যশােরর ঝিকরগাছা উপেজলার মাটিকোমরা বাজারটি খা খা করছে। তালাবদ্ধ দোকানের পাশে দু’একটি কুকুর শুয়ে রয়েছে। পাশে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সেখানেও শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নগণ্য! গ্রামে নেই কোনও পুরুষ; নারীদের চোখে ভয়ের ছাপ। অথচ, তিন চারদিন আগেও এখানে ছিল প্রাণচাঞ্চল্য।
গত ৮ নভেম্বর রাতে ডাকাত সন্দেহে ডিবি পুলিশের তিন সদস্যসহ চারজন গণপিটুনির শিকার হওয়ার পর পুলিশের তাণ্ডব ও গণগ্রেফতারের ঘটনায় এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ঘটনার সূত্রপাত
স্থানীয় গৃহবধূ রেবেকা খাতুন জানান, অক্টোবর মাসের ১২ তারিখ রাতে ৭-৮ জনের একদল ডাকাত তাদের বাড়িতে জোরপূর্বক প্রবেশ করে। স্বামীকে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে নগদ প্রায় ৬০ হাজার টাকা, সোনার গহনাসহ শাড়ি-কাপড় নিয়ে যায়। তাছাড়া ডাকাতদল তার মেয়ের দিকেও নজর দেয়। যদিও কৌশলে সে যাত্রা রক্ষা পান তারা। তিনি জানান, সেইরাতে তার ভাইপো জাহাঙ্গীরের বাড়িসহ ছাকার মোড় এলাকার আরও চার বাড়িতে ডাকাতি সংঘটিত হয়।
মাস দেড়েক ধরে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার মাটিকোমরা গ্রামে লাগাতার ডাকাতি, চাঁদাবাজি আর মাদক দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে টাকা কামিয়ে নেওয়ার ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে গ্রামবাসী। সেকারণে স্থানীয় যুবকরা কয়েকদিন ধরে পালাক্রমে এলাকায় পাহারা দিচ্ছিল।
৮ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে নাম্বারবিহীন একটি প্রাইভেটকারসহ দুটি গাড়িতে সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশের তিন সদস্যসহ কয়েকজন স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী ও নানা অপকর্মের হোতা জহিরুলের বাড়িতে অবস্থান নেয়। সেখানে তারা নেশা ভাং করছিল। স্থানীয় লোকজন ডাকাত ভেবে তাদের উপর চড়াও হয়।
গ্রামের নারীরা জানান, লোকজন নাম্বারবিহীন গাড়ি এবং সাদা পোশাকধারী লোকজনের উপর চড়াও হলে তারা নিজেদের পুলিশ দাবি করে। কিন্তু তাদের কাছে পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে কিংবা তাদের কোনও অফিসারকে ফোন করতে বললেও তারা তা করেননি। সেকারণে গ্রামের লোকজন তাদের মারধর করে।
পরে রাত ১২টার দিকে খবর পেয়ে ঝিকরগাছা তানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের উদ্ধারসহ হাজিরবাগ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফারুক হোসেন ও তার ভাইপো আশাদুল ইসলামকে মারধরসহ আটক করে। পরদিন ৯ নভেম্বর পুলিশ ওইগ্রামে গিয়ে হাফিজুর রহমান, করিম, মোজাফ্ফর, মোকন ঢালীসহ বেশ কয়েকজনের বাড়িতে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। ওইসময় তারা বাড়ির লোকজনকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে।
বাজার ফাঁকা
১১ নভেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, মাটিকোমরা বাজারের সব কয়টি দোকান তালাবদ্ধ। এমনকী যেসব মিষ্টির দোকানের সোকেস বাইরে থাকে, সেগুলোতে মিষ্টি থাকলেও সে অবস্থায় রয়েছে। বহুসময় দাড়িয়েও লোকজনের চলাচল খুব একটা চোখে পড়েনি। পাশে মাটিকোমরা হাই স্কুলের একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার সময় সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন ওই গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব নীলুচন্দ্র দাস। ছাগলের জন্যে কাঁঠালপাতা কাটতে গিয়েছিলেন। তিনি জানান, রাতে ভয়ে বাড়ি থাকেন না। বন্ধু-বান্ধবসহগ্রামের পুরুষরা সবারই এক অবস্থা। পাতা কাটা হলে পাশের গ্রামে চলে যাবেন।
তিনি ও শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম জানান, মাটিকোমরা বাজারটিতে হাটবার ছাড়াও প্রতিদিন প্রায় চার-পাঁচশ’ লোক সমাগম থাকে। পাশের গ্রাম বরুণা, মহেশপাড়া, ইস্তা, কুল্যা, মুকুন্দপুর, পাঁচপোতা ও কোমরচাঁদা গ্রামের লোকজনের বাজার সদাই করার স্থান মাটিকোমরা বাজার। শুক্রবার ও সোমবারে হাট বসে। প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায় বলে এই বাজারটি জমজমাট থাকে। ৮ নভেম্বর রাতের ঘটনার পর বাজারটি একদম ফাঁকা রয়েছে।
গ্রাম পুরুষশূন্য
৮ নভেম্বর রাত ও পরদিন সকাল থেকে সেখানে পুলিশি অভিযান পরিচালিত হয়। গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম ও নাজমা খাতুন জানান, পুলিশের সাথে এলাকার কয়েকজন ছিল। তারা বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুরের পাশাপাশি খুব বাজে ভাষায় গালি দিচ্ছিল। আনোয়ারা জানান, তার স্বামী বিদেশে থাকেন। পুলিশ তার কলেজ পড়–য়া ছেলেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। তারা জানান, এলাকায় ডাকাতির ঘটনা অহরহ ঘটে। গ্রামবাসীর ধাওয়ায় পালিয়ে যাওয়া ডাকাতদের জুতা-স্যান্ডেল উদ্ধার করে বোঝা যায় এগুলোর মালিক কারা। কিন্তু ভয়ে আমরা কেউ কথা বলতে পারি না। পুলিশি অভিযানে সেইসব লোককে তাদের সঙ্গে দেখা গেছে।
গৃহবধূরা জানান, এই গ্রামের তিন শতাধিক পুরুষ বিদেশে থাকে। সেকারণে ডাকাতদের নজর আমাদের দিকে। তারা মেয়েদের গলায় অস্ত্র ধরে টাকা পয়সা গহনা লুট করে নিয়ে যায়।
বাজার জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন গোলাম কাদের (৭২) বলেন, মেম্বার ফারুক হোসেন খুব ভাল মানুষ। পুলিশ তাকে ধরে মেরে পা ভেঙে দিয়েছে। আটক করে নিয়ে গেছে বহু মানুষকে। সেকারণে মসজিদে এখন লোক হচ্ছে না। প্রতি ওয়াক্তে তিন চারজেনর বেশি নামাজি পাওয়া যাচ্ছে না। জুমআর নামাজে যেখানে তিন-চারশ’ মুসল্লি আসে, গত শুক্রবার সেখানে ১০জন নামাজ আদায় করেছে।
স্কুলে অাসছে না বাচ্চারা
মাটিকোমরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক আজাহারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, স্কুলে প্রায় ৫শ’ শিক্ষার্থী। কিন্তু এখন সবমিলিয়ে ক্লাসে এসেছে মোটে ৮০জন। তারপরও মাটিকোমরা গ্রামের বাচ্চারা কম। ১০ নভেম্বর শিক্ষকদের বলেছিলাম, গ্রামের মসজিদগুলো থেকে মাইকিং করতে যেন ছেলেমেয়েরা আজ (১১ নভেম্বর, রবিবার) স্কুলে আসে। কিন্তু এরপরও কেবল মেয়েরা এসেছে, তাও এই কয়জন।
তিনি জানান, এই গ্রামের বাসিন্দা এবং স্কুলশিক্ষকসহ কর্মচারী মিলিয়ে চারজন অনুপস্থিত রয়েছেন। এবার ৭২ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ফরম ফিলাপ করেছে মাত্র ৫২জন। এরমধ্যে পুলিশ তিনজন শিক্ষার্থীকে আটকও করেছে।
হাজিরবাগ ইউপির চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মিন্টু ঢাকায় অবস্থান করছেন। তবে, মোবাইলফোনে কয়েকদফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি তা রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ঝিকরগাছা থানায় দুটি মামলা দায়ের করে। মামলায় ৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৫০জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার দিন রাত ও পরদিন যে ৪৪জনকে আটক করা হয়, তাদের ওইসব মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য
পুলিশ কর্তৃক বাড়িঘর ভাংচুরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনসার উদ্দিন। তিনি বলেন, পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে একটি চক্র এসব অপপ্রচার করছে।
তিনি বলেন, পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় সবাই জড়িত নয়; সেকারণে মামলায় আসামি করা হয়েছে অল্প কয়েকজনকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে যদি কেউ নির্দোষ হয়, তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেখানকার মানুষ নিজ থেকেই আতঙ্কবোধ করছে। সেকারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কমিউনিটি পুলিশ দিয়ে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে বলে তিনি বলেন।
১২.১১.১৮
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৮