শিখা বেগম উচ্চতায় ছোট-খাট একজন মানুষ। প্রায় চার ফুট নয় ইঞ্চির মতো উচ্চতা তাঁর। গায়ের রঙ শ্যামলা। তবে তাঁর চেহারা খুব ভালো। অল্প বয়সে আরও ভালো ছিল। আলাদা আলাদা করে দেখলে তাঁর চোখ-নাক-ঠোঁট-দাঁত কিংবা হাসি কোন কিছুতেই তেমন বিশেষত্ব ছিল না। তবু সব মিলিয়ে একসাথে দেখলে তাঁর চেহারা ভালোই মনে হত। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে চেহারা কোন বিবেচনার বিষয় নয়। খাটো আর কালো মেয়েরা এই দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে শুরুতেই ডিসকোয়ালিফাইড হয়ে যায়। তাঁর বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অনেক বার এভাবে অপমানিত হওয়ার পর তাঁর বিয়ে হল আলমের সাথে। শিখা বেগম সারা জীবন ধরে এই একটি মানুষের প্রেমেই হাবুডুবু খেয়েছেন। মানুষটার অনেক টাকা নেই, দেখতেও তেমন আহামরি নয়। কিন্তু অসম্ভব সুন্দর একটি মন আছে তাঁর। শিখা বেগম নিজের সঙ্গীকে হঠাত পাওয়া পরশ পাথরের মতোই বিস্ময় এবং ভালোবাসার চোখে দেখে এসেছেন সব সময়। তাঁদের একমাত্র মেয়ের নাম মেঘা। মেয়েটিও ঠিক মায়ের মতো ছোটখাট হয়েছে।
আজ সকালে মেয়ের টেলিফোন পাওয়ার পর থেকেই কাঁদছেন তিনি। তাঁর খুব আনন্দ হচ্ছে। মেঘা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট-এ রেকর্ড মার্ক নিয়ে পাশ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশীপ নিয়ে সেখানে পড়তে গেছে সে। সেখানেই একটি বাঙালী ছেলেকে বিয়ে করেছে। তারা দুজনেই দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। মেঘার বিষয় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। আর তার বরের বিষয় রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং। তাদের একটি ছেলে আছে, সাফোয়ান নাম। তিন বছর বয়স। টেলিফোনে মাঝে মাঝে নানু নানু বলে ডাক পাড়ে। কী যে মিষ্টি লাগে শুনতে! মেয়ে সুখে আছে এটাই শিখা বেগমের কাছে সবচে আনন্দের। কিন্তু আজ যে আনন্দে তাঁর বার বার চোখ ভিজে উঠছে সেই আনন্দের কারন অন্য কিছু। এই আনন্দের খবর শোনার পর থেকে আজ তাঁর জীবনের একটি অপমানের এবং গভীর বেদনার স্মৃতিও বার বার মনে পড়ছে। আনন্দের সংবাদটি হল- মেঘা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কার পেতে যাচ্ছে এ বছর। আলম স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে বললেন-
-এতো কাঁদছ কেন? আনন্দের সংবাদ তো আরও একটি আছে। এখনি চোখের সব পানি ঝরিয়ে ফেললে হবে?
শিখা বেগম চোখ মুছে দ্বিতীয় আনন্দের সংবাদটি জানতে চাইলেন স্বামীর কাছে। আলম রহস্য করে বললেন,
-বল দেখি, কী? দেখি অনুমান করতে পারো কিনা?
-কী, তোমার চাকরীর মেয়াদ বেড়েছে?
-ধূর! হয়নি।
-তাহলে কী? বুড়ো বয়সে আবার প্রেমে পড়েছ?
আলম এ কথা শুনে শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগলেন। বললেন,
-এটা তো সুখের সংবাদ হল না। আমি প্রেমে পড়লে তোমার হিংসা হবে। এটা তোমার জন্য দুঃসংবাদ। আবার চেষ্টা কর।
শিখা অধৈর্য্য হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। আলম বললেন,
-মেঘা আমাকে বলেছে আমি যেন সংবাদটি তোমাকে না জানাই। কিন্তু বুড়ো হয়ে গেছি বলে আমার পেট খারাপ হয়ে গেছে। এখন আর আমার পেটে কথা থাকে না, তাই তোমাকে বলে দিচ্ছি।
-বলছ আর কই? খালি দেরি করছ।
-বলছি। আগে একটা পান সেজে দাও।
শিখা চোখ পাকিয়ে তাকালেন। আলম সাহেব হাসতে হাসতে বললেন,
-এবার তোমার নাতীকে দেখতে পাবে চোখের সামনে।
-মানে?
