দ্বিতীয় মুহাম্মদ ছিলেন ৭ম উসমানীয় সুলতান। তিনি মুহাম্মদ ফাতেহ অর্থাৎ বিজয়ী মুহাম্মদ নামে পরিচিত। ১৪৪৪ সালের আগস্ট থেকে ১৪৪৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি সুলতান ছিলেন। তারপর ১৪৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় মসনদে অসেন। দ্বিতীয় দফায় তিনি ১৪৮১ সালের মে পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ২১ বছর বয়সে তিনি কনস্টান্টিনোপল জয় করেন। তার ফলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়। মুহাম্মদ আনাতোলিয়া এবং বসনিয়া পর্যন্ত দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ অভিযান অব্যাহত রাখেন। আধুনিক তুরস্ক এবং মুসলিম বিশ্বে সুলতান মুহাম্মদ একজন বীর হিসেবে সম্মানিত হন। তার স্মরণে ইস্তানবুলের ফাতিহ জেলা ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ সেতু এবং ফাতিহ মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে।
প্রারম্ভিক শাসনকাল
শাহজাদা মুহাম্মদ ১৪৩২ সালের ৩০শে মার্চ উসমানীয় রাজধানী এদির্নে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ এবং মা হুমা খাতুন।অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ১১ বছর বয়সে তাকে প্রথা অনুযায়ী আমাসিয়া শাসনের জন্য প্রেরণ করা হয়। তার পড়াশোনার জন্য সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ কয়েকজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন। ইসলামি শিক্ষা তার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। কনস্টান্টিনোপল জয় করার ক্ষেত্রে তরুণ বয়সে আকশামসউদ্দিন তার উপর প্রভাব ফেলেছিলেন।
১৪৪৪ সালের আগস্টে আনাতোলিয়ার কারামানিদের সাথে শান্তি স্থাপনের পর সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ মসনদ ত্যাগ করেন এবং দ্বিতীয় মুহাম্মদ মাত্র ১২ বছর বয়সে সুলতান হন। পোপের প্রতিনিধি কার্ডিনাল জুলিয়ান সিসারিনির মদদে হাঙ্গেরির রাজা মুসলিমদের সাথে চুক্তি লঙ্ঘন করেন। জুলিয়ান তাকে বোঝান যে মুসলিম সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করলে তা বিশ্বাসঘাতকতা হবে না। হাঙ্গেরির জানোস হুনয়াডির নেতৃত্বে পরিচালিত ক্রুসেডকে মুহাম্মদ প্রতিহত করতে সক্ষম হন।সেসময় মুহাম্মদ তার পিতা মুরাদকে পুনরায় মসনদে বসার অনুরোধ করেন কিন্তু মুরাদ তাতে অস্বীকৃতি জানান। মুহাম্মদ তার ফলে ক্রুদ্ধ হন এবং পিতার কাছে পাঠানো চিঠিতে লেখেন যদি আপনি সুলতান হন তবে এগিয়ে এসে সেনাদের নেতৃত্ব দিন। যদি আমি সুলতান হই তবে আমি নির্দেশ দিচ্ছি আপনি আমার সেনাদের নেতৃত্ব দিন। তারপর মুরাদ দায়িত্বগ্রহণ করেন এবং ১৪৪৪ সালে ভার্নার যুদ্ধে জয়লাভ করেন।মুরাদের পুনরায় ক্ষমতাগ্রহণের ক্ষেত্রে উজিরে আজম হালিল পাশার ভূমিকা ছিল। মুহাম্মদের শিক্ষক আকশামসউদ্দিনের সাথে হালিল পাশার বিরূপ সম্পর্ক থাকায় তিনি মুহাম্মদের শাসনের পক্ষে ছিলেন না।
এটি সুলতান মুহাম্মদের নির্দেশে ১৪৫১সাল থেকে ১৪৫২ সালের মধ্যে নির্মিত দুর্গ রুমেলিহিসারি এর চিত্র।
১৪৫১ সালে পুনরায় মসনদে বসার পর সুলতান মুহাম্মদ নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করতে শুরু করেন এবং কনস্টান্টিনোপল আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। বসফরাসের পূর্বে এশীয় অংশে তার প্রপিতামহ প্রথম বায়েজীদ আনাদোলুহিসারি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। মুহাম্মদ ইউরোপীয় অংশে রুমেলিহিসারি দুর্গ নির্মাণ করেন ফলে প্রনালীর উপর উসমানীয়দের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়। এরপর প্রণালী অতিক্রমকারী জাহাজের উপর করারোপ করা হয়। ভেনিসিয়ান একটি জাহাজ নির্দেশ অমান্য করায় সেটিকে কামানোর গোলার আঘাতে ডুবিয়ে দেয়া হয় এবং নাবিকদের শিরচ্ছেদ করা হয়।
