গত ১ জুলাই, ২০১১ দিবাগত রাত তিনটার দিকে বাংলাদেশের এক প্রান্তে একটা ঘটনা ঘটেছে।সে সময় হয়ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটতে যাচ্ছে আরো অনেক চমকপ্রদ ঘটনা; সবাই ব্যস্ত সেটা নিয়ে। তাই হয়ত মিডিয়া, নেতৃবৃন্দ কিম্বা প্রশাসনের সুযোগ হয়নি এমন সামান্য একটা ঘটনার দিকে নজর দেয়ার। যে ঘটনা একটা পরিবারের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তাদের কোলের সন্তানকে, শোকে পাগলপারা করেছে সেই পরিবারটির গুটিকয়েক বন্ধু আর স্বজনকে। এমন অঘটন তো এই সোনার দেশে বিরল নয়।
আমাদের বন্ধু জহিরুল হক, ঢাকা থেকে সপরিবারে কক্সবাজার যাচ্ছিল।চকোরিয়া উপজেলার খুটাখালী মেধাকচ্ছপিয়া ঢালা এলাকায় একদল সশস্ত্র ডাকাত গাছের গুড়ি ফেলে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করে।ডাকাতরা সবাইকে মেরে ফেলতে পারে ভেবে ড্রাইভার গাড়ি না থামিয়ে কক্সবাজারের দিকে গাড়ি টান দেয়। ডাকাতরা পেছন থেকে গুলি ছুঁড়লে তা জহিরুলের বাহুতে লাগে। গুলিটা তার বাহু ভেদ করে বুকে ঘুমিয়ে থাকা তিন বছরের মেয়ে নুহার মাথায় বীদ্ধ হয়। বাবার হৃদপিন্ড বাঁচিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আমাদের মেয়ে নুহা।
গত কয়েকদিনে আমার পরিচিত গন্ডির মাঝেই অনেক মানুষ এমন বেশ কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়েছে (তার একটির বর্ণনা পাবেন এখানে )। অথচ এর প্রায় কোন ঘটনাই সেভাবে মিডিয়াতে আসেনি; পুলিশের কাছ পর্যন্তও যাওয়ার সাহস পায়নি বেশিরভাগ ভুক্তভোগী। দেশের রাজনৈতিক ডামাডোলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই সাম্প্রতিক চরম অবনতির সংবাদ স্থান করে নিতে পারেনি বেশিরভাগ পত্রিকার ছোট্ট কোণাতেও। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও গুরুত্ব পেয়েছে কেবল রাজনৈতিক হানাহানি, দেশের সম্পদ বিক্রি- ইত্যাদি।এই বিষয়গুলোর গুরুত্বকে খর্ব না করেই হয়ত আমাদের মত সাধারণ নাগরিকদের অন্যতম প্রধান সমস্যা- নিরিপত্তার ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক দাবি হিসেবে প্রতিফলিত হতে পারত সমাজের দর্পন হিসেবে পরিচিত মিডিয়ার পাতায়।
আমাদের মিডিয়া, আমাদের তখাকথিত নেতা নেতৃরা ব্যস্ত দেশের সংবিধানে কি সংযোজন বিয়োজন হল তা নিয়ে।আমরা যারা খেযে পরে কোন মতে জীবন কাটাই; যাদের কোন দিনও হয়ত সংবিধান পড়ে দেখার কিম্বা ওখানে কি থাকা উচিত সে বিষয়ে মতামত দেয়ার সুযোগও হবে না- তাদের জন্য মিডিয়ার, নেতাদের, প্রশাসনের কী ঠেকা পড়েছে সময় অপচয় করার? অথচ যাদের জন্য এই সংবিধান, যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সংবিধান নিয়ে সবার এত উৎকণ্ঠা- সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যদি এভাবে অপরাধের বলি হতে হয়, তাহলে কী হবে সেই সংবিধান দিয়ে? কার জন্য আমাদের এত সংগ্রাম, এত স্বপ্নের জাল বোনা?
জহিরুল তার ফেসবুক পাতায় লিখেছে, ‘নুহা বলত- আমার আব্বু বেস্ট আব্বু, আমার আম্মু বেস্ট আম্মু; আর আমি আমার আব্বু আম্মুর বেস্ট নুহা। নিজের জীবন দিয়ে তার বাবাকে বাঁচিয়ে, সে যে আমার বেস্ট নুহা তা প্রমাণ করে গেল। মামনি, তুমি আমার বেস্ট নুহা, তুমি ঘুমিয়ে ছিলে আমার বুকের মঝে, এবং সারাজীবন ওখানেই থাকবে’। নুহা আজ শুধু জহিরুলের সন্তান নয়; নুহা আজ আমাদের সবার আদরের মেয়ে। আমাদের বেস্ট নুহা আমাদেরকে অকালে ছেড়ে চলে গেল। অথচ ‘বেস্ট’ বাবা মা হিসেবে আমরা তো পারিনি আমাদের বেস্ট মেয়েটির অকাল অগস্ত্যযাত্রার গতিরোধ করতে। এমনকি পারিনি অপরাধীদের সনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করতে।
(নুহার হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে এবং সকল নাগরিকের সামগ্রিক নিরাপত্তার দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানব বন্ধন হবে জুলাই ১৯, ২০১১ তারিখে; বেলা ১১টা থেকে। সবাইকে অংশগ্রহণের আবেদন জানানো হচ্ছে।)