-মানে মেঘা পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসবে। জামাইও যা করার আজীবন এই দেশে থেকেই নাকি করবে।
খবর শুনে শিখা বেগম আনন্দে স্বামীর গালে চুমু খেয়ে ফেললেন। তারপর লজ্জা পেয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। আলম সাহেব গালে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
-এক কাপ চা দিও তো। এরচে’ মিষ্টি হয় যেন। আজকে ডায়াবেটিসও মানব না।
কথাটা বলেই হাহ হা করে হেসে উঠলেন। প্রাণময় হাসি। সুখী মানুষের হাসি।
যথা সময়ে দেশে ফিরল মেঘা। একদিন বিকেলে শিখা বেগম তাঁর মেয়েকে বললেন,
-চল একটা বাসায় যাই।
-কোথায় যাবে?
-মাহীর উদ্দিনের বাসায়।
-মাহীর উদ্দিনটা কে?
-গেলেই দেখবি। সাথে তোর অক্সফোর্ড এর সব সার্টিফিকেট আর এই বছর অক্সফোর্ড এর সেরা শিক্ষকের সম্মাননা হিসেবে যে ক্রেস্ট, মেডেল আর সনদ দেয়া হয়েছে সেটা সঙ্গে নিবি।
মেঘা অবাক চোখে তাকাল। মা এসব কেন নিতে বলছেন কে জানে। তবু মায়ের কথার উপর কোন কথা বলল না সে। বলল,
-ঠিক আছে। শুধু ব্যাপার কী সেটা বল।
-তখন বলব।
-কখন?
-মাহীর উদ্দিনের বাসায় গিয়ে।
মাহীর উদ্দিন যে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সেই কলেজের একজন শিক্ষকের কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে মা-মেয়ে বাড়িটার মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বাড়ির নাম-পৃথিবী। বাড়ির নামের নিচে নামের চেয়ে একটু ছোট করে লেখা-
ডক্টর মাহীর উদ্দিন, পিএইচডি ইন এডুকেশন (ইংল্যান্ড)
প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাক্তন অধ্যাপক, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ।
দুইবার কলবেল চাপার পর ছোট্ট একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। সাত-আট বছর বয়স হবে মেয়েটার। শিখা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-খুকী, মাহীর উদ্দিন কি আছেন?
মেয়েটা জোরে জোরে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। শিখা বেগমের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বেশ উত্তেজনা অনুভব করছেন। একটা অপমানের জবাব দেবেন তিনি আজ। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর প্রায় তারই বয়সী এক ভদ্রলোক এসে সালাম দিলেন দুজনকে। শিখা বেগম সালামের উত্তর দিলেন। ভদ্রলোক বললেন,
-আমি মাহীর উদ্দিনের ছেলে। মানে আপনি যাকে খুঁজতে এসেছেন তাঁর ছেলে। আমার নাম সালিম উদ্দিন। আমরা কি আপনাকে কোনভাবে চিনি?
শিখা বেগম বললেন,
-না, আপনি চিনবেন না। মনে করিয়ে দিতে পারলে আপনার বাবা হয়তো চিনবেন। উনাকে একটু ডেকে দেবেন?
-ঠিক আছে, একটু বসুন।
কিছুক্ষণ পর মাহীর উদ্দিনের ছেলে পরিচয় দেওয়া ভদ্রলোক একটা হুইল চেয়ার নিয়ে এলেন ঠেলে ঠেলে। বৃদ্ধ মাহীর উদ্দিন মাথাটা একদিকে কাত করে শোধ-বোধহীনের মতো পড়ে রইলেন। একবার মাথা তুলে তাকালেন না পর্যন্ত। সালিম উদ্দিন বললেন,
-আপনি কি বাবাকে কোন কথা বলতে চান?