কনস্টান্টিনোপলে প্রথম অবরোধের সময় শহরের নিকটে দাফন করা সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারির কবর আকশামসউদ্দিন খুজে পেয়েছিলেন। বিজয়ের পর মুহাম্মদ এখানে আইয়ুব সুলতান মসজিদ নির্মাণ করেন।[১৪৫৩ সালে মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেন। এসময় তার বাহিনীতে সেনা সংখ্যা ছিল ৮০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ এবং জাহাজ ছিল ৩২০টি। এপ্রিলের শুরুর দিকে শহর অবরোধ করা হয়। অবরোধের সময় উসমানীয়রা উরবানের নির্মিত প্রকান্ড কামান থেকে গোলাবর্ষণ করে। গোল্ডেন হর্নের প্রবেশপথে বিশালাকার শেকল স্থাপনের ফলে সেখানে প্রবেশের ক্ষেত্রে তুর্কিরা বাধার সম্মুখীন হয়। মুহাম্মদ তার জাহাজগুলিকে মাটির উপর দিয়ে টেনে গোল্ডেন হর্নে নিয়ে আসেন। ২৯শে মে শহরের পতন হয়। বিজয়ের পর মুহাম্মদ এদির্ন থেকে রাজধানী সরিয়ে কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে আসেন।
৩৩০ সাল থেকে কনস্টান্টিনোপল রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এবং শহরের অধিকারী সাম্রাজ্যের শাসক হতেন। একারণে কনস্টান্টিনোপল জয়ের পর মুহাম্মদ রোমান সম্রাটদের মত কাইসারই রুম বা সিজার উপাধি ধারণ করেন।সমসাময়িক পণ্ডিত জর্জ অব ট্রেবিজন্ড এক্ষেত্রে সুলতানকে সমর্থন করেছিলেন। ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ এই ঘোষণা মেনে নিলেও ক্যাথলিক চার্চ এবং পশ্চিম ইউরোপ তা মেনে নেয়নি। গেন্নাডিয়াস স্কলারিয়াসকে সুলতান কনস্টান্টিনোপলের পেট্রিয়ার্ক মনোনীত করেন।বাইজেন্টাইন সম্রাট একাদশ কনস্টান্টাইন কোনো উত্তরসূরি না রেখে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত বড় ভাইয়ের পুত্ররা তার উত্তরাধিকারী হওয়ার কথা ছিল। সুলতান মুহাম্মদ তাদেরকে প্রাসাদের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র হাস মুরাদকে মুহাম্মদ পছন্দ করতেন। তাকে বলকান বেলেরবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। কনিষ্ঠ পুত্র মেসিহ পাশা একজন নৌ সেনাপতি হন এবং গেলিপলির সানজাক বে নিযুক্ত হন। তিনি পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের উজিরে আজম নিযুক্ত হয়েছিলেন।কিছু ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ১০ বছর পর মুহাম্মদ ট্রয় সফর করে বলেন যে গ্রীক তথা বাইজেন্টাইনদের জয় করার মাধ্যমে তিনি ট্রোজানদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নিয়েছেন।
ফাতিহ মসজিদ উসমানীয়দের জয়ের পর কনস্টান্টিনোপলে প্রথম এই মসজিদ নির্মিত হয়।
কনস্টান্টিনোপল জয়ের পর তিনি হাজিয়া সোফিয়া শাহাদাহ ঘোষণার নির্দেশ দেন। হাজিয়া সোফিয়াকে সেসময় মসজিদে রূপান্তরিত করা হয় ফলে কনস্টান্টিনোপলে ইসলামি শাসনের ভিত্তি দৃঢ় হয়।মুহাম্মদ শহর পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। পালিয়ে যাওয়া গ্রীক এবং জেনোয়েসদের ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে তিনি তাদের বাড়িঘর ফিরিয়ে দেন এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন। তিনি নির্দেশ জারি করেন যে মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদেরকে শহরে বসতি স্থাপন করতে হবে এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে পাঁচ হাজার বসতবাড়ি শহরে স্থানান্তর করতে হবে।সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে সেসময় লোকেরা এসে সেখানে বসতি স্থাপন করেন।