সদিচ্ছা আর মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় খালেদুর রহমান কচিকে একটু বেশি সাহসী করে তুলেছে। সেকারণে কারও দিকে না তাকিয়েই বাড়িতে বসে তিনি একটার পর একটা তৈরি করছেন মাস্ক। পরিয়ে দিচ্ছেন নিজের গ্রামের মানুষকে। বিশ্বব্যাপী করোনার ভয়াবহতা তাকে প্রচ-ভাবে ছুঁয়েছে। বড়কিছু করার সামর্থ্য নেই, তাই বাড়ি তৈরি মাস্ক বিতরণেই সব সুখ তার।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের ক্ষেত্রপালা গ্রামের খালেদুর রহমান কচি (৪০), স্বল্প আয়ের মানুষ। নিজের সংসার চালাতে যার হিমশিম খেতে হয়, সেই মানুষটিই এখন সামাজিক দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। নিজগ্রামের মানুষকে বিনামূল্যে সরবরাহ করছেন মাস্ক। করোনা ভাইরাসের এই ভয়াবহ সময়ে বিশ্বমানবতা যখন এক হয়ে প্রতিরোধযুদ্ধে নেমেছে, ঠিক তখুনি তিনিও স্বল্প পরিসরে সেই যুদ্ধের একজন সৈনিক হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছেন। তার এই কর্মকাণ্ডে স্থানীয় মানুষজন প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
খালেদুর রহমান কচি ২৫ মার্চ বাজার থেকে কিছু ইলাস্টিক, কয়েকটি শপিংয়ের টিস্যু ব্যাগ আর সুতো কিনে আনেন। এরপর টিস্যুব্যাগগুলো স্যাভলন, গরম পানি আর ডিটারজেন্টে ভিজিয়ে জীবানুমুক্ত করেন। এরপর রোদে শুকিয়ে বাড়িতে থাকা স্ত্রীর সেলাই মেশিনে বসে তৈরি করতে থাকেন মাস্ক। প্রথম দু’একদিন ৩০ থেকে ৪০টি তৈরি গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের নিজহাতে সেগুলো পরিয়ে দেন। এরপর আর তাকে টিস্যুবাগের জন্যে বাজারে যাওয়া লাগেনি। প্রতিবেশীরাই বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন। ২৯ মার্চও প্রতিবেশী আনসার আলী তাকে ২০টি ব্যাগ দিয়ে গেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আব্দুস সালামের সন্তান খালেদুর রহমান কচি যশোর থেকে বিভিন্ন মুদি ও স্টেশনারির মালামাল কিনে সেগুলো নারিকেলবাড়িয়া ও পাশের মাগুরা উপজেলার শালিখা বাজারের দোকানে দোকানে সরবরাহ করেন। স্ত্রী বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করেন। পাড়ার বউ-মেয়েদের জামা কাপড় তৈরি করেন। এই নিয়ে মোটামুটিভাবে চলে তার সংসার।
কচি বলেন, করোনার কারণে এখন ব্যবসায়ে মন্দা। বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। এদিকে, করোনার ভয়াবহতা প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারছি। বাড়ি বসে থেকে কী করবো, তাই যতটুকু সামর্থ্য আছে- নেমে পড়েছি। আমার দিয়ে যদি একজন মানুষেরও উপকার হয়। প্রথমদিকে এলাকার মুরব্বিদের মাস্ক তৈরি করে দেই। তারা মাঠে-ঘাটে কাজ করেন, মাস্ক ব্যববহারের সুফলও তাদের বলেছি। দেখেছি তাদের আগ্রহও। এরপর আস্তে আস্তে প্রতিবেশীরা ব্যাগ সরবরাহ করছেন। এখন দিনে একশ’য়ের বেশি মাস্ক তৈরি করতে পারছি। গ্রামের মানুষের আগ্রহ আমাকে আরও বেশি কাজে সহায়তা করছে। বাড়িতে মা, স্ত্রী আর একটি মাত্র ছেলে কিরণ, ফাইভে পড়ে- সেও আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করে।
আমিনুর রহমান নামে প্রতিবেশী একজন কৃষক বলেন, আমাকেও একটা মাস্ক দিয়েছে কচি। আমরা মাস্ক কেন ব্যবহার করবো জানতাম না। সেই আমাদের বুঝিয়ে এখন পরিয়ে দিচ্ছে। ক্ষেত্রপালা গ্রামের বাসিন্দা কলেজশিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কচি স্থানীয় দরিদ্র লোকজনকে মাস্ক তৈরি করে পরিয়ে দিচ্ছে। এটি খুবই ভাল সংবাদ। আসলে যাদের কিছু করার কথা ছিল, তারা নিশ্চুপ। অথচ, তার নিজেরই সংসারে টানাটানি।
নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হাফিজুর রহমান বলেন, এলাকায় কচিকে সবাই চেনে। তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সাংবাদিক ছিলেন। সকলে তাকে পছন্দ করতেন। কচি সাধারণ মানুষের উপকার করছেন। তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান আবু তাহের আবুল সরদার বলেন, আমার বাড়িও একই গ্রামে। কচি খুব ভাল ছেলে। সে গরিব মানুষের কল্যাণে কাজ করছে। করোনা প্রতিরোধে আমাদের সকলকেই তার মতো এগিয়ে আসা উচিৎ।
২৯.০৩.২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৩:৫৫