শিখা বললেন,
-হ্যাঁ, চাই। অনেক দিন আগের একটি ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাই।
-আপনি বলতে পারেন, কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না। বাবা কিছুই মনে করতে পারবেন না। উনার দশ মিনিট আগের কথাও মনে থাকে না। উনি আলঝেইমার্স-এ আক্রান্ত।
শিখা বললেন- ‘ও’। তাঁর কণ্ঠ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। তিনি মেঘাকে নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে এলেন। শিখা বেগম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। মেঘা বলল,
-মা, আমাকে বল তোমার কীসের এতো দুঃখ? এরকম করে কেঁদো না।
শিখা বেগম বলতে শুরু করলেন,
-তোর তখন সবে জন্ম হয়েছে। তোর বাবার ছোট চাকরিতে আমাদের খুব টানা-পোড়েনে সংসার চলছিল। এর মধ্যে একদিন আবার হুট করে উনার চাকরিও চলে গেল। মাহীর উদ্দিনের অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে গেলাম সহকারী শিক্ষক পদে চাকরীর জন্য। আমার এক আত্মীয় আগেই উনাকে আমার সব কথা বলেছিলেন। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরিবারের আর্থিক দূর্দশা-সব। সব শুনে উনি তাকে বললেন, বায়োডাটা রেডি করে আমি যেন দেখা করি উনার সাথে। নির্দিষ্ট দিন আমি আমার ইন্টারমিডিয়েটের সার্টিফিকেট নিয়ে উনার সাথে দেখা করলাম। আমার বয়স তখন বিশ-একুশ। মাহীর উদ্দিন বিদেশ থেকে পিএইচডি করে এসে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তোর বাবা আমাকে বিএ-তে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মাথায় সারাক্ষণ সংসারের চিন্তা।
এই পর্যন্ত বলে শিখা বেগম থামলেন। মেঘা বলল,
-তারপর?
শিখা আবার বলতে শুরু করলেন,
-মাহীর উদ্দিনের সাথে দেখা করলাম। উনি আমাকে দেখে সাথে সাথে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললেন, ছি ছি! এর হাইট তো একেবারেই কম। এতো খাটো মেয়ে কিভাবে শিক্ষকতা করবে?
আমি উনার কথা শুনে একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। আমি বললাম, স্যার, উচ্চতার সাথে শিক্ষকতার সম্পর্ক কী? শিক্ষকতা মানুষ মাথা দিয়ে করবে, কণ্ঠস্বর দিয়ে করবে, বাচনভঙ্গি দিয়ে করবে, উচ্চতা দিয়ে তো নয়। আমাদের এক স্যার ছিলেন খুব খাটো, কিন্তু তিনি খুব ভালো পাঠদান করতে পারতেন। এই কথা শুনে উনি বললেন, ঐ স্যার নাকি আসলে কোন স্যারই না। আমি যতটা অবাক হয়েছিলাম। তারচে বেশি রেগে গিয়েছিলাম। উনি আমাকে নিজে ডেকে নিয়ে এই অপমানটা করলেন। আমি জানি, আমি খাটো। কিন্তু উনি আমার যোগ্যতা যাচাই না করে……..।
এই পর্যন্ত বলে শিখা বেগম কাঁদতে শুরু করলেন। মেঘা একটা হাত মায়ের ঘাড়ের উপর দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। শিখা বললেন,
-আমার বাবা মারা যাবার পর আমি অনেক জায়গায় অনেক ভাবেই নিগৃহীত হয়েছি। কিন্তু সেদিনকার মতো কষ্ট কখনো পাইনি। আমি সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিলাম। এই জন্যই আজ তোকে নিয়ে এসেছিলাম। মাহীর উদ্দিনকে বলেছিলাম, আপনি একদিন আপনার এই আচরনের জন্য অনুশোচনা করবেন।
মেঘা মাকে শান্তনা দিল এই বলে,
-কেঁদোনা মা, উনি নিশ্চয়ই মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন।
পুনশ্চ ১- একটি কলেজে সহকারী শিক্ষক পদে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে এরকমই একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি নিজে। আমাকে ঐভাবে অপমান করা লোকটিও কিন্তু পিএইচডি ইন এডুকেশন, ব্র্যাকেটে লন্ডন।
পুনশ্চ ২- ‘মেঘমালা’ নামে একটি লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে শুরু করেছিলাম সামুতে। পান্ডুলিপি আধাআধি লেখা হয়ে গেছে। বই প্রকাশনা জগতের সাথে জড়িত একজন সেটা পড়ে বললেন, এটা যেন আর কোথাও প্রকাশ না করি (উনার মনে হয় কোন পরিকল্পনা আছে, যদিও আমি জানি না কী পরিকল্পনা। ) । গুরুজনের কথা শুনতে হয়। আমিও শুনি। তাই ওটা প্রকাশ বন্ধ করেছি। সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।