ঐতিহাসিক শেরশাহ সড়কের পাশে প্রায় দুইশ’ বছরের ঐতিহ্য যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দয়ারামপুর ঈদগাহ।
এই ঈদগাহের বিস্তৃত জায়গা জুড়ে রয়েছে সারি সারি গাছ; তাই ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে হাজার বিশেক মুসল্লি একসঙ্গে আদায় করতে পারেন ঈদের নামাজ।
বাঘারপাড়া সদর থেকে প্রায় ৭ কিমি আর নারিকেলবাড়ীয়া বাজার থেকে প্রায় এক কিমি দূরে অবস্থান এই শতাব্দী প্রাচীন ঈদগাহের। প্রায় তিন বিঘা (১০০ শতক) জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে ঈদগাহটি। এর উত্তরপাশে দয়ারামপুর সিদ্দিকীয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, পূর্বপাশে একটি মসজিদ আর পশ্চিমপাশ ঘেঁষে চলে গেছে শেরশাহ সড়ক*।
স্থানীয়রা জানান, নারিকেলবাড়ীয়া লাগোয়া মাগুরার শালিখা উপজেলার কাদিরপাড়া, গোবরা, হরিশপুর, দেয়াভাঙ্গা, হাজরাহাটি, ঝুনোরি, শতখালী, বাঘারপাড়ার ধলগ্রাম, বন্দবিলা ও নারকেলবাড়ীয়া ইউনিয়ন এবং নড়াইলের প্রায় ৩০ গ্রামের ২০ সহ¯্রাধিক মানুষ এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেন।
ঈদগাহ লাগোয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আশরাফউদ্দিন জানান, ১৮১০ সালের দিকে তার দাদা পীরসাহেব ইউসুফ (রা.) এই ঈদগাহটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে অদ্যাবধি ব্যাপক আয়োজনে ঈদের জামাত হয়ে আসছে।
তার দাদা প্রথমদিকে ঈদের নামাজে ইমামতি করতেন। তার মৃত্যুর (১৯৪০ সালে) পর বড়ছেলে পীরজাদা আব্দুর রহিম ইমামতি করেছেন। উনার ইন্তেকালের (১৯৬৫ সাল) পর ইমামতির দায়িত্ব পান তার ছেলে মওলানা শামসুদ্দিন। প্রায় ২৮ বছর আগে মওলানা শামসুদ্দিন ইন্তেকাল করেন। উনার পর ছোটভাই মুফতি মওলানা ইমাদউদ্দিন দায়িত্ব পান। তিনি এখনও ইমামতি করছেন।
স্থানীয়রা জানান, এখানকার পীরবাড়ির অনেক ঐতিহ্য রয়েছে। তারা বেশ কামেল ব্যক্তি ছিলেন।
পীরবাড়ির সদস্যদের নিয়ে মানুষের মুখে মুখে বেশকিছু আশ্চর্যজনক ঘটনা্রচলিত রয়েছে। এখনও মানুষ সেইসব ঘটনা বিবৃত করেন।
দয়ারামপুর সিদ্দিকীয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ মো. ইয়াহিয়া আলী বলেন, এখানকার পীররা ছিলেন খুবই আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী। আমাদের নিজেদের জীবনেও তাদের মোজেজা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমার আম্মার একসময় বুক বেঁকে গেছিল। তখন আব্বা পীরসাহেবের (পীরজাদা আব্দুর রহিম) কাছে গিয়েছিলেন। তো পীরসাহেব আব্বাকে বলেন- বাজার থেকে একটা লাউ আর কিছু জিয়েল মাছ আনতে। অসময়ে কোথায় লাউ পাবেন- জিজ্ঞেস করতেই পীরসাহেব বলেন, হাটে যাও। আব্বা হাটে গিয়ে একটা সুন্দর লাউ পান, কিছু জিয়েল মাছও কিনে পীরসাহেবের কাছে নিয়ে যান। পীরসাহেব লাউ ‘পড়ে’ দেন, বাড়ি এসে রান্না করে আপম্মাকে খাওয়ালে তার মুখ ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
নারিকেলবাড়ীয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু কুমার সাহা বলেন, এই এলাকায় পীরসাহেবের বেশ নাম ডাক ছিল। এই ঈদগাহ নির্মাণে তাদের অনেক অবদান রয়েছে। প্রতিবছর এই ঈদগাহে হাজার হাজার মানুষ জামাতে নামাজ আদায় করেন। একসময় এই ঈদগাহে শবে বরাতের সময় ওয়াজ মাহফিল হতো। সেখানে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া হতো। সকালে আমরা স্কুলে গিয়ে ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করতাম।
