একটা সময়, যখন বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ ছিল বিটিভি, তখন শুক্রবার বিকেল মানেই বসতো বাংলা ছায়াছবির জমজমাট আসর। আর, মারদাঙ্গা ছবি বলতে অবধারিতভাবে নায়ক থাকতো জসিম (আবদুল খায়ের জসিম উদ্দিন, ১৯৫০-১৯৯৮)।
সেসময় প্রায়ই দেখতাম মুভির শুরুতে জসিম সৎ ও আদর্শবান পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় থাকলেও মাঝে এসে কাহিনীর মারপ্যাঁচে কীভাবে কীভাবে যেন চলে যেত শ্রীঘরে, মানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কোনো এক নির্জন কক্ষে!
যদিও এটা কখনোই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল না - আইজি বা কমিশনার চরিত্র করা প্রবীর মিত্র অবধারিতভাবে দুই-তিন সিকোয়েন্স পরেই জসিমকে চান্স দিতেন ‘প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে আনার’ অথবা মিজু আহমেদ বা এই টাইপের কেউ যদি হতেন পুলিশের সেই বড় কর্তা তাহলে জসিম করে বসতো বিদ্রোহ!
দুটোরই পরের ঘটনা অবশ্য এক - জেলব্রেক!!
এখান থেকেই মূলত শুরু হতো আসল খেলা - শাদা শার্ট, শাদা প্যান্ট, শাদা জুতা, শাদা মুজা (ক্ষেত্র বিশেষে সাদা বেল্ট পর্যন্ত) পরিহিত জসিম হাজির হতো ভিলেনদের আখড়া তথা কোনো বার বা নাইট ক্লাবে। আর, সেখানে তুমুল ফাইটিং শেষে আদালত প্রাঙ্গণের স্থির চিত্রের সাথে দেখতাম ‘... বেকসুর খালাস ঘোষণা’ করা হতো শাদা পোশাকের (শাদা মনের মানুষও তিনি) জসিমকে।।
সচরাচর কোনো টেকি আর্টিকেল এভাবে শুরু না হলেও এবার নিয়ম ভাঙতেই হলো কারণ আমাদের আজকের টপিক অনেকটা ছায়াছবির কাহিনীসংক্ষেপের মতোই।
আগের পোস্টে অ্যাপল স্টোর থেকে আইফোনসহ অন্যান্য অ্যাপল ডিভাইস সম্প্রতি ভাইরাসাক্রান্ত হচ্ছে - বলার পর আমরা অনেক অনেক প্রশ্ন পেয়েছি, যার বেশীরভাগেরই মূল বক্তব্য, ‘যেহেতু আই-ডিভাইসসমূহের জন্য এখন পর্যন্ত সে অর্থে কার্যকর কোনো এন্টিভাইরাস নেই, বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে কি না?’
এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার শুরুতেই তাই জানিয়ে নিচ্ছি - আইওএস ভাইরাস প্রতিরোধে অ্যাপলকর্তৃক প্রস্তাবিত সমাধান হচ্ছে ‘জেলব্রেক’ না করা এবং কোনো কারণে আপনার ডিভাইসটি ‘জেলব্রোকেন’ হয়ে থাকলে অবশ্যই আপনার উচিত তা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। আর, এই বিষয়ের আদ্যোপান্ত নিয়েই আমাদের আজকের টেক সমাধান।।
জেলব্রেকিং কি?
আইওএস বা আই অপারেটিং সিস্টেম, যা ব্যবহৃত হয় আইফোন, আইপ্যাডসহ সেকেন্ড জেনারেশন টেলিভিশন পর্যন্ত বিভিন্ন অ্যাপল ডিভাইসে, আমাদের দেশে তা ব্যবহারের জন্য কান্ট্রি লক খোলা, অ্যাপল স্টোর ছাড়াও অন্যান্য থার্ড পার্টি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের জন্য পূর্বনির্ধারিত নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা বা টুইক ও কাস্টমাইজড করা - এসবই জেলব্রেকিং!
কি, অবাক হলেন – তাই না?
