? আমাকে তো ২০ মিনিট এর মধ্যে পৌঁছাতে হবে ।
- চৌরহাস হয়ে যাবো ?
- না , ওই দিকে টাইম বেশি লাগবে । থানার মোড় হয়ে যান।
- ১০ টার ট্রেন আছে , আটকা পড়তে পারেন ।
- ট্রেন সব সময় লেট করে , আপনি এই দিকেই যান ।
- ঠিক আছে মামা ...
রিক্স চলছে , আমি টেনশনে আছি গাড়ি মিস করার ভয়ে । পকেট থেকে সিগারেট এর প্যাকেট টা বের করলাম । না , ধরালাম না ফেলে দিলাম । টেনশন এ মাথা ঠিক নেই । আজকের মধ্যেই ঢাকা পৌঁছাতে হবে । ১০ টার পর আর কোন গাড়ি নেই । রিক্সা মাত্র জেলখানার মোড় পাড় হলো । রিক্সাওয়ালার কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে , লাল ঘাম ; কিন্তু রিক্সা এগোচ্ছে না । রিক্সা এগোচ্ছে না ,নাকি আমি থেমে আছি বুঝতে পারছিনা তখন । আমি মামার পায়ের দিকে তাকায় , পায়ের রগ গুলো কেপে কেপে উঠছে । তবুও রিক্সা এগোচ্ছে না ।
- মামা একটু জোরে চালান, জোরে ...
- মামা চালাচ্ছিতো ...
কলেজ মোড় পাড় হলাম , রিক্সার গতি আরো কমে গেছে । সত্যি রিক্সার গতি থেমে গেছে । রিক্সাওয়ালা কিছু বলল আমাকে -
- মামা মনে হচ্ছে তো ট্রেন আইছে
- কি বলো ???
- হ মামা , সামনে দেখছেন না রিক্সার লাইন বারছে , গেট পরে গেছে । গেট তো ১০ মিনিট এর আগে আর খুলবে না ।
- ১০ টা বাজতে আর আর দশ মিনিট বাকি । এখন !!
- কি করব বলেন ? আমি কইছিলাম চৌরহাস হয়ে যাইতে । তাইলে ১০ দশ টার মধ্যে পৌঁছাইতে চেস্টা করতাম ।
এই কথা গুলো বলতে বলতে ৫ মিনিট শেষ , বাকি ৫ মিনিট । আমি রিক্সাওয়ালা কে ভাড়া দিয়ে রিক্সা থেকে লাফ দিলাম , ছুটে গেলাম রেইলগেট এর দিকে ।রেইলগেট পার হলাম , ওই পাশের রিক্সা গুলো আর যেতে যেতে চায় না । কি করব তখন বুঝতে না পেরে রেইল লাইন ধরে দৌড়ানো শুরু করলাম । ব্যাগ কাঁধে নিয়ে , ব্যাগ টাও আজ ভারি হয়ে গেছে , মনে হচ্ছে পিঠে ২০ কেজি ওজন এর পাথর কেও বেধে দিয়েছে । আমি পৌছালাম কাউন্টারে , ঘড়িতে তখন ১০ টা ৫ বাজে । গাড়ি ছেরে চলে গেছে । আমি পাথর হয়ে গেলাম , কপালের ঘাম গুলো তখন কান্না হয়ে ঝরতে শুরু করেছে ।
-
রাত ৮ টায় শাহেদের জার্মানির ফ্লাইট , আমাকে তার আগেই শাহেদের কাছে পৌছাতে হবে । শাহেদের কাছে আমার জন্য রাখী কিছু একটা দিয়েছে , আমাকে বলছে না শাহেদ ।গত কালকে শাহেদের ফোনের কথোপকথন -
- রকি , কাল আমার ফ্লাইট
- মানে ? কাল ফ্লাইট আর আজকে বলো কেন ?
- আমিও জানতাম না , হুট করে মামা ফোন দিয়ে বলল ।
- আমি তাহলে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া আসলাম কেন ? দেখা হবেনা ?
- আমি আজ রাতের গাড়িতেই ঢাকা চলে জাচ্ছি , দেখা মনে হয় হবেনা । কিন্তু রকি তোমার সাথে তো আমার দেখা করার দরকার ।
- কেন ?