গ্রীক অর্থোডক্স পেট্রিয়ার্ককে পুনর্বহাল করার পাশাপাশি মুহাম্মদ ইহুদি রেবাই এবং আর্মেনীয় পেট্রিয়ার্ককে নিয়োগ দেন। তার উজিরদেরকে তিনি বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেন। তার মধ্যে রয়েছে উজিরে আজম রুম মুহাম্মদ পাশা নির্মিত রুম মুহাম্মদ পাশা মসজিদ। এসকল পদক্ষেপের ফলে শহরের দ্রুত উন্নয়ন হয়। ১৪৭৮ সালের জরিপ অনুযায়ী তৎকালীন সময়ে কনস্টান্টিনোপল এবং পার্শ্ববর্তী গালাতায় ১৬,৩২৪ বাড়িঘর এবং ৩,৯২৭টি দোকান ছিল এবং আনুমানিক জনসংখ্যা ছিল ৮০,০০০। এর মধ্যে ৬০% ছিল মুসলি, ২০% খ্রিষ্টান এবং ১০% ইহুদি।মুহাম্মদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী নির্মাণ প্রকল্পের ফলে শহর রাজকীয় রাজধানী হিসেবে গড়ে উঠে। সমকালীন উসমানীয় ইতিহাসবিদ নেশরির মতে সুলতান মুহাম্মদ ইস্তানবুলের সবকিছু নির্মাণ করেছিলেন। সমসাময়িক উসমানীয় ইতিহাসবিদ সুলতান মুহাম্মদ ইস্তানবুলের সবকিছু নির্মাণ করেছেন। পঞ্চাশ বছর পরে কনস্টান্টিনোপল ইউরোপের সবচেয়ে বৃহৎ শহরে পরিণত হয়।
সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের পাঁচজন স্ত্রী ছিলেন
১। আমিনা গুলবাহার খাতুন (বিয়ে ১৪৪৬), এক আলবেনীয় বের কন্যা
২। গুলশাহ খাতুন
৩। সিত্তিশাহ খাতুন, এর সাথে বিয়ে সম্ভবত ১৪৪৯ সালে, দুলকাদির রাজ্যের ষষ্ঠ শাসক সুলাইমান বের কন্যা।
৪। চিচেক খাতুন এর সাথে বিয়ে ১৪৫৮সালে তিনি আলি বের কন্যা ।
৫। খাদিজা খাতুন, ইনি জাগান পাশার কন্যা ।
সন্তানগণ হলেনঃ
দ্বিতীয় বায়েজীদ, সিত্তিশাহ বা আমিনা গুলবাহারের পুত্র
সুলতান জেম,চিচেকের পুত্র
মুস্তাফা, গুলশাহর পুত্র
গেভেরহান, আমিনা গুলবাহারের কন্যা
সুলতান মুহাম্মদ তুর্কি, আরবি, ফার্সি, গ্রীক এবং ইতালীয় ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।বিভিন্ন সময়ে তিনি তার উপস্থিতিতে আলেমদেরকে বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনার জন্য আহ্বান করতেন। তার শাসনামলে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে উসমানীয়রা প্রভূত উন্নতি লাভ করে। সুলতান নিজে আভনি ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। তার কবিতা নিয়ে একটি দিওয়ান রয়েছে।
দ্বিতীয় মুহাম্মদের মাজার, ফাতিহ, ইস্তানবুল
১৪৮১ সালে নতুন অভিযানকালে ইস্তাবুলের মালতেপেতে পৌছানোর পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছু দিন পর ৩ মে ৪৯ বছর বয়সে সুলতান মুহাম্মদ ইন্তেকাল করেন। তাকে ইস্তানবুলের ফাতিহ মসজিদ সংলগ্ন স্থানে দাফন করা হয়।ধারণা করা হয় যে তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল। একটি সূত্র অনুযায়ী ইহুদি থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত ইয়াকুব পাশা এর সাথে জড়িত। আরেকটি সূত্রমতে তার পার্সিয়ান চিকিৎসক তাকে বিষপ্রয়োগ করেছিল।সুলতান মুহাম্মদের মৃত্যুতে ইউরোপে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সেই উপলক্ষে গির্জার ঘন্টা বাজানো হয় এবং উদযাপন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ভেনিসে ঘোষণা করা হয়ঃ লা গ্রান্দে একুইলা এ মরতা! অর্থাৎ মহান ঈগল মৃত!
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট।
আরও জানতে
http://www.sabah.com.tr/yazarlar/barlas/2006/05/30/fatih_19_yasinda_alti_dili_cok_iyi_biliyordu
Click This Link
http://www.milliyet.com.tr/2004/12/19/pazar/yazortay.html
http://www.washingtonpost.com/wp-srv/style/longterm/books/chap1/constantinople.htm
http://www.milliyet.com.tr/fatih-hakan-ve-roma-kayzeri/ilber-ortayli/pazar/yazardetay/03.06.2012/1548527/default.htm
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৫০