আসলেই তাই, কিছু টাকা কমে পেতে আপনি যখন একটি কান্ট্রি লকড ফোন কিনে মোতালেব প্লাজায় গিয়ে তা ‘আনলক’ করান – সেই মুহূর্ত থেকেই এটা জেলব্রোকেন।
আবার ধরেন, বন্ধু দেখালো তার আইফোনে আনকমন থিম – বুঝবেন জেলব্রোকেন।
এভাবে গণহারে আই ডিভাইস জেল ব্রোকেন হওয়ার আসলে কারণ একটাই - জেলব্রেক ম্যানুয়ালি করা গেলেও থার্ড পার্টি অনেক অ্যাপসে এর জন্য অটোম্যাটিক টুল সংযোজিত করা থাকে। আর, এসবের জেরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভিকটিম নিজেও জানে না সে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে।
জেলব্রেক কে করে, কেন করে??
উপরের আলোচনা পড়ে কেউ কেউ এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন - এটা খুব ‘মামুলী’ একটা প্রশ্ন! অ্যাপল ইউজারদের জন্য এটা এখন এতটাই ‘কমন’ যে বলা চলে আপনি-আমি আমরা সবাই-ই যার যখন প্রয়োজন জেলব্রেক করে বসে থাকি, তবে নিজেই জানি না!
আগে জেলব্রেকের ক্ষতি শাদা চোখে দেখা না গেলেও সম্প্রতি ২০ লক্ষ আইফোনসহ বিভিন্ন আই ডিভাইস ভাইরাসাক্রান্ত হওয়া নিয়ে টেকি মানুষদের অস্থিরতা নিরসনে বিশেষজ্ঞরা বলছেন হরলিক্সের মতো এমনি এমনি না খেয়ে এবার থেকে একটু বুঝেশুনে খেতে!
ফিরে আসি মূল টপিকে – আমাদের দেশে অ্যাপলের নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র আই সেন্টার এবং অ্যাপল অনুমোদিত ডিলার কম্পিউটার সোর্স ও একাধিক মোবাইল কোম্পানিসহ অনুমোদিত রিটেইলাররা বর্তমানে আইফোনসহ অন্যান্য ‘অরিজিনাল’ আই ডিভাইস বিক্রি করছেন। মনে রাখবেন এসবের প্রত্যেকটিতে আপনাকে লিখিত এক বছরের (কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুই বছর) আন্তর্জাতিক ওয়ারেন্টি এবং পণ্যভেদে গ্যারান্টি দেয়া হয়ে থাকে। তাই, যেখানে সেখানে ডিসপ্লেতে আইফোন বা ম্যাকবুক সাজানো থাকলেই আসল ভাবার কোনো কারণ নেই, পাশাপাশি দোকানদারের ‘ভাই, লাগেজ পার্টি দিয়ে আনাই বলে কাগজ নাই – কিন্তু রিসিটে ওয়ারেন্টি লিখে দেবো’ এমন ধোঁকায়ও পা দেয়া স্রেফ বোকামি ছাড়া আর কিছু না।
বাইরে থেকে আসা এসব ‘কন্টাক্ট ফোন’ বা ‘বান্ডল প্রোডাক্ট’ নির্দিষ্ট দেশের নেটওয়ার্কের সঙ্গে একটি সময় পর্যন্ত ব্যবহারের চুক্তি করে নেয়া হলেও পরে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অবৈধভাবে নিয়ে আসা হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। এসব ডিভাইসের প্রতিটিই জেলব্রোকেন - কেননা আই ডিভাইসসমূহের কান্ট্রি কোড অপসারণের এটাই চোরাপথ!
এছাড়াও, ধরুন বন্ধুর এনড্রয়েডে মজার একটি অ্যাপ দেখলেন, যা আই স্টোরে খুঁজে না পেলেও ‘গুগল’ করে দেখলেন আছে, তবে অন্য একটি ওয়েবসাইটে। নামিয়ে নিলেন। ব্যাস, হয়ে গেল তো জেলব্রেকিং!
এরপর আছে বিভিন্ন রকমের কাস্টমাইজেশন – আই ডিভাইসগুলো জেলব্রেক ছাড়া কাস্টমাইজড করা যায় না বলে সব কাস্টমাইজেশন টুলেই জেলব্রেক টুল সংযোজিত থাকে।
কেউ কেউ অবশ্য ‘টুইক’ করতে জেলব্রেক টুল খুঁজলেও এদের আরেক দল হচ্ছে অতিআগ্রহীরা – যারা কী না উঁকি মেরে দেখতে চায় আইওএসের সিস্টেম ম্যানেজারসহ ভেতরের খুঁটিনাটি।
সময় এবং শ্রমের অপচয়!
জেলব্রেক করা সহজ হলেও আসলে টিকে থাকা কঠিন! কেননা আপনি যখন আপনার ডিভাইসটিকে কোনো প্রোগ্রামের হাতে জেলব্রেক করতে ছেড়ে দিচ্ছেন তার মানে আপনি তখন থেকে আর তার নিয়ন্ত্রক নয়।
ফলে, একবার জেলব্রোকেন হলে তখন থেকে আইওএসের পরবর্তী আপডেট আসা বা রিস্টোর করা পর্যন্ত সেই বিশেষ অ্যাপের সাহায্যে তার নির্মাতা অবিরত পেতে থাকবেন আপনার সব তথ্য ও ফাইল। তাই, জেলব্রেকিং আসলে কেবল সময় এবং শ্রমের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না।
ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের অ্যাপ্লিকেশন দরকার? হয় বিভিন্ন ডিভাইস ব্যবহার করুন, নয়তো আই স্টোর ঘেঁটেই খুঁজে নিন কাছাকাছি ধরণের অ্যাপ! টুইক প্রয়োজন? আইওএস-ই ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যাপ, ডাটা শেয়ারিংসহ মাল্টিপল স্ক্রিন সুবিধা দিচ্ছে!
অপারেটিং সিস্টেমের ভেতরটা দেখতে চাচ্ছেন? iFunbox বা এ ধরণের কোনো একটি থার্ড পার্টি সফটওয়্যার ব্যবহার করুন যা জেলব্রেক ছাড়াও সিস্টেম ফাইলে এক্সেস দেয়।
‘জেলব্রোকেন ফোন হারালে ট্র্যাক করা যায় না’
আমাদের উপমহাদেশীয় ঐতিহ্য ‘নাই, তো অন্যেরটা কেড়ে নাও’ তাই বোধকরি অন্যসব কিছুর মতো আমাদের ফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসও বেহাত হয় সবচেয়ে বেশী! এক্ষেত্রে অনেক ভরসার জায়গা আই ডিভাইসসমূহ – কেননা সহজে ট্র্যাক করা যায়।
তবে, জেলব্রেক করার সময় প্রথমেই ডিভাইসের আপডেট এবং পজিশনিং বন্ধ করে দেয়া হয় বলে জেলব্রোকেন ডিভাইস কিন্তু এর আওতাধীন নয়।
যেভাবে বুঝবেন আপনার ডিভাইস জেলব্রোকেন কি না?
অনেকে অনেক কঠিন কঠিন পথ বাতলে থাকলেও সবচেয়ে সহজ হচ্ছে সার্চ দিয়ে দেখুন ‘সিওয়াইডিআইএ’ নামে কোনো অ্যাপ আছে কি না? যদি থাকে, বুঝে নেবেন আপনিও আছেন হ্যাকারের প্রেমের খাতায়!
অবশ্য অনেক সময় এটি লুকানো থাকতে পারে – সেক্ষেত্রে আপনার ডিভাইসটিতে বাংলাদেশের এয়ারটেল সিম লাগান। যদি সক্রিয় হয়, বুঝবেন জেলব্রোকেন (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অ্যাপল সার্টিফাইড ক্যারিয়ার কেবল জিপি, রবি এবং বাংলালিংক – আর, অ্যাপল ওয়েবসাইট অনুসারে জেলব্রোকেন ব্যতীত অন্যান্য ক্যারিয়ারে তাদের ডিভাইস ‘নো সিম কার্ড ইনস্টলড’ দেখিয়ে কাজ করবে না)।
জেলব্রেক অপসারণ করবেন কীভাবে?
জেলব্রেক অপসারণের আসলে একটিই উপায় – আই টিউনসসহযোগে ডিভাইসটি রিস্টোর করা। তবে, যদি কান্ট্রি লক খোলা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হবে আইওএসের নতুন ভার্সনের জন্য।
ভাইরাস সংক্রান্ত যে কোনো জিজ্ঞাসা বা মতামত জানাতে মন্তব্যের পাশাপাশি আগের অন্যান্য পোস্টসমূহ পড়তে ‘অনুসরণ’ করতে পারেন টেক সমাধান।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৯