CENTAUREA:
এই ফুলের নাম এসেছে Centaur শব্দটি থেকে। গ্রীক পুরাণ অনুসারে, centaur হল অর্ধ-মানব এবং অর্ধ-অশ্বাকৃতির প্রাণি। এর সামনের দিক মানব আকৃতির এবং পেছনের দিক অশ্বাকৃতির। Chiron নামের একজন জ্ঞানী সেন্টর ছিলেন আরোগ্যদেব এসক্লেপিয়স, মহাবীর একিলিস, জ্যাসন এবং দেবতা এপোলোর শিক্ষক। তিনিই ছিলেন একমাত্র সেন্টর যিনি মানুষের প্রতিও সদয় ছিলেন। টাইটান যুদ্ধে ( টাইটান এবং অলিম্পীয় দেবকুলের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ ) সেন্টরের বিপক্ষে এবং হারকিউলিসের পক্ষে লড়াই করেছিল যোদ্ধা হিরন। কিন্তু হারকিউলিস দুর্ঘটনাবশত হিরনের গোড়ালি বিষাক্ত তীরে বিদ্ধ করে ফেললেন, আর হিরন মারাত্মক আহত হল তাতে। সেন্টর কীরন তখন এই ফুলের নির্যাস দিয়ে তার আহত স্থান সারিয়ে তুললেন।
এই ফুল সাধারণত কর্নফ্লাওয়ার হিসেবেই বেশি পরিচিত। কোথাও কোথাও একে ব্লু-বোটল, হার্টসিকল বা সায়ানি নামেও ডাকা হয়। এটি মুলতঃ যুক্তরাজ্য সহ বিভিন্ন দেশে গম, রাই, জব ইত্যাদি শস্যের ক্ষেতে আগাছা হিসেবে জন্মায়। পরে বাণিজ্যিক ভাবে এর চাষ শুরু হয়। শুকানো কর্নফ্লাওয়ার ভেষজ চা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একে বিশেষ উপায়ে পরিশোধিত করে এন্টি-সেপ্টিক ওষুধ বানানো হয়, যা চোখের প্রদাহ সারায় এবং প্রাকৃতিক টোনার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কয়েক প্রজাতির কর্নফ্লাওয়ার সালাদে দারুন রঙ নিয়ে আসে। বিভিন্ন পল্লীগাথা অনুসারে, আগে কোন পুরুষ প্রেমে পড়লে সে এই ফুল পরে থাকত। যদি ফুলটি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেত, তবে ধরে নেয়া হত সে পুরুষ প্রেমের প্রতিদান পাবে না। শোনা যায়, এই ফুল নাকি জন এফ কেনেডির প্রিয় ফুল ছিল।
CYPRESS:
পুরাণ অনুসারে, সাইপারিসাস নামের এক সুদর্শন যুবক বাস করত Kea দ্বীপপুঞ্জে। সে ছিল হারকিউলিসের নাতী এবং টেলিফাসের পুত্র। সে বায়ুদেব জেফিরস এবং দেবতা এপোলো উভয়ের আজ্ঞাধীন ছিল। একটি নিষ্পাপ হরিণ ছিল তার সাথী। কোন এক গ্রীষ্মের দুপুরে রোদে বসে ঘুমুচ্ছিল সেই হরিণ। সাইপারিসাস তখন ভুল করে তার বর্শা দিয়ে হরিণটিকে হত্যা করল। সে এত দুঃখ পেল এবং এতই হতাশ হল যে, এরচে তার নিজের মৃত্যু হলেই ভালো হত বলে তার মনে হতে লাগল। সে ভীষণ অনুতপ্ত হল, এবং স্বর্গের দেবতাদের কাছে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে সাহায্য এবং দয়া প্রার্থনা করল, যেন অনন্তকাল ধরে তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। দেবতারা তাকে সাইপ্রেস গাছ বানিয়ে দিলেন। সেই থেকে এই গাছটির নাম হল ‘ট্রি অব সরো’। একে শোকের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, এবং অনেক দেশেই সমাধিস্থলে এই গাছ রোপিত হয়।
ASTER:
আভিজাত্য, ভালোবাসা এবং সৌন্দর্যের প্রতীক এই ফুলের নাম দেয়া হয়েছে তারকাখচিত আকাশের দেবী Asterea’র নামে। ল্যাটিন ভাষায় Aster বলতে star বোঝানো হয়। লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, এই ফুলের আকৃতি মাটির পৃথিবী থেকে তারাগুলো যেমন দেখা যায় তেমনই। দেবী এস্টেরি পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে কোন তারা দেখতে না পেয়ে দুঃখে কেঁদেই ফেলেছিলেন নাকি। আর পৃথিবীর যেখানটায় তার চোখের জল পড়ল সেখানেই নাকি গজাল এই এস্টার ফুলের গাছ। এদের আবার ‘মাইকেলমাস ডেইসি’, ‘স্টারওয়ার্ট’ ইত্যাদি সুন্দর সুন্দর নামেও ডাকা হত কোন এক সময়। এই প্রাচীন বুনোফুল গাঁদা, ডেইসি এসব ফুলের সাথে এক কাতারে আছে।
ALTHEA:
এলথি ছিল ক্যালিডনের রাজা ইনিউসের স্ত্রী। তার ছিল দুই ছেলে- ডিয়ানেরা এবং মেলিগের। যখন মেলিগেরের বয়স সাত দিন, ভাগ্যের দেবী এলথিকে দর্শন দিলেন। দেবী বললেন, মেলিগের সেদিন মারা যাবে, যেদিন ঐ ঘরে ঐ মুহূর্তে জ্বলন্ত বাতিটির শেষটুকুও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এলথি সাথে সাথে বাতিটি নিভিয়ে ফেলল, এবং একটি গোপন বাকশে ওটা লুকিয়ে রাখল। ধীরে ধীরে মেলিগের বড় হয়ে উঠল। একদিন সে বীর যোদ্ধা হল। কিন্তু ক্যালিডনের একটি মিশনের ( Kalydon’s boar) সময় সে ভুলক্রমে এলথির ভাই, মানে তার আপন মামাদের হত্যা করে। এই ঘটনায় এলথি ক্রোধে সকল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং সেই বাতিটি আগুনে নিক্ষেপ করে। বাতিটি আগুনে পুড়ে যায়, এবং মেলিগের মৃত্যুবরণ করে। পরমূহূর্তেই এলথি বুঝতে পারে কী ভুল সে একটু আগে করে ফেলেছে। হতাশ এলথি তখন ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে। এলথির নামের সাথে মিলিয়ে ফুলটির নাম হয়ে গেছে এলথি। কিন্তু এই ঘটনার সাথে ফুলের নামকরণের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায় না।
এটি মালভেসি পরিবারের হিবিসকাস গণের একটি প্রজাতি। বৈজ্ঞানিক নাম- Hibiscus syriacus (হিবিসকাস সাইরিয়াসাস)। জবা ফুলের সাথে বেশ মিল, একই পরিবারের ফুল কিনা।( জবা ফুলের নাম- Hibiscus rosa sinensis ).
DAPHNE:
সে ছিল এক সুন্দরী পরী, নদীদেব পিনিউসের কন্যা। সে ছিল একজন শিকারী কুমারী। শিকারের দেবী আর্টেমিসের মতই আজীবন কুমারী থাকার পণ ছিল তার। কেননা- সে তার জীবন উৎসর্গ করেছিল দেবীর সেবায়। অনেকেই তাকে পেতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু ড্যাফনি কাউকে পাত্তাই দিত না। এমনকি জিউসের ক্ষমতাধর পুত্র এপোলোকেও উপেক্ষা করল সে। এপোলো গভীরভাবে তার প্রেমে পড়ে গেল। বেচারা কত চেষ্টা করল মন যোগাতে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। একদিন এপোলো তাকে বনমধ্যে বাগে আনতে চাইল। ড্যাফনি অসহায় হয়ে পড়ল এবং পিতার সাহায্য কামনা করল। পিনিউস বললেন, তিনি কেবল নদীর তীরে ড্যাফনিকে একটি লরেল গাছে পরিণত করেই তাকে এপোলোর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন। তাই হল। এপোলো এসে ড্যাফনির খোঁজ করলে পিনিউস তাকে জানালেন যে সে একটি লরেল গাছে পরিণত হয়েছে। এপোলো তখন প্রেমিকার স্মরণে সেই গাছের কিছু শাখা-পাতা কেটে নিয়ে নিজের মাথার মুকুট বানাল। এপোলো সেই গাছকে তার পূজনীয় গাছ বানাল এবং মুকুটটিকে যথাযথ সম্মান দিল। সেই থেকে সেই লরেল গাছ পরিচিত হল ড্যাফনি নামে।