- রাখীর সাথে দেখা হয়েছিল ।
- মানে ? কোথায় ?
- দুই দিন আগে বাজারের মধ্যে ।
- নাম্বার নিয়েছ ?
- নিয়েছি , কিন্তু দিতে মানা ।
- আচ্ছা দিতে হবে না , আমার কথা কিছু বলেছে ?
- তোমার কথা কিছু বলেনি , বলল রাছেল কে নিয়ে সে ভালই আছে ।
- ওহ ( আমি শাহেদের এই কথা গুলো শুনে আর বেশি ক্ষন ফোন ধরে রাখতে পারছিলাম না )
- রকি দেখা কিভাবে করবে ? আর তোমার জন্য গিফট আছে ।
- হুম । কি গিফট ?
- আছে । রাখী দিয়েছে তোমাকে দেওয়ার জন্য ।
- এই না বললে আমার কথা কিছু বলেনি ?? ( আমি আবার হুশ ফিরে পেলাম )
- ওই দিন কিছু বলেনি , আজ আবার দেখা হয়েছিল ।
- কি বলল তারাতারি বলো ।
- তেমন কিছু না , একটা কাগজের মধ্যে কি যেন দিয়েছে ।
- শাহেদ আজ রাতের টিকিট পাওয়া যাবে ? তুমি কোন গাড়িতে টিকিট করেছো ?
- জানিনা । আমি খুব কষ্টে একটা টিকিট পেয়েছি । আর আমার গাড়ি মেহেরপুর থেকে চুয়াডাঙ্গা হয়ে যাবে ।
- ওহ শিট ! আমি দারাও কুষ্টিয়া কাউন্টার এ ফোন দিয়ে দেখি টিকিট পায় কিনা !
- ওকে , পেলে জানাও ।
আমি কুষ্টিয়া কাউন্টার এর প্রত্যেকটা বাস কাউন্টার এ ফোন করলাম রাতের টিকিট এর জন্য । সব গুলো থেকে না শব্দ শুনে হতাশ হলাম । শেষ মেশ শ্যামলি তে ফোন দিলাম তারা জানালো রাতের কোন গাড়িতে কোথাউ সিট হবে না । তিনি জানালেন সকাল ১০টার একটা গাড়িতে সিট দিতে পারবেন । আমি একটু ভেবে রাজি হয়ে গেলাম । ১০টার গাড়িতে গেলে ৮টার মধ্যে এয়ারপোর্ট এ পৌছতে পারব । টিকিট বুকিং দিয়ে শাহেদ কে জানিয়ে দিলাম ।
-
আমি কাউন্টার এ থ মেরে দারিয়ে আছি , কাউকে কিছু বলব সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি । এক জন একটি কথা শুনে হুশ ফিরলো আমার । কেউ একজন কাউন্টার ম্যানেজার কে বলছে ''আমি সাড়ে দশটার মেহেরপুর থেকে আশা গাড়ির টিকিট বাতিল করবো'' । কিন্তু ম্যানেজার টিকিট বাতিল করতে নারাজ । ম্যানেজার বললেন ''' এখন আমি এই টিকিট কি করবো ? আমাদের লস হবে , কিছুতেই বাতিল করতে পারব না'' । বেশ কিছুক্ষন তাদের তর্ক-বিতর্ক চলল । ম্যানেজার কিছুতেই টিকিট ফেরত নিল না । আমি তখন ভাবলাম আমিই তো এই টিকিট টা নিয়ে ঢাকা যেতে পারবো । সাথে সাথে লোকটিকে টিকিট আমি নিব জানালাম । টিকিট ৪৫০টাকা , উনি বললেন ৪০০ টাকা দিলেই আমি খুশি ।সিট নাম্বার সি-৩ , নিয়ে নিলাম । মাথার উপর থেকে মনে হল পাথর পরে গেল । খুব খুশি লাগছিল । সাহেদ কে আবার ফোন করে জানিয়ে দিলাম ওর সাথে এয়ারপোর্ট এ দেখা হবে ।
সকালে নাস্তা না করেই বের হয়েছি , যেহেতু গাড়ি আসতে এখনো ১০ মিনিত বাকি তাই পাশের হোটেল এ নাস্তা করে নিলাম । নাস্তা করা শেষ হতেই গাড়ি চলে আসলো । এক প্রকার নাচতে নাচতেই গাড়িতে উঠলাম । ভাবনা আমার তখন একটা শাহেদের সাথে দেখা হচ্ছে , এর থেকেও বেশি ভাবছি রাখি আমার জন্য কি দিতে পারে ! যার সাথে দের বছর কোন যোগাযোগ নেই । যাকে আমি জীবনের থেকেও বেশি ভালবাসি তার থেকেও বেশি ঘৃণা করে রাখি আমাকে । ও আমার জন্য কি দিতে পারে ! টিকিট হাতে নিতে সিট খুজতে খুজতে বাসের মধ্যে ঢুকে গেলাম । আবারো একবার থমকে গেলাম , দারিয়ে গেলাম আবার । বিশ্বাস হচ্ছে চোখের সামনে কি ! তবুও এগিয়ে গেলাম -
- তুমি ?
