কবির আসতে একটু বিলম্বই হয়েছে; ঘাট হয়েছে- নতমুখে স্বীকার করতে কোনও বাধা নেই। কবি প্রস্তুত!
বারবার বলে দিয়েছে ডাক্তার, ঠিক সাড়ে চারটেয় দেখা হবে মধ্যশহরের একমাত্র লাল-নীল-হলুদ-বেগুনি-সবুজবেষ্টিত সৌন্দর্যে।
প্রথম দেখা হবে, চারচোখের মহামিলন!
কবি- একদম অগোছালো! যথারীতি সময়জ্ঞানের ঘাটতি নিয়ে পাঁচটার দিকে জোরকদমে আপিস ছাড়ে।
রাস্তাটা বড় বেহায়া মনে হয় তার। রিকশার টুংটাং, ট্যাক্সির ভেপু, মোটরসাইকেলের কান ঝালাপালা বিরক্তিকর শব্দ মোটেও সহ্য হয় না ইদানিং। অথচ, এই ধুলোভরা শহরটাকেই আজন্ম ভালবেসে থেকে গেছে সে।
ফুটপাথ ধরে এগুতে গিয়েই চোখে পড়ে জীর্ণ-শীর্ণ হাতপাতা মানুষের দল। চোখ সয়ে আসা হকারদের কাব্যিক আহ্বান- আসেন, আসেন- কম রেট, মাল ভাল !
উরাধুরায় বন্দী এই জীবনের স্রোতে হঠাৎ করেই সবুজের হাতছানি!
আজ ডাক্তার আসিবার পূর্বেই কবি ঘটনাস্থলে পায়চারি করবে- দৃঢ়তার কমতি ছিল না একটুও।
কিন্তু ছয় ইঞ্চি কপাল যে তার; আপিসের বস- বেরুনোর আগেই ডাক দিলেন- স্টোরিটা একটু দেখে দিয়ে যাও, কবি ! কালকের পাতায় ছাপা হবে যে !
বসের খুব বিশ্বস্ত কবি; শুধুই বিশ্বস্ত কেবল কাজের জন্যে।
ইতস্তত করতে থাকে সে, বস- একটু তাড়া ছিল যে !
: আরে, সামান্য একবার চোখ বুলিয়ে গেলেই হবে ! তোমার চোখে যাদু আছে- এক ঝাপটায় সব এলামেলো কথা পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে…
সবুজের বিশাল গেটখানার সামনে পৌঁছে গেছে কবি।
বুকের ভেতর থেকে দুঃশ্চিন্তার ধুলোমাখা বাতাস দ্রুত বের হয়ে যায়। সেখান থেকে পরমানন্দের একটা মৃদু শব্দ বের হয়- আহ !
ভেতরে ঢুকেই ডাক্তারের স্কেচ করা দক্ষিণ-পূর্ব কোণার বেঞ্চের দিকে দ্রুত পায়ে এগুতে থাকে সে। গাছপালা-আর ঝোপের আবডালে কিছুই দেখা যায় না। সে হাঁটতে থাকে…
দু’চার মিনিটেই পৌঁছে যায় লোহা আর কাঠের অপূর্ব কম্বিনেশনে তৈরি বেঞ্চের দিকে!
ঘড়ি দেখে, ৫টা ১৫ মিনিট ! ডাক্তার তবে কি চলে গেলো ?
কেউ নেই। বুকের ভেতর দুম করে মোচড় দেয়; কষ্টের দলা উঠতে থাকে। কত কথা পাক খায় মস্তিষ্কে, ঝিম ঝিম করতে থাকে।
বেঞ্চের সামনে নীলজলের পুকুর। পাড়টি ভরা দুবলোয়; দু’একটা ঘাসফুল চকচক করছে তারুণ্যের রঙে। বাতাসে দোল খাচ্ছে দুবলোর কচি ডগা !
আজ দেখা হবে ডাক্তারের সঙ্গে। কতকিছু তার কল্পনায় রঙ ছড়িয়ে ছিল। কী রঙের ড্রেস পরা থাকবে তার, গায়ে অ্যাপ্রন জড়িয়ে আসবে, না কি ময়ূরকণ্ঠীরঙা শাড়ি? না কি হালকা গোলাপি কামিজের সঙ্গে টকটকে লাল টিপ কপালজুড়ে… আনমনা হয় সে।
আজ ডাক্তার তাকে গান শোনাবে !
ডাক্তারের মিষ্টিকণ্ঠে রবিঠাকুরের গান কেমন শোনাবে ! ও কি আধুনিক গান করে ? ভাবনায় কতকিছুই আসছে। অথচ, কবির সামনে কেবল জল আর জল !