প্রাচীন গ্রীসে কেউ কোন কাজে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলে তাকে ড্যাফনির মুকুট পরানো হত। প্রাচীন অলিম্পিক গেমসে সকল প্রতিযোগীকেই এরূপ মুকুট পরানো হত।
ACHILLEA:
এর সর্বাধিক পরিচিত নাম ইয়ারো। এটি দ্বন্দ-সংঘাত এর প্রতীক। হোমারের মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ যারা পড়েছেন, মহাবীর একিলিসের সাথে তারা কম-বেশি পরিচিত আছেন। তাঁর নামানুসারেই এই ফুলের নামকরণ করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, ট্রোজান যুদ্ধের সময় একিলিস এই ফুল তাঁর সহযোদ্ধাদের দিয়েছিলেন রক্ত পড়া বন্ধ করে আহত স্থান সারিয়ে তোলার জন্য। আধুনিক কালের গবেষণায় জানা গেছে, এই ফুল সত্যিই এমন রাসায়নিক পদার্থ সমৃদ্ধ, যা রক্ত তঞ্চনে সহায়তা করে।
এই ফুলকে নাকি কোন এক কালে ‘devil’s plaything’ বলা হত। কারন- লোকে বিশ্বাস করত, ঘুমানোর আগে কিছু ইয়ারো ফুল বালিশের তলায় রেখে দিলে নাকি কাম-বাসনার স্বপ্ন দেখা যায়।
ORCHID:
Orchis ছিল এক পরী এবং এক স্যাটায়ারের পুত্র। পরী তো পরী, আর স্যাটায়ার হল অনেকটা ঐ যে উপরে বললাম, সেন্টরের মতো। পুরুষ প্রাণি, যার ঘোড়ার মতো খুর, কান, আর লেজ আছে। একবার Bacchus ( ব্যাক্বাস, কৃষি এবং মদ এর রোমান দেবতা। গ্রীক দেবতা ডায়োনিসাস এর অনুরূপ।) এর জন্য দেয়া একটি উৎসব আয়োজনের ভোজসভায় এক ধর্মযাযিকাকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এর ফলস্বরূপ তাকে একটি ছোট্ট এবং হালকা ফুলে রূপান্তর করে দেয়া হয়। পরে সেই ফুলের নাম হল অর্কিড।
থিওফ্রাসটাস প্রথম অর্কিস শব্দটি বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যবহার করেন। গ্রীক নারীরা বিশ্বাস করতেন, অর্কিসের মূল তার গর্ভে থাকা অনাগত শিশুটির লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারবে। যদি বাবা বেশি পরিমাণে মূলটি খান, তাহলে শিশুটি হবে ছেলে। আর যদি মা বেশি পরিমাণে খান, তাহলে সে হবে মেয়ে।
HELLEBORE:
হেল্লেবোরের নামকরণ সংক্রান্ত কিছু গ্রীক পুরাণে পাওয়া যায় না। তবে সেখানে এই ফুলের ওষুধি গুণ সংক্রান্ত একটি কাহিনী রয়েছে। মেলাম্পাস নামের এক ভবিষ্যৎবক্তা রাজা প্রোটিয়াসের কন্যার এবং আরও একজন গ্রীক নারীর পাগলামী সারিয়েছিলেন এই গুল্ম ব্যবহার করে। ঐসব মেয়েরা মনে করত, তারা গরু। তাই তারা বন্য গরুর মতো পাহাড়ে এবং টাইরিনাস মরুভূমির চারদিকে ঘুরে বেড়াত।
এই কাজের উপহার স্বরুপ মেলেম্পাস রাজ্য এবং রাজকন্যা দুই-ই পেলেন। হেল্লেবোরে ফুল পাগলামীর প্রতীক। এর কমন নাম- ক্রিসমাস রোজ।
IRIS:
গ্রীক দেবী আইরিশ এর নামানুসারে এই ফুলের নাম দেয়া হয়েছে। আইরিশ রঙধনুর দেবী। সে জিউস এবং জিউসের স্ত্রী হীরার বার্তাবাহক হিসেবেও পরিচিত। আইরিশ স্বর্গের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীতে তার রঙধনুর রথে চড়ে বার্তা নিয়ে আসত। ‘Iris’ শব্দের মানে হল, ‘The eye of heaven’.
