লাখো নেতাকর্মী, সমর্থক থাকা সত্ত্বেও আদতে একা ও অসহায় হয়ে পড়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। নানা ঝড়-ঝাপ্টা সইতে হচ্ছে তাকে। চলমান সংকুল পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
‘কেতাবে আছে গোয়ালে নাই’ অবস্থায় চলছে তার দলও। নেতাদের মধ্যে ‘নির্ভরযোগ্য’ অনেকেই মানছেন না আদেশ-নির্দেশ।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলনেতার নির্দেশে নেতাদের অনেকেই সম্পৃক্ত হচ্ছেন না দলের সক্রিয় আন্দোলনে। গা-বাঁচিয়ে চলছেন নিজেদের। আর এভাবেই খালেদা জিয়া কষ্টে পড়েছেন।
দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘বিএনপিতে সর খাওয়া লোকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কষ্ট না করে সুবিধাভোগে আগ্রহী অনেকেই।’’
তিনি বলেন, ‘‘পরিশ্রমের কোনো কর্মসূচি পালনে তাদের ইচ্ছা দেখি না। নানা অযুহাতে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এড়িয়ে চলা পছন্দ তাদের।’’
খালেদার চারপাশে চাটুকার-পরিবেষ্টনের কথা বললেন ঢাকা জেলা বিএনপির এক নেতা। তিনি বলেন, ‘‘ম্যাডামকে (খালেদা) অনেক বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয় না। তাকে খুশি রেখে যার যার মতো ভুল ধারণা দিয়ে বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এসব চাটুকার।’’
তিনি বলেন, ‘‘দলের বিরুদ্ধে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন, দলের দুর্বলতার জায়গাগুলো খালেদাকে জানানো হয় না। ‘সব ঠিক হ্যায়’ বলে বোঝান তারা নেত্রীকে।’’
নির্দেশ না মানায় দলীয় শৃঙ্খলাও ক্রমশই নষ্ট হচ্ছে, মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন খালেদাও। তার সমালোচনা হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়েও।
মহিলাদলের এক তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে দল করছি। নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ, সাহস কোনোটিই আজ পর্যন্ত পাই না। নির্দিষ্ট কিছু মানুষই শুধু তার সামনে যাওয়ার সুযোগ পায়।’’
তিনি বলেন, ‘‘ম্যাডামকে পুতুল বানিয়ে রেখেছে তারা। দলের জন্য ভালো কিছু পরামর্শ আমরাও যে দিতে পারি, তারা তা ভাবে না।’’
খালেদার নির্দেশ অগ্রাহ্য প্রসঙ্গে বিএনপি’র অন্য এক নেতা বলেন, ‘‘সম্প্রতি কিছু আন্দোলন কর্মসূচিতে ম্যাডাম মাঠে নামতে বললেও নামেন নি কেউই। বিশেষ করে, খোকার (দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা) কোনো নড়াচড়া টের পাওয়া যায় না।’’
তিনি বলেন, ‘‘ঢাকা মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক হওয়া সত্ত্বেও খোকা তার সংগঠনের কাউকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন নি কর্মসূচিতে সক্রিয় হতে। ৫ মে খোকা কোথায় ছিলেন খালেদাও তা জানতেন না। নির্দেশ মানেন নি খোকা। এ বিষয়টিকে অনেকেই ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে দেখছেন।’’
খোকার প্রতি অভিযোগ করে স্বেচ্ছাসেবক দলের আরেক নেতার বলেন, ‘‘খোকা সরকারের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন বলে শুনেছি। সরকার উৎখাতে জোটের আন্দোলনগুলোকেও নাকি তিনি ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন।’’
তিনি বলেন, ‘‘৫ মে রাতের ব্যর্থতার দায় খোকা ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালামের উপর দিচ্ছেন অনেক নেতাকর্মী।’’
সূত্র জানায়, ১৫ মে নয়াপল্টনে কর্মসূচি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে দলের নেতাদের উপস্থিত থাকতে বলেছেন খালেদা। শেষ পর্যন্ত যুগ্ম-মহাসচিব বরকতুল্লাহ বুলু গিয়েছিলেন।
অবশ্য সম্মেলন শেষে কার্যালয় ফটকে আটকও হন তিনি।
এটি দলে বড় সমস্য্যা। অহরহ মামলা সামলাতে ব্যস্ত রয়েছেন নেতাকর্মীরা। খালেদা জিয়ার নির্দেশ মেনে রাস্তায় নামার সাহস করছেন না তাই।
এদিকে চৌধুরী আলম, এম ইলিয়াস আলীসহ বেশকিছু নেতার নিখোঁজ হওয়া ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার নেতাদের নানাসময়ে হত্যার ঘটনায় মনোবল ভেঙেছে দলের নেতাকর্মীদের।
শুধু তাই নয়, খালেদার অসহায়ত্বের রয়েছে আরও কারণ। দলের মধ্যে ঐক্য না থাকা, দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকা বিএনপির পুরনো সমস্যা।
এমনই আরেক সমস্যা, দলে পরীক্ষিত বিশ্বস্ত নেতার অভাব। বিএনপির সারাদেশে কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলার কারণে সৃষ্ট আর্থিক দৈন্যদশাও নেতাকর্মীদের ঝিমিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
বিