শাহাদুজ্জামান কবি নন- নিজেকে তিনি কবি বলে দাবি করেছেন এমনটি কখনো শুনিনি; তাঁর দীর্ঘ সাহিত্যকর্মের ফর্দে আমরা কখনো কোন কবিতা দেখিওনি। এরপরও, বাংলা কবিতার ‘বাঁকবদলের’ কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখা ‘একজন কমলালেবু' যেন এক কবির ভাবালুতাকে কথাসাহিত্যের ভ্যান্টেজ পয়েন্ট থেকে নির্মোহ বিশ্লেষণের সাগ্রহ প্রচেষ্টা। শাহাদুজ্জামান কবি না হতে পারেন, তিনি চলচ্চিত্রবোদ্ধা হিসেবে বোদ্ধা মহলে পরিচিত। হয়ত সে কারণেই চলচ্চিত্র ভাষার সুনিপুণ কিছু প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই 'একজন কমলালেবু' বইটির একদম শুরুর পৃষ্ঠা থেকেই। 'বিকেলের রোদে রক্তাপ্লুত ট্রাম' শিরোনামের প্রথম অধ্যায়টি তিনি শুরু করেছেন একটি ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে, "পুরোনো শতাব্দীর ধুলোমাখা একটা সরীসৃপের মতো কলকাতার বালিগঞ্জ ডাউন ট্রাম ঘন ঘন ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দিকে"। পাঠককে দমবন্ধ করা এক উৎকণ্ঠার মধ্যে ঠেলে দিয়ে তিনি বইটি শুরু করার জন্য বেঁছে নিয়েছেন জীবনানন্দের জীবনের অন্তিম মুহূর্তটিকে। শেষ দৃশ্য দিয়ে শুরু করার টেকনিকটি চলচ্চিত্রে বহুল ব্যবহৃত সাহসী এক পদ্ধতি; যার নজির আমরা দেখি কালজয়ী চলচ্চিত্র সিটিজেন কেইন, সানসেট বুলেভার্ড থেকে শুরু করে মেমেন্টো, ফাইট ক্লাব হয়ে হালের ইনসেপশন এবং অ্যারাইভালে। এই প্রথম অধ্যায়েই পাঠক ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড, মিজ অঁ সিন সহ বেশকিছু সিনেম্যাটিক এডিটিং টেকনিকের সাহিত্য প্রয়োগের আভাস পেয়ে যাবেন। যেমন, ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড করে তিনি লিখছেন, "হাসপাতালের করিডরে কবিতায় পাওয়া এক মেডিকেল ছাত্র ভূমেন্দ্র গুহকে ছোটাছুটি করতে দেখা যাবে। বহুকাল পর জীবনানন্দের জীবন নিংড়েই কাটবে ভূমেন্দ্রের জীবন"। এ ধরণের ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ডের নজির আমরা দেখতে পাবো বইটির পরতে পরতে। অধ্যায়টি তিনি শেষ করেছেন এই প্রশ্ন রেখে:
"এটা কি একটা দুর্ঘটনা?
নাকি তিনি ট্রামের চাকার নিচে আত্মহত্যা করেছেন?
অথবা একটা কি আসলে একটা হত্যাকাণ্ড, যার পেছনে রয়েছে আরও অনেকের অদৃশ্য হাত?”
এটি গোটা বইটিরও শেষ দৃশ্যের বয়ান।
এরপর বইটি মোটামুটি সরলরৈখিক ভাবে এগিয়ে যাবে, জীবনানন্দের মা কবি কুসুমকুমারী দাশের সান্নিধ্যে কাটা শৈশব থেকে শুরু করে, যৌবনে শোভনা দাশের প্রত্যাখ্যান, স্ত্রী লাবণ্য দাশের গঞ্জনা, চাকরিহীন কলকাতা জীবনের হাহাকার, বরিশাল ফিরে সঙ্গীহীন জীবন, দেশভাগ-পরবর্তী কলকাতার অনিশ্চয়তা পেরিয়ে শেষ জীবনের পরাবাস্তব মৃত্যুবীক্ষার মধ্যে। তাই বলে গতানুগতিক জীবনালেখ্য বা জীবনীগ্রন্থও এটি নয়। 'একজন কমলালেবু'র নানা জায়গায় কবিতার মোক্ষম কিছু ছত্র তুলে দিয়ে লেখক নির্দেশ করেছেন সেসব কুয়াশাচ্ছন্ন পংক্তির জীবনানুগ সম্ভাব্য উৎসমূল। লক্ষ করলে বোঝা যাবে, বইটিতে তিনটি প্রবাহ সমান্তরাল ভাবে বয়ে গিয়েছে:
১) জীবনানন্দ দাশের ডায়েরি থেকে পাওয়া ব্যক্তিজীবন
২) এর সাথে মিলিয়ে তাঁর কবিতার গতিপ্রকৃতি ও বাঁকবদল এবং
৩) অনাবিষ্কৃত (কিংবা অধুনা আবিষ্কৃত ও উপেক্ষিত) গল্প-উপন্যাসের থিমেটিক বিশ্লেষণ
জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবনের সাথে কবিতা মিলিয়ে পড়ার বিষয়টি শোনা যাক শাহাদুজ্জামানের জবানিতেই, “...জীবনানন্দ যে কবিতাগুলো লিখেছেন সেগুলো এমনিতেই স্বয়ম্ভূ। তবু তাঁর ডায়েরির সাথে মিলিয়ে পড়লে এর ব্যক্তিগত মাত্রা এড়িয়ে যাবার উপায় থাকেনা"। কিন্তু কবিতার সাথে মিলিয়ে পড়তে গিয়ে জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবনের নির্কাব্য ক্লেদও শাহাদুজ্জামানের নির্মোহ প্রতিচিত্রায়ণ থেকে বাদ পড়েনি। নিস্পৃহ ঋষির মত তিনি বর্ণনা করেছেন জীবনানন্দ দাশের বেশ্যাগমন, স্বমেহন, কিংবা কাব্যহিংসার মত অতি ব্যক্তিগত বিষয়ও।
শাহাদুজ্জামান বহুমুখী কর্মযজ্ঞে ঋদ্ধ একজন মানুষ- চলচ্চিত্র বিশ্লেষক ছাড়াও তাঁর আরেক পরিচয় তিনি একজন চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী, কোয়ালিটেটিভ গবেষণাপদ্ধতি যার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আর এই কোয়ালিটেটিভ থিমেটিক অ্যানালিসিসের অনবদ্য সাহিত্য-প্রয়োগ আমরা দেখি যখন তিনি উপর্যুক্ত দুইটি ধারার সাথে জীবনানন্দের অপ্রকাশিত উপন্যাসের সংশ্লেষ সাধন করে, এক ধরণের আত্মজৈবনিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে শুরু করেন। চাকরিহীন কলকাতা জীবনের দুঃসহ সময়গুলোতে জীবনানন্দ দাশ যা আগে কখনো করে দেখেননি, তাই করতে শুরু করলেন- গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন; যেগুলো তিনি প্রকাশ না করে বরং সারা জীবন গুপ্তধনের মত আগলে রেখেছিলেন। শাহাদুজ্জামান লিখছেন, "বলা যায় জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসগুলো প্রায় সর্বাংশেই আত্মজৈবনিক। তাঁর নিজের জীবনের সংকটগুলো নিয়েই তিনি নাড়াচাড়া করেছেন সেই গল্পে। গল্প-উপন্যাসগুলো যেন তাঁর ডায়েরিরই এক সম্প্রসারিত রূপ”। প্রায় নির্ভুল কালক্রমে জীবনানন্দ যখন গল্প-কবিতা লেখা শুরু করছেন, তাঁর গল্পের নায়কও তখন গল্প লিখছেন ও তার পেছনের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণাদি উপস্থাপন করছেন। ঠিক জীবনানন্দের জীবনের ঘটনাবলীর সাথে তাল রেখে তাঁর গল্প-উপন্যাসের নায়করাও হয়েছেন চাকরিচ্যুত, প্রেম-প্রত্যাখ্যাত, নব-বিবাহিত, উপেক্ষিত, মোহ-নিষ্ক্রান্ত, প্রতারিত, ব্যর্থ, সংশয়াবীষ্ট অথবা হতাশাগ্রস্থ। শুধু নিজের জীবনই নয়, অনেক সময় ঝনঝাক্ষুব্ধ দাম্পত্যের খলনায়ীকা লাবণ্যের চরিত্রটিও তিনি এঁকেছেন প্রগাঢ় মমতা ও মনোবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণী অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। সুখের কথা, এই সূক্ষ্ম বিশ্লষেণধর্মী জীবনানুষঙ্গগুলো লেখকের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি তাঁর নৃবিজ্ঞানীসুলভ অনুসন্ধানী পর্যালোচনার বদৌলতে।
'একজন কমলালেবু'র সমালোচনা কী হতে পারে? হয়ত প্রশ্ন উঠতে পারে এটি কি একটি উপন্যাস, মূলানুগ জীবনালেখ্য, জীবনানন্দ সাহিত্যের ক্রিটিকাল বিশ্লেষণ, নাকি অন্য কিছু? কী এর ক্যাটেগরি বা টাইপোলজি? এর উত্তর লেখক ভাল দিতে পারবেন; তবে আলোচক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, তিনি বরং এই আরোপিত ক্যাটেগরিগুলোকে ভাঙতে চান। সময়কে ভেঙেচুড়ে তিনি মেতেছেন ফ্ল্যাশব্যাক, ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ডের খেলায়; লেখার ফর্মকেও হয়ত তিনি ভাঙতে চেয়েছেন, দিতে চেয়েছেন বহুমুখী মাত্রা। প্রশ্ন উঠতে পারে, এত কবি থাকতে জীবনানন্দ দাশ কেন? এর উত্তরও লেখকই ভাল দিতে পারবেন; তবে আলোচক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, তিনি একটা ডাক দিতে চেয়েছেন- ‘বাঁকবদলে'র ডাক। শাহাদুজ্জামান কবি নন- নিজেকে তিনি কবি বলে দাবি করেছেন এমনটি কখনো শুনিনি, তাঁর দীর্ঘ সাহিত্যকর্মের ফর্দে আমরা কখনো কোন কবিতা দেখিওনি। এই 'সুবিধা'টুকুই হয়ত তিনি নিতে চেয়েছেন। তিনি বলছেন, “বাংলা সাহিত্যকে পুষ্টি দিয়ে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছেন [রবীন্দ্রনাথ]।...সমান্তরালে জীবনানন্দের জীবন নেহাতই নিষ্প্রভ।...অথচ নিভৃতে কবিতার যে সুড়ঙ্গ জীবনানন্দ কেটেছেন, সেটাই হয়েছে বাংলা কবিতার পরবর্তী গন্তব্য। পরবর্তী প্রজন্মের কবির কাছে রবীন্দ্রনাথ নন, জীবনানন্দ হয়েছেন নতুন দিশারী"। কবিতার মায়াবী কুহেলিকা থেকে নিজেকে একটি পক্ষপাতশূণ্য অবজেক্টিভ ভ্যান্টেজ পয়েন্টে স্থাপন করে, শাহাদুজ্জামান হয়ত আজকের কবিদেরকেও এই তাগাদাটিই দিতে চেয়েছেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: দৈনিক যুগান্তরের সাহিত্য সাময়িকী, ১০ মার্চ ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:১১