- হ্যা আমি । কিন্তু তুমি এই বাস এ ?
- হ্যা ঢাকায় যাচ্ছি । সি-৪ তোমার ?
- হ্যা । কেন ?
- আমার সি-৩ ।
- তো দারিয়ে কেন ? বসো । বাস ছেরে দেবে ।
- হ্যা , কিন্তু তুমি ? তোমার পাশে বসবো ?
- কেন আমি কি জীন , যে বসতে ভয় পাচ্ছো ?
- না , মানে তুমি তো আমাকে ...
- কি তোমাকে ?? ঘৃণা করি ? আজ না হয় নাইবা করলাম । বসো ।
বসে পড়লাম । কেমন আছ জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গিয়েছি । এমনটা হয়ে ছিল যেদিন ওর সাথে প্রথম কথা বলি । সেদিন কেমন আছো জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গিয়েছিলাম । দুজনই চুপচাপ বসে আছি , মাঝে মাঝে দুজন দুজন এর দিকে তাকায় কিন্তু কেউ কথা বলি না । প্রথম দিন এমন করেছিলাম । প্রথম দিন ? সেটা আরো ৪ বছর আগের কথা । জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম -
- কোথায় যাবে ?
- খালার বাসায় । উত্তরা । তুমি ?
- এয়ারপোর্ট ।
- ওখানে কেন ? দেশের বাইরে চলে যাবে ?
- না , সাহেদ জার্মানি যাবে । ওকে বিদায় দিতে । তোমার সাথে সাহেদের দেখা হয়েছিল ?
- কই না তো ।
- শাহেদ বলছিল !
- বললে হয়েছে ,তো ?
- কিছুনা । তোমার পড়াশোনা কি অবস্থা ?
- এডমিশন দিচ্ছি , কি হবে জানিনা ।
- গত বার হয়নি ?
- না, ভাগ্য খারাপ ।
- এবার হবে । রাছেল কেমন আছে ?
- রাছেল !! ওর কথা কেন ?
- সরি । ওর জন্যই তো আমি তোমার কাছে আজ মূল্যহীন ।
- ভাল আছে , বাদ দাও ।
- কি বাদ ?
- অন্য কিছু বলো ? তোমার কি খবর ?
- চলছে । এখনো ভাবি তোমাকে নিয়ে ।
- কি দরকার ভাবার ? ভেবো না আর ।
- আচ্ছা ভাব্য না । রাখী, মনে পড়ে ?
- কি ?
- তুমি বারবার জানতে চাইতে আমার ইচ্ছেগুলোর কথা ? আঙ্গুল নিয়ে খেলতে খেলতে জানতে চাইতে কি চাই তোমার কাছে? তোমার কপালের সামনে পড়ে থাকা এলোচুলগুলো কানের পেছনে সরিয়ে দিয়ে প্রতিবারই বলতাম- "তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, শুধুই তোমাকে চাই!"
- কি লাভ এগুলো এখন মনে করে ? আচ্ছা ভাদ্রের রৌদ্দুরে দু'হাত পেতে চাইতাম শরতের কাশফুল , মনে আছে তোমার ?
- কেন থাকবে না ? কি সামান্য এক আব্দার ছিল তোমার ! দুহাত ভরে দিতে চাইতাম , দিতাম । আমার দু'চোখ ঢেকে তোমার হাত ছুঁইয়ে দিতে এ হাতে,মুখে ।
- হুম । তুমি দুচোখ বন্ধ করে থাকতে , আমি তোমার মুখের উপর সেগুলো ঘোরাতাম ।
- আমি কিছুই ভুলিনি । তুমি হয়ত ভুলে গিয়েছ ।
- মনে রাখতে চাইনা আর । তোমার পদ্মা নদীর পাড়ের কথাটা মনে আছে ?
- হ্যা তুমি নদীটা চাইতে আমার কাছে , সব সময় আমার পাশে থেকে নদীটার সাথে মিশে জেতে চাইতে । তোমার নিবিড় আলিঙ্গনে তোমার কল্পনার মোহনায় বিচঞ্চল নদীর স্রোতটাকে বইয়ে দিতে আমার ধমনীতে... অদ্ভুত এক শিহরণে!
- থামো ,থামো প্লিজ । আর শুনতে চাইনা । কখনো জানতে চেয়েছো আমি কেমন আছি ? ওই শিহরণের গুলোর শূন্যতা আমি এখন অনুভব করি কিনা ? এখনো তোমার কাছে দুহাত ভরে কাশফুল গুলো চাই কিনা ?
- তোমার চাওয়া গুলো সামান্য , আমার মত গভীর ছিল না । এখন এসব বাদ দাও ।
- কেন বাদ দেব ?
- রাখি কোন প্রশ্নই জানতে চেয়ো না আর... জানানোর কিছু-ই নেই বাকি। কি জবাব দেবো বলো আজ- যখন মুঠো খুলে দেখি একটি মেঘের কণাও নেই... ছিল না যেন কখনো ? হৃদয়ের প্রান্তরের মতো খাঁ-খাঁ শূণ্যতা সমস্ত হাত জুড়ে ? দু'কান চেপে ধরে ঠেকাই একাকীত্বের তীব্র চিৎকার... "ভালোবাসি" শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয় না একটি বারও এ অন্তরে!
- ও তাহলে তুমি চাওয়া না আর আমাকে ?
- রাখি !!
- কি ?
- খুব কষ্ট হয়... তুমি চলে গেছো...এই ভেবে , সাথে নিয়ে গেছো চাওয়াগুলো,পাওয়াগুলো... আর রেখে গেছো কিছু ইচ্ছের অকাল মৃত্যু !!
- কেন ? এই আমি কি তাহলে ? আমি মরে গিয়েছি ?
- না !!! চোখে পানি কেন ?
- কখন থেকে বসে আছি , একবার হাত অ ধরলে না ।
- তুমি ?? কি বলছো এসব ??
হটাৎ গাড়ির মধ্যে চিৎকার , কিছুই বুঝতে পারলাম না । সুধু কানে আসলো গাড়ির ব্রেক ফেইল !! মুহূর্তেই সব কিছু অন্ধকার । এর পর কি হলো জানিনা !
-!!!
কানে মায়ের ডাক শুনছি -
- রকি ! রকি
- !!
- রকি ! রকি
- হুম ! মা ??
- হ্যা , তুই না ঢাকায় যাবি আজ ?
- হ্যা , কিন্তু রাখি !!
- রাখি ! আবার রাখির কথা ?
- না মা , কিছু না । কয়টা বাজে ?
- সারে ৮টা , গাড়ি কয়টায় ?
- ১০টায় । মা নাস্তা রেডি করো আমি আসতেছি ।
দেরি করলাম না আর , নাস্তা করে ৯টার মধ্যেই বের হলাম । রাস্তায় কোন জ্যাম ছাড়ায় কাউন্টারে পৌছে গেলাম । তখন ঘোড় ভাংলো আমার রাতে সপ্ন দেখেছি । সত্যি ঘটনার উপর অবাস্তব একটি স্বপ্ন । স্বপ্ন টা স্বপ্নেই বেঁচে থাক ,স্বপ্ন গুলো কে মরতে দিতে নেই । মরতে দিলে যে ভালোবাসা মরে যাবে । সে দূরে আছে দূরে থাক , বেঁচে আছে বেঁচে থাকুক । আমি বরং তার দেওয়া শেষ উপহারটা নিতেই ১০টার গাড়িতে উঠে পরি ।