পীরদের অত্যাশ্চর্য কিছু ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছি, তিনি ভারতের ফুরফুরা শরীফের ছিলছিলার লোক ছিলেন। তখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। একবার ফুরফুরা শরীফে বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে অসুস্থতার কারণে পীরসাহেব ইউসুফ (রা.) সেবার যেতে পারেননি। ফুরফুরা শরীফের পীরসাহেব তার ওয়াজ শেষে যখন নামাজের ওয়াক্ত, তখন সবাইকে কাতার সোজা করে দাঁড়াতে বললেন। একইসাথে ঘোষণা দিলেন, আপনারা সবাই কাতারে দাঁড়ান, পূর্বপাকিস্তান থেকে ইউসুফ আসছেন- উনি আপনাদের ইমামতি করবেন। যারা জানতেন অসুস্থতার কারণে পীরসাহেব এবার মাহফিলে যেতে পারেননি, তারা বেশ আশ্চর্য হলেন। কিন্তু সবাইকে আরও বেশি আশ্চর্য হতে হয়েছিল, সেই নামাজে ইমামতি করেছিলেন পীরসাহেব ইউসুফ (রা.)।
ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু কুমার সাহা বলেন, পীরসাহেবদের জমি লাগোয়া আমার বাবারও কিছু জমি ছিল। পীরবাড়ির লোকজনের আরও একটি কারিশমা হচ্ছে, রাতের বেলা তারা বাড়ি ‘বন্ধ’ রাখতেন, যাতে চুরি না হয়। তো একদিন তেমনই মন্ত্র পড়ে বাড়ি ‘বন্ধ’ করা হয়। সেইসময় বাড়িতে বেশ বড় বড় মিষ্টি কুমড়ো হয়েছিল। রাতে এক চোর এসে কুমড়ো পেড়ে নিয়ে যাওয়া চেষ্টা করলেও সে যেতে পারেনি। খুব সকালে পীরসাহেব উঠে দেখেন, কুমড়ো হাতে এক লোক দাঁড়িয়ে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়- কুমড়ো চুরি করে নিয়ে যেতে পারেনি, কারণ সে যেদিক থেকে বের হতে যাচ্ছে, সেদিকেই বড় বড় পুকুর দেখতে পাচ্ছে!
স্থানীয়দের মুখে মুখে আরেকটি কাহিনি প্রচলিত রয়েছে, সেটি হচ্ছে- একবার পীরজাদা আব্দুর রহিমের কাছে কয়েকজন মুরিদ আসেন ‘দাওয়া’ নিতে। তখন প্রয়োজন হয়ে পড়ে খাঁটি মধুর। কিন্তু মুরিদরা মধু পাচ্ছিলেন না। সেসময় তিনি মুরিদদের উদ্দেশ করে বলেন একটি বাটি নিয়ে অদূরে থাকা একটি গাছের নিচে দাঁড়াতে। কিছু সময় পর ওইগাছে থাকা একটি মৌচাক থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকে মধু!
বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে নামাজ আদায় করে আসছেন এই এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, আমার বাপ-দাদাও এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। দয়ারামপুরের এই ঈদগাহ এলাকায় আগে খুব আমগাছ ছিল। স্থানীয়রা সবাই ‘আমপোল’ হিসেবে চেনে। আর এখানকার পীরের নাম-ডাকও ছিল বেশ।
পার্শ্ববর্তী জয়পুরের বাসিন্দা ইমদাদ হোসেন জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি এখানে নামাজ আদায় করেন। তার কাছে মনে হয়, যেন কুমিল্লার শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে নামাজ আদায় করছেন।
নারিকেলবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আদম আলী বলেন, আমাদের ইউনিয়নে ১৪টি গ্রাম। এই গ্রামগুলোর মুসল্লিরা তো আছেনই; বাইরের মাগুরা জেলাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকেও বহু মানুষ আসেন ঈদের জামাতে।
কত বছর আগে এই ঈদগাহের প্রতিষ্ঠা- তা বলতে পারেন না স্থানীয়রা। তবে, বাপ-দাদাদের কাছে শুনে তাদের যে ধারণা, সেটি হচ্ছে-দেড় থেকে দুইশ’ বছরের পুরনো তো হবেই।
স্থানীয় ও পীরবাড়ি সূত্রে জানা যায়, ঈদগাহের জন্যে জমি বরাদ্দ দেন সেই সময়কার বিশিষ্ট সমাজসেবী রাজেন্দ্রনাথ সাহা। তার দেওয়া জমির পরিমাণ ৩৩ শতক। স্থানীয় আরেক সমাজসেবী রহিম বক্স দেন ২৪ শতক এবং পীরসাহেব ইউসুফ (রা.) দান করেন ৪৩ শতক জমি।
(*শেরশাহ সড়ক : ১৫৪১ থেকে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ২৫শ’ কিমি রাস্তা তৈরি করেন তৎকালীন দিল্লির অধিপতি শেরশাহ। সেইসময়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে যশোরের উপর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া হয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ারের মধ্য দিয়ে এ রাস্তাটি সুদূর কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এ সড়কটি এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে ব্যবহার করলেও বাংলাদেশের অনেক স্থানে এর কোনও চিহ্ন নেই। অস্তিত্ব রয়েছে কেবলমাত্র যশোরের বাঘারপাড়ায়।)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৪:২৪