মা,
তুমি কেমন আছো? বাড়ির সবাই ভাল আছে ত? রুমি, কেমন আছে? ওকে অনেক দিন ধরে দেখি না। অনেক দেখতে ইচ্ছে করে ওকে।
মানুষের সব আশা, সব ইচ্ছা কি পূরণ হয়? হয় না। আমরা আশা করি এক, আর হয় আরেক। যা মানুষ স্বপ্নেও ভাবে নি, তাকে তা বাস্তবে দেখতে হয়।
মা, তোমার মনে আছে, একবার চুরি করে আমের আঁচার খেয়ে ফেলেছিলাম। তুমি, অনেক মেরেছিলে। তুমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলে না যে তোমার ছেলে চুরি করেছে। নিজের ঘরে কি চুরি হয় মা? রুনু চাচি না বাচালে আরও অনেক মার কপালে ছিল। ওনি রাতে আমাকে ঘরে দিয়ে গেলেন।
আমি তো ভয়ে অস্থির। বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছি। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় কারও কান্নার আওয়াজে। আমি ত ভাবলাম ভূত! কিন্তু একি। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছ। যাকে বলে হাওমাও করে কান্না। বুঝতে পারলাম আমার শরীরের থেকে অনেক বেশি কষ্ট তোমার মন পেয়েছে। তুমি কিন্তু মা ভেবেছিলে যে আমি ঘুম। আসলে কিন্তু আমি মা সজাগ ছিলাম। তোমার কান্নায় আমারও কান্না পেয়ে গেল। কত কষ্ট করে যে কান্না চেপেছিলাম তা মা তোমাকে বোঝানো যাবে না।
আচ্ছা মা, তোমার কি বাবার কথা মনে পরে? এই দেখ তো। কি বলতে কি বলে ফেললাম। তুমি তো মা বাবার সৃতি নিয়েই বেচে আছো। প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্তে তার সৃতিই তো তোমার সম্বল। বাবা যখন মারা যায়, তখন আমার বয়স ৬ আর আর রুমির ২ বছর। একদিন শুনলাম, বাড়িতে আসার সময় বাবার লঞ্চ ডুবে গেছে। বাবা মারা গেছে। তখনও আমি মারা যাওয়া কি জিনিস বুঝি না। একজন বলল, যে বাবা নাকি এখন থেকে মাটির ছোট্ট একটি ঘরে থাকবে। আমি তো অবাক। এত বড় ঘর থাকতে বাবা কেন ওই ছোট্ট ঘরে থাকবে?
কিছুক্ষণ পর বাবাকে নিয়ে আসা হল। বাবা অদ্ভুত একটি কাপড় পরেছেন। না শার্ট, না প্যান্ট, না লুঙ্গি। সাদা কাপড় দিয়ে বাবাকে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। আমি কত ডাকলাম, বাবার কোন সাড়া শব্দ নেই। চারিদিকে কান্নার রোল।
বাবার নতুন ঘর দেখে আমি ত হতবাক। এই ঘরে বাবা কি করে থাকবে? এখানে-ত ঠিক মত ঘুমানোর ব্যবস্থাও নেই। আর কোন ফ্যানও নেই। বাবা তো গরম একদম সহ্য করতে পারে না। একথা যাকেই বলি সেই কাঁদে। ছোট চাচা ত আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। বাবাকে সবাই মিলে তার সেই ছোট্ট ঘরে রেখে এলো। জানো মা, আমি প্রায়েই রাতে গিয়ে বাবার কবরের পাশে বাবার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু বাবা কখন আমার কথার জবাব দিতেন না।
সেই থেকে তুমিই আমাদের মা, তুমিই আমাদের বাবা। তুমি আমাদের জন্য কি না করেছ। অথচ বিনিময়ে কিছুই পাওনি। কতই বা বয়স ছিল তোমার। আমাদের জন্য নিজের কথাও একবার ভাবলে না।
তোমার দুনিয়া বলতে ত আমি আর রুমি। আমি যখন রাত জেগে পড়াশোনা করতাম তখন তুমিও সজাগ থাকতে। তোমাকে আমি শুয়ে পরতে বলতাম। কিন্তু কে শুনে কার কথা।
মা, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঞ্চ পেলাম তখন তোমার কি কান্না! বাবার মৃত্যুর পর সেটাই ছিল তোমার প্রথম সুখের কান্না।
আসলে মা, দুনিয়া বড় অদ্ভুত এক স্থান। তার থেকেও অদ্ভুত আমাদের জীবন। যে আমি কোনদিন রাজনীতি করিনি তাহলে আমি কেন এ নোংরা রাজনীতির শিকার?
প্রতিটি দিন এর মত সেদিনও শুরু হয়েছিল শান্তির বার্তা নিয়ে। কিন্তু ক্ষমতালোভী মানুষ শান্তির পাখি কে হত্যা করতে বিন্দুমাত্রও হাত কাপে না।
সেদিন সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বড় একটি টেন্ডার নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা। কিন্তু আমি তো এসবের কিছুই জানতাম না। তাই যখন দুই গ্রুপ এর মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল তখন তার মধ্যে পরলাম আমরা কয়েকজন। হঠাৎ কোথা থেকে একটি বুলেট কোন আগাম বার্তা না দিয়ে আমার বুকে ঢুঁকে গেল। আমি দেখলাম যে আমার বুকের বাম পাশে একটি গর্ত। যা থেকে ঝরঝর করে রক্ত পরছে। একেবারে তাজা রক্ত। আমার দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছিল। একসময় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল।
আমি চোখ খুললাম। বুঝতে পারলাম আমাকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে। হাসান, মিলন, জব্বার আরও অনেকেই এসেছে। হাসান আমার হাত ধরে বলল যে আমি নাকি ভাল হয়ে যাব। কিন্তু একজন মৃত্যু পথযাত্রী ঠিকই বুঝতে পারে যে তার হাতে আর সময় নেই। কিন্তু বার বার তোমার মুখটা কেন আমার চোখে ভেসে উঠছে। তোমাকে খুব বেশি দেখতে ইচ্ছে করছে। তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমুতে ইচ্ছে করছে, মা।
হা, আমি চলে যাচ্ছি এ দুনিয়া ছেড়ে, তোমাকে ছেড়ে, রুমিকে ছেড়ে। আমি জানি আমার হাতে আর সময় নেই। তাই হাসানকে দিয়ে এ চিঠি লেখাচ্ছি। ডাক্তাররা বারণ করেছিল। আমি শুনিনি। তুমি যখন এ চিঠি পাবে তখন আমি তোমাকে, রুমিকে ছেড়ে চলে গেছি, অনেক দূরে। কোনদিন আসতে পারব না তোমার কাছে, তোমার কোলে মাথা রাখতে পারব না, তোমার হাতের খাবার মুখে দেয়া হবে না আর কোনদিন।
মা, তুমি ভেঙ্গে পড়ো না। রুমিকে অনেক বড় করো। আকাশের মত বড়। আমি এখন বাবার কাছে যাব মা। বাবা নিশ্চই আমার কথার জবাব দিবে এবার। চুপ করে থাকতে পারবে না আর। কিছুতেই না।
হাসান চশমা খুলে চোখের জল মুছলো। প্রভাত এর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল যে প্রভাত নিকষ কাল অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে, গভীর অন্ধকার, আলো বিতাড়িত হয়েছে চিরতরে।