চিন্তার পরিবর্তন ঘটে হঠাৎ; পেছনে কার পায়ের শব্দ শোনা যায়। চকিত পিছু ফেরে সে !
হা হা হা
বাদামওয়ালা ছেলেটা তার কর্কশকণ্ঠে হাঁক দেয়, বা..দে..ম ! স্যার, অ্যাকলা বইসা রইছেন, একটা ঠোঙা লন- টাইম পাস!
স্বপ্নের ছায়াছবিতে ছন্দপতন ঘটে কবির। সম্বিত ফিরে পায়, দাও-
বেঞ্চে বসে বাদাম চিবুতে চিবুতে কল্পনার রঙ ফের ছড়ায় সে।
কবি নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে। ইশশশ, সময়মতো আসতে পারলে আজ দেখা হতো, কথা হতো, গান শোনা… সবকিছু ওই শালার বসের কারণে। বসকে কষে কয়েকটা ডাস্টবিনসম গাল দিয়ে দেয় সে।
সময়ের হেরফেরে আজ এই দিনটা আনন্দময় স্মৃতির বিপরীতে বিষাদময় নীলরঙা ক্যানভাস হয়ে গেল- ভাবতে ভাবতে দু’চোখের কোণে চিক চিক করে ওঠে শিশিরবিন্দু! নিজেকেই ধিক্কার দিতে থাকে সে ।
খুব চায়ের তেষ্টা পেয়েছে তার। বেঞ্চ থেকে উঠে আশপাশে তাকায় কবি। আশেপাশে কোলাহলময় আনন্দউল্লাস নজরে আসে তার। কেবল নিজের বুকের ভেতরটাই খাঁ খাঁ করছে। গোটা সবুজ অরণ্য এক লহমায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনে। একটু জটলা দেখে পা বাড়ায় সে…
তিন চার তরুণ এক ফ্লাস্কওয়ালার কাছ থেকে ওয়ানটাইম কাপে চা নিচ্ছে, হৈ হট্টগোল করেই। তাকে দেখে ছেলেটা জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকায়। হা সূচক মাথা নেড়ে ফের সেই বেঞ্চে গিয়ে বসে।
ছেলেটি সুন্দর ফুলছাপা একটি কাগজের কাপে এককাপ চা এগিয়ে দেয়।
চায়ে চুমুকের সঙ্গে সঙ্গে ধোয়ার নেশাটা মাথাচাড়া দিলে শান্তিনিকেতনের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা শলাকা ঠোঁটে লটকে দেয়। দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন জ্বেলে সম্মুখপাশে ধরে সে। একবুক ধোয়া সরাসরি পাঠিয়ে দেয় ফুসফুসে, এরপর পরম যত্নে নাকমুখ দিয়ে বের করে প্রশান্তির শব্দ করে- আহ !
ডাক্তারের অদেখা মুখটি কল্পনায় আঁকার চেষ্টা করে কবি। মায়াভরামুখে প্রসন্নতার ছায়া তাকে এনে দেয় প্রশান্তি।
ভাবনার জগতে ফের হারাবে সে।
কবি !
ডাকটা বেশ পরিচিতই মনে হয় তার। নিজের নামটি এভাবে কারো মুখে সে শোনেনি এই জনমে। এমন মধুঝরা, চুড়ির ঝঙ্কার- শোনেনি সে আগে।
পিছু ফিরতেই তার চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হয় !
মুখ থেকে অগোচরে বেরিয়ে যায়, প্রায় অস্ফুটস্বর- ডাক্তার !
অপলক চেয়ে থাকে সে। কল্পনাকে হার মানানো রঙে এসেছে এক মায়াভরা মুখ। তার মুখায়বে ঝরে পড়ছে জগতের সব কৌতুহল। রেলের মতো বয়ে চলে ডাক্তারের কথার বগি- জানো পথে কী যানজট ! একটার পর একটা রিকশা থামে, কেউ যাত্রী নিতে চায় না। আধাঘণ্টার মতো কেবল তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা কেউই সওয়ার নেবে না, আসবে না এই সবুজারণ্যে… অগত্যা, পা সম্বল করেই- তুমি অনেকক্ষণ বসে আছো, তোমার অনেক বোরিং সময় গেছে। খুবই শরমিন্দা, আসলে আমার করার কিছুই ছিল না…
কবির কর্ণকূহর স্থবির; কিছুই শুনতে পায় না সে। তার দু’চোখজুড়ে ডাক্তারের ধনুকবাঁকা ভ্রু, হরিণচোখের ছোটাছুটি, গোলাপের পাপড়ির মতো ওষ্ঠধারার নাচন !
মে ২৬. ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০২০ রাত ১০:২৪