এর আরও একটি তাৎপর্য আছে। মানুষের চোখের কেন্দ্রকেও বলা হয় আইরিশ। এটা এই বোঝায় যে, প্রতিটি মানুষই তার চোখে এক টুকরো স্বর্গ ধারণ করে আছে।
ROSE:
গোলাপ নিয়ে বহু কিংবদন্তী গল্প আছে। গ্রীক পুরাণে এক জায়গায় পাওয়া যায়, এই ফুলটি সৃষ্টি করেছেন ফুলের দেবী ক্লোরিস। একদিন বনের পথ ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় দেবী একটি সুন্দর মৃত পরী দেখতে পেলেন। তিনি সেই পরীকে একটি ফুল বানিয়ে দিলেন ভালোবেসে। তিনি প্রেমের দেবী আফ্রোদিতিকে ডাকলেন। ডাকলেন ওয়াইনের দেবতা ডায়োনিসাসকেও। প্রেমের দেবী সেই ফুলকে দিলেন সৌন্দর্য, আর ডায়োনিসাস দিলেন সুগন্ধ। বায়ুদেব জেফিরস মেঘ পাঠালেন, আর সূর্যদেব এপোলো আলো দিলেন। তারপর সেই ফুল উজ্জ্বল হয়ে ফুটল। এ জন্যই গোলাপ হল ফুলের রানী।
পৃথিবীতে নানান রঙের গোলাপ আছে। লাল গোলাপ প্রেমের প্রতীক, আবার সমাজতন্ত্রেরও প্রতীক। ব্রিটেন, সুইডেন, স্পেন, নরওয়ে, পর্তুগাল, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, কোরিয়া, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে লাল গোলাপকে সমাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে দেখা হত। এছাড়াও গোলাপি গোলাপ আভিজাত্য এবং ভালোবাসা গ্রহণের, সাদা গোলাপ বিয়ে এবং শুভারম্ভের, কমলা গোলাপ উদ্দীপনা এবং কৃতজ্ঞতার এবং হলুদ গোলাপ ভালো বন্ধুত্বের প্রতীক।
CROCUS:
ক্রোকাস ছিলেন গ্রীক দেবতা হার্মিসের বন্ধু। একদিন দুই বন্ধু মিলে খেলার সময় ভুলক্রমে হারমিস আঘাত করেন বন্ধুকে এবং ক্রোকাস মারা যান। দুর্ঘটনাস্থলে একটি ছোট্ট ফুল জন্মায়। ক্রোকাসের রক্তের তিন ফোঁটা ফুলের কেন্দ্রে পড়ে। ফুলটির গায়ে যে দাগগুলো দেখা যায়, পুরাণমতে তা ঐ রক্তেরই দাগ। এই ঘটনার পর ঐ ফুলের নাম দেয়া হয় ক্রোকাস।
অন্য আরেকটি কাহিনী অনুসারে, ক্রোকাস এক যুবকের নাম, যে স্মাইল্যাক্স নামের কোন এক পরীকে ভালবেসেছিল। অপরিপূর্ণ প্রেমের কারনে সে ফুলে পরিণত হয়। একই সময়ে সেই পরীও একটি ধাতব গাছে রূপান্তরিত হয়।
ইংরেজরা এই ফুলকে বলে ‘স্যাফ্রন’। সংস্কৃতে এর নাম- কুনকুমাম অথবা শুশ্রুতা শামহিতা। প্রায় ৯০ প্রজাতির ক্রোকাস আছে। ক্রোকাস একটি ছোট্ট সুন্দর ঘাসফুল।
গ্রীক পুরাণে এরকম আরও অনেক ফুলের কাহিনী আছে। যেমন- Almond, Fir, Agave ইত্যাদি। কেউ চাইলে ইন্টারনেট ঘেঁটে সহজেই জেনে নিতে পারে এগুলোর আদ্যোপান্ত। সময়ের বড় অভাব, তাই আমি আপাততঃ দিলাম ক্ষান্ত।
তথ্য এবং ছবি দিয়ে সাহায্য করেছেন- গুগল ভাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ২:৫৩