দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা যশোরের অদম্য মেধাবী তামান্না নূরার চলার পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। জন্মের পর থেকেই তাকেসহ পরিবারকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে নানা যন্ত্রণা। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে সমাজের মানুষ তাদের গ্রহণ করেনি স্বাভাবিকভাবে। তবে, সব অবহেলা-অযত্ন আর ভ্রুকুটি উপেক্ষা দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে চলার স্পর্ধিত সাহস আজকের তামান্না।
একান্ত আলাপচারিতায় তামান্না নূরা, তার বাবা রওশন আলী মা খাদিজা পারভীনের বয়ানে উঠে এসেছে সেইসব সময়ের কাহিনি।
পরিচয় দেয় না স্বজনরা
২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর; যশোর শহরের ফাতিমা হসপিটালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম হয় তামান্না নূরার।
রওশন আলী বলেন, দিনটি আমাদের জন্যে শোকের! কেননা আমার সন্তানের এই অবস্থায় জন্ম হওয়ায় কোনও আত্মীয়-স্বজন দেখতে আসেনি। একপর্যায়ে নিজ পরিবার ঝিকরগাছার পানিসারা থেকেও বিতাড়িত হয়ে শাশুড়ির বাড়ি একই উপজেলার বাঁকড়া আলীপুরে অবস্থান গ্রহণ করি।
তিনি বলেন, যখন হুইল চেয়ার ঠেলে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যেতাম, তখন প্রতিবেশী বউ-ঝিরা দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতো। তাদের ধারণা, সকালে প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে দেখলে তাদের অকল্যাণ হবে।
“প্রতিবেশীরাও টিপ্পনি দিতো, গ্রহণকালে ওর মা মুরগি কেটেছে না হলে মাছ কেটেছে! না হলে অনেক পাপ করেছে... এমন সব কথা বলাবলি করতো অনেকেই” বলেন তামান্নার মা খাদিজা পারভীন।
তিনি বলেন, আত্মীয়-স্বজনরা আমাদের পরিচয় দিতে লজ্জা পেতো, তাদের পারিবারিক কোনও অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতো না।
তিনি বলেন, এমন শত শত বাধা অতিক্রম করেই আজকের এই স্থানে আমরা।
হাতেখড়ি-স্কুলে ভর্তি
তামান্নার তখন বেশ ছোট। মাটিতে বসে খেলাধুলা করার সময় তার মা দেখলেন, মেয়ে পায়ের আঙুলে কাঠি আটকে মাটিতে আঁকি-বুকি করছে। তিনি স্বামীকে ডেকে দেখান, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন- মেয়ে লেখাপড়া করতে পারবে! এরপর মাটিতেই বৃত্ত আঁকানো, দাগ দেওয়ার কাজ শুরু।
রওশন বলেন, বাচ্চারা যখন লেখাপড়া শুরু করে-তখন তাদের হাতেখড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু তামান্নার পায়ের আঙুলে চক দেওয়ায় সে ব্যথা অনুভব করে। সেকারণে তার হাতেখড়ি নয়, একেবারে পেনসিল আর খাতা দিয়ে লেখা শুরু হয়। মাত্র দুই মাসেই সে সব বর্ণ লেখা শিখে ফেলে।
বাড়ির পাশে ব্র্যাক স্কুলসহ বেশ কিছু শিক্ষালয়ে মেয়েকে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। কেউই প্রতিবন্ধী তামান্নাকে তাদের স্কুলে ভর্তি করাতে রাজি হয়নি।
তামান্নার মা বলেন, তখন তামান্নার ৪ বছর। স্থানীয় একটি স্কুলে মেয়েকে নিয়ে যাই। সেখানে দুই মাস ক্লাস করেছিল। একদিন স্কুলে একজন অডিটর আসেন, তিনি তামান্নাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন- কারা বাচ্চা। আমার বাচ্চা শুনে তিনি বলেন, এই বাচ্চাকে এখানে রাখা যাবে না। কারণ হিসেবে জানান- তার হাত নেই, পা নেই- কীভাবে লিখবে? তাকে বলি- লেখানোর দায়িত্ব আমার, আপনি কেবল বসতে দিন। তিনি রাজি হননি।
বাচ্চাটাকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরি। তখন আমার মা (তামান্নার নানি) পাশের আজমাইন এডাস স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেন।
পড়ালেখায় সাফল্য
বাঁকড়া আজমাইন স্কুলে ভর্তি হন তামান্না নূরা। সব বাচ্চাদের মতো তিনি বসতে পারেন না বেঞ্চে। পরিবার থেকে বসার জন্যে একটি জায়নামাজের পাটির ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ক্লাসশেষে তার বাবা দেখেন, সব বাচ্চারা তামান্নার মাথা-ঘাড়ের উপর দিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। পরে একটি চৌকি বানিয়ে সেটি স্যারের টেবিলের পাশে রাখা হয়; তামান্না সেখানে বসেই ক্লাস করতেন।
দ্বিতীয় শ্রেণিতে তামান্না এডাস বৃত্তি পান; তার সাফল্যের শুরু। এরপর এই স্কুল থেকেই তিনি প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান। পরিবারে আমার সঞ্চার হয়।
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় কৃতিত্বের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির আকাঙ্ক্ষা যেমন তামান্নার, তেমনি বাবা-মাও বেশ আশাবাদী হন। তাকে ভর্তি করানো হয় বাঁকড়া জনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
বাবা রওশন আলী বলেন, এই স্কুলে মেয়েদের ক্লাস দোতলায়, ছেলেদের নিচতলায়। সিঁড়ি ভেঙে উপরে যাওয়া কষ্টকর হওয়ায় তামান্না ছেলেদের সঙ্গেই ক্লাস করতো। এই স্কুল থেকে জেএসসিতে জিপিএ-৫ এবং পান।
নবম শ্রেণিতে উঠার পর তামান্নার ইচ্ছে তিনি সায়েন্স নিয়ে পড়বেন। কিন্তু বাবা জানান- সায়েন্সে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষাসহ নানা ঝামেলা রয়েছে। তার আর্টস নেওয়া উচিৎ।
রওশন আলী বলেন, প্রায় এক সপ্তাহ তামান্না আমার সঙ্গে কথা বলতো না। পরে তার ইচ্ছে জয়ী হয়। সে সায়েন্স নিয়ে পড়াশুনা করে; ২০১৯ সালে এসএসসিতেও জিপিএ-৫ হয় তার।
