সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানি ক্যাসপারস্কি’র ২০১৫ সালের তৃতীয় এবং চূড়ান্ত ল্যাব রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমান সময়ের সিকিউরিটি থ্রেটের বেশীরভাগই মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক আর মোবাইলওয়্যারের সবচেয়ে বেশী হার নিয়ে এক নম্বর ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ (প্রতি ৪টি ডিভাইসের অন্তত ১টি এখানে ভাইরাসাক্রান্ত)।
এছাড়াও, সম্প্রতি প্রকাশিত এই ‘আইটি থ্রেট ইভোলিউশন ইন কিউ থ্রি টু থাউজেন্ড ফিফটিন’ রিপোর্ট অনুযায়ী ২১৩টি দেশের মধ্যে কম্পিউটারে ভাইরাসের আক্রমণের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯তম। আর, এসব ভাইরাসের ৬৪.৪৪ শতাংশই স্থানীয় এবং আঞ্চলিক ভাইরাস, সে হিসেবে আঞ্চলিক ভাইরাস সংক্রমণের দিক থেকেও সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ।
দেশের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সিংহভাগ মোবাইল ইউজার হওয়ায় এতে ব্যক্তিগত তথ্য চুরিসহ যে কোনো সময় হুমকির সম্মুখীন হতে পারে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা – আর এরই প্রেক্ষিতে আমাদের আজকের টপিক ‘মোবাইলওয়্যার’।
‘আইলো আইলো আইলোরে ...’
বিবিসি বাংলা’র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম বহনযোগ্য দূরালাপনি হিসেবে ‘পেজার’ এলেও তাতে কেবল ক্ষুদে বার্তাই পাঠানোর সুযোগ ছিল। মটোরোলা কোম্পানির দুই কর্মী – ড. মার্টিন কুপার এবং জন ফ্রান্সিস মিশেল - আধুনিক মোবাইল ফোন আবিষ্কারের ২০ বছর পর ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে তা নিয়ে আসে এশিয়ার প্রথম মোবাইল অপারেটর হাচিন্সন এবং এতে সার্বিক সহায়তা প্রদান করে তৎকালীন বিটিএল তথা 'বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড'।
হাচিন্সন এবং বিটিএল সেসময় রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় অ্যাডভান্সড মোবাইল ফোন সিস্টেম তথা এএমপিএস প্রযুক্তি স্থাপন করলে ঢাকার মানুষ প্রথম কাউকে ঘরের বাইরে তারবিহীন টেলিফোন কানে ঠেকিয়ে কথা বলতে দেখে!
অন্যদিকে ১৯৮৯ সালে লাইসেন্স নিলেও বেশ দেরীতে, হাচিন্সনের কয়েকদিন পর, কোড ডিভিশন মাল্টিপল এক্সেস তথা সিডিএমএ নামক নতুন প্রযুক্তি নিয়ে প্রকাশ্যে আসে সিটিসেল। এটিই এখন পর্যন্ত দেশের একমাত্র সিডিএমএ মোবাইল অপারেটর হলেও পরে একে একে চালু হয় পাঁচটি গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল তথা জিএসএম প্রযুক্তির মোবাইল কোম্পানি।
এরা হচ্ছে- রবি (একটেল নামে ১৯৯৭ সালের গোড়ার দিকে চালু হয়ে ২০১০ সালে মালিকানা বদল হয়), একই বছরের ২৬ মার্চ থেকে যাত্রা শুরু করা গ্রামীণফোন, বাংলালিংক (সেবা টেলিকম নামে ১৯৯৯ সালে চালু হয়ে ২০০৪ সালে মালিকানা বদল হয়), ২০০৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি টেলিটক এবং নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের মালিকানাধীন এয়ারটেল (ওয়ারিদ নামে ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করে ২০১০ সালে মালিকানা বদল হয় এবং বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে রবি’র সঙ্গে এর একীভূত হওয়া)।
হাইস্পিড ওয়্যারলেস ইন্টারনেটসহ সিটিসেলের নিয়মিত সিডিএমএ সেবার পাশাপাশি জিএসএম মোবাইল কোম্পানিগুলোর চতুর্থ প্রজন্মের (ফোর জি) মোবাইল সেবা প্রদানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশে তৃতীয় প্রজন্ম তথা থ্রিজি সেবা প্রদান করছে অবশিষ্ট পাঁচটি মোবাইল কোম্পানি।
হাতে হাতে ডাউনলোড
বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি)-এর সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী অক্টোবর-২০১৫ পর্যন্ত দেশে মোট মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির উপরে (সরকারি হিসেবে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার)।
উল্লেখ্য, দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটির উপরে, এবং তাদের শতকরা ৯৭ ভাগই ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন কোনো না কোনো মোবাইল ডিভাইস থেকে।
মূলত, থ্রিজি’র মাধ্যমে দ্রুতগতিতে ব্রাউজিং সেবা পাওয়া ও স্মার্ট ফোনের মূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসায় হাতে হাতে ডাউনলোড তথা ইন্টেরনেট-এর এই বিপ্লব সম্ভব হয়েছে। দেশীয় মালিকানাধীন সিম্ফনি, ওয়ালটন ইত্যাদি মোবাইল কোম্পানির চীন থেকে আমদানিকৃত সুলভ স্মার্ট ফোনের পাশাপাশি এতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে ভারতের মাইক্রোম্যাক্সসহ বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড অ্যাপল, মাইক্রোসফট, সামসাং ও এইচটিসি ইত্যাদির বাংলাদেশে স্থায়ী বিক্রয় ও সেবাকেন্দ্র স্থাপন।
অন্যদিকে, স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেটের সিংহভাগ ব্যবহারকারী টিনেজারদের একটা বড় অংশ ‘ইন্টারনেট মানেই ফেইসবুক’ ধারণা ভেঙ্গে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে অনলাইন মার্কেটিং, ফ্রিল্যান্সিং এবং ব্লগিং ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার মতো উল্টো পথে হেঁটে!
তবে, গঠনমূলক কাজের পাশাপাশি তরুণদের আরেক আগ্রহের পরিধি বোধকরি ডাউনলোডিং – হোক সে রক মিউজিক কিংবা হার্ডকোর পর্ন মুভি – চাহিবামাত্র হাতের নাগালে পাওয়ার সুবিধা থেকেও দেখা যায় অনেককেই মোবাইল ইন্টারনেটনির্ভর হতে, আর এর সুযোগেই মূলত মোবাইলে বাসা বাঁধে ভাইরাস।
ম-তে মোবাইলওয়্যার
সহজ কথায় মোবাইল কনটেন্টে সংযুক্ত ভাইরাসই মোবাইলওয়্যার। সাধারণত মোবাইল থেকে কোনো ওয়েবসাইট ব্রাউজ করার সময় ‘নিষিদ্ধ’ বিজ্ঞাপন, সিস্টেম স্লো বা এধরণের সতর্কবার্তা প্রদর্শন, কোনো গান বা ভিডিও খুঁজতে গেলে ভিন্ন ফরম্যাটের ফাইল দেখানো বা তা নিজ থেকে ডাউনলোড হতে শুরু হওয়া ইত্যাদি মোবাইলওয়্যারের কারণেই হয়ে থাকে।
চলুন তাহলে দেখে নেই কী কী ক্ষতি করে এসব মোবাইলওয়্যার।
বিজ্ঞাপন হচ্ছে মোবাইলওয়্যারের সবচেয়ে বড় অংশ। আপাতঃ নিরীহদর্শন এসব বিজ্ঞাপন আপনার কোনো ক্ষতি করছে মনে না হলেও একবার কোনোভাবে ক্লিকড হলেই কিন্তু সাড়ে সর্বনাশ!
ফোন রুট করা থেকে শুরু করে সিস্টেম এক্সেস মানে আপনার ডিভাইসে যে কোনো ফাইল রিড, রাইট কিংবা রিরাইট, সব ক্ষমতাই আছে এসব ‘গোবেচারা’ বিজ্ঞাপনের – আশার কথা মানসম্পন্ন সব এন্টিভাইরাসই এখন মনোযোগ দিচ্ছে নিজ নিজ সিকিউরিটি টুলে অ্যাডব্লকার সংযুক্তিতে। শুধু তাই নয়, ২০১৫ সালের সবচেয়ে ক্ষতিকর ২০টি মোবাইলওয়্যারের অর্ধেকেরও বেশী অ্যাডওয়্যার – উল্লেখ করে আরেক সিকিউরিটি কোম্পানি এভিজি শুধুমাত্র অ্যাডওয়্যার প্রতিরোধে বিশেষায়িত এন্টিভাইরাস নিয়ে আসছে!
মজার বিষয় এই যে আপনি এসব অ্যাডে ক্লিক না করলেও কিন্তু যারা এসব ছড়ায় তাদের কোনো ক্ষতি নেই – কারণ, তারা ঠিকই বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় স্রেফ আপনি পকেটের পয়সায় কেনা এমবি খরচ করে এসব বিজ্ঞাপন ‘দেখেন’ বলে।
তাই, এদের প্রতিহত করতে ও আপনার ইন্টারনেট ডাটা’র অপচয় রোধ করতে অবশ্যই মোবাইলে ব্যবহার করুন অ্যাডব্লকার বা অ্যাডওয়্যারসমৃদ্ধ যে কোনো ভালো মানের এন্টিভাইরাস।
এবার আসি অনুপাতে কম কিন্তু অন্যতম ভয়াবহ মোবাইলওয়্যার – এসএমএস ট্রোজান - নিয়ে আলোচনায়।
আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, অনলাইনে নিরাপদ থাকার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি কোনটি – জানি আপনি বলবেন ‘টু স্টেপ ভেরিফিকেশন’ তথা দুই ধাপ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এতে কোনো কারণে হ্যাকার আপনার কোনো একাউন্টের পাসওয়ার্ড জানলেও তাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না পাসওয়ার্ড দেয়ার পর আপনার মোবাইলে আসা তাৎক্ষণিক প্রবেশ সংখ্যাটি কেউ জানতে পারছে।
কিন্তু, শুনে অবাক হবেন যে এসএমএস ট্রোজান-এর কাজই হচ্ছে ভিক্টিমের মোবাইলে এসএমএস আসামাত্র তা আগে থেকে সেট করে রাখা নম্বরে ফরোয়ার্ড করা!
মানে বুঝতেই পারছেন – পাসওয়ার্ড চেঞ্জ থেকে শুরু করে ব্যাংকের এসএমএস বা কেউ যেন আড়ি পাততে না পারে ভেবে কাউকে এসএমএস পাঠিয়ে জানাতে বলা কোনো কথা- সবকিছুই এখন চাইলে জানতে পারছে হ্যাকাররা। তাই, সবচেয়ে ভয়াবহ এই মোবাইলওয়্যার প্রতিরোধে সাবধান হওয়া প্রয়োজন এখনই।
এই মোবাইলওয়্যারটি সাধারণত আসে সিস্টেম বা র্যাম স্লো হয়ে গেছে শীর্ষক সতর্কতা, ব্যাটারির ক্ষমতা বাড়ানোর টিপস বা সাজেস্টেড অ্যাপ, কোনো গান বা ভিডিও’র খোঁজ করলে হুবহু সেই ফাইলটির নামে অন্য ফরম্যাটের ফাইলসহ অটোমেটিক ডাউনলোড হওয়া সফটওয়্যার থেকে। তাই এসবে ক্লিক করার আগে ঠিকঠাক জেনে-বুঝে ক্লিক করুন।
বুদ্ধি খাটান, কাজে দেবে
মনে রাখবেন, আপনার ডিভাইসের অপারেটিং সিস্টেমের কোনো নতুন ভার্সন যদি এসেও থাকে, আর আপনি যদি তা ব্যবহার করতে সক্ষম হয়ে থাকেন তবে তা অবশ্যই নিজে নিজেই আপডেটেড হবে (সেক্ষেত্রে আপনাকে কেবল ওয়াইফাই যংযুক্ত হতে অনুরোধ জানাবে, এর বেশী কিছু নয়)।
কিংবা, আপনার মোবাইলে বা ট্যাবে যে ব্যাটারিটি দেয়া আছে – সেটি যেভাবে সর্বোচ্চ কাজ করতে পারবে কোম্পানি নিজে থেকেই সেভাবে সেট করে দিয়েছে। নতুন ব্যাটারি কেনা ব্যতীত কোনো সফটওয়্যার দিয়েই তার ক্ষমতা আর বাড়ানো সম্ভব নয়।
তাই, ইন্টারনেটে থাকাকালীন এ ধরণের কোনো সতর্কতা দেখলে মনে রাখবেন বিষয়টি স্রেফ ধোঁকা, ফাঁদে পা দেবেন না।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে ওই পেজটি কেটে দেয়া, না পারলে হোম বাটন প্রেস করে বেরিয়ে যান। পরে আবার ব্রাউজার ওপেন করে গুগল বা আস্থাভাজন ওয়েবসাইট অ্যাড্রেস নিজে টাইপ করে প্রবেশ করে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করুন।
আরেকটি কথা, অনেক সময় কোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করামাত্র নিজ থেকে কিছু ফাইল ডাউনলোড শুরু হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। ডাউনলোডশেষে ফাইল ম্যানেজার অপশনে গিয়ে ফাইলটি খুঁজে বের করে ডিলিট করে অবশ্যই তাৎক্ষণিক ডিলিট করে দিতে হবে।
সাবধান, ফাইলটি ভুলেও খুলে দেখতে যাবেন না!
আর, মনে রাখুন ওয়েবসাইটটির নাম – এরপর যত বড় প্রয়োজনই হোক না কেন, ভুল করেও আর এই সাইটে পা দেবেন না।
মনে রাখবেন – চতুরতায় ভরা এই তিন ডব্লিউ’র ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে আসলে আপনি, আমি – আমরা কেউই নিরাপদ নই। মোবাইলের টাচপ্যাডে হাতের আঙুলের একটি স্পর্শে যেমন পুরো পৃথিবীর উন্মুক্ত জ্ঞানভাণ্ডার এসে ধরা দেয় ফোনের ছোট্ট স্ক্রিনে, ঠিক তেমনি সামান্য অসতর্কতায় পুরো বিশ্ব জেনে যেতে পারে আপনার একান্ত গোপন কোনো কিছু।
তাই, আপনার মোবাইল বা ট্যাবে নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে অবশ্যই এন্টিভাইরাস ব্যবহার করুন। তবে, মাথায় রাখবেন তথাকথিত ফ্রি এন্টিভাইরাস কিন্তু সমস্যা কমায় না, বাড়ায়! তাই, বাজারে গিয়ে দেখেশুনে, যাচাই করে যে ব্র্যান্ডের এন্টিভাইরাসে দেখবেন আপনার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলি পাচ্ছেন – সে ব্র্যান্ডের এন্টিভাইরাসেরই পেইড ভার্সনটি কিনে ব্যবহার করুন।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