এসএসসি পাশের পরই তামান্নাকে ভর্তি করা হয় বাঁকড়া ডিগ্রি কলেজে। তামান্নার বাবা জানান, বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে কলেজে প্রতিনিয়ত হুইল চেয়ার ঠেলে তাকে নিয়ে যেতে হতো। খুব কষ্ট করেছে মেয়েটি। তার ফলই সে পেয়েছে। এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পরপরই সে বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং
এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই তামান্না তার বাবাকে জানিয়েছিলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান। সেলক্ষ্যে তাকে একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি করানোর জন্যেও অনুরোধ করেন।
মেয়েটির ইচ্ছাশক্তির কারণে তাকে যশোরে কোচিং করানোর জন্যে আমরা সপরিবারে চলে এসেছি। কোচিং সেন্টারের পাশে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছি। তামান্নার বিষয়ে যশোরের একটি কোচিং সেন্টারের পরিচালক আমাকে আশ্বস্ত করেন।
মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুদের কোচিং করান ইউসিসি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ফেরদৌস আলম মিলন। তিনি বলেন, মেয়েটির কথা শুনে তার কলেজে গিয়েছিলাম। সেখানে তার আরও অনেক গুণের কথা জানতে পারি। তার বাবাকে বলি-পরীক্ষাশেষে যেন যশোরে তাকে নিয়ে আসে। আমি তাকে মেডিক্যাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দুটি কোচিং ক্লাসেই নিয়েছি। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তাকে কোচিং, প্রয়োজনীয় বই, নোট শিট ইত্যাদি সরবরাহ করেছি। আমি তার মঙ্গল কামনা করি।
৩২ কোটি হাতের মধ্যে বিশ্বস্ত হাতজোড়া মাথার উপরে
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে তামান্না নূরা ও তার পরিবার জানতে পারেন তিনি জিপিএ-৫ পেয়েছেন। চার হাত-পায়ের মধ্যে শরীরে থাকা একমাত্র পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দেন তিনি।
তার বাবা রওশন আলী ঝিকরগাছা উপজেলার ছোট পৌদাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার (নন-এমপিও) শিক্ষক। মা খাদিজা পারভীন গৃহিণী। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে তামান্না সবার বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রশ্মি ষষ্ঠ শ্রেণি ও ভাই মুহিবুল্লাহ তাজ প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।
বিষয়টি দেশের শীর্ষস্থানীয় সকল মিডিয়ায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই প্রকাশিত হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহেনা ফোনে তামান্নাকে অভিনন্দন জানান। তারা তামান্না নূরার পাশে তাকার অঙ্গীকার করেন। পরদিন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি তাকে অভিনন্দনের পাশাপাশি তার সঙ্গে সাক্ষাতের কথাও বলেন। এরপর থেকেই তামান্না নূরাকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তি ও রাজনীতিকদের মধ্যে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানোর স্রোত নামে।
তামান্না নূরার বাবা রওশন আলী অশ্রসিক্ত নয়নে বলেন, রেজাল্ট জানার পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি তামান্নাকে নিয়ে যাই ফাতিমা হাসপাতালে তার অসুস্থ মারেয়র সঙ্গে দেখা করাতে। তিনি (তামান্নার মা) অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এই হাসপাতালে জন্ম আমার মেয়ের। তার জন্মের পর দুঃখ নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করতে হয়। আর সেই হাসপাতালে যখন মেয়ের ফলাফল জানানোর জন্যে তার মায়ের সাথে দেখা করতে গেছি- তখনই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার মেয়েকে অভিনন্দন জানাতে ফোন করেছেন। মনে হচ্ছে, আমি যেন আনন্দের বন্যায় ভাসছি।
তামান্না নূরার ইচ্ছা
আমার চলার পথ কখনোই সহজ ছিল না। অনেক বাধা, চ্যালেঞ্জ আর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছি। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপক্ষো করে বাবা-মা আমাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। আমার শিক্ষক, ক্লাসের বেশিরভাগ বন্ধু আমাকে খুব ভালবাসতো।
তিনি বলেন, সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মানবতার মা শেখ হাসিনা আমাকে ফোন করেছেন, ছোটমা শেখ রেহেনাও ফোন করে আমার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন। ছোটবেলায় ভাবতাম আমার দুটো হাত নেই, একটি পা নেই। এখন বুঝেছি, দেশের ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি হাত আমার আছে। এসব হাতের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত হাত জোড়া মমতাময়ী মা শেখ হাসিনার। এটিই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশান্তি।
আরও চেষ্টা করে আমি উচ্চতার শিখরে যেতে চাই।
তিনি বলেন, শুধু নিজের উন্নয়ন নয়, আমার মতো যারা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু রয়েছে, আমি চাই তারা প্রত্যেকেই যেন দেশের বো নয়, আশীর্বাদ হয়- সেই চেষ্টা থাকবে।
আমি চাই, সবাই যেমন আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, তেমনি এমন প্রতিবন্ধী সকলের পাশেও তারা দাঁড়াবেন- যোগ করেন তামান্না।
২৬.০২.২০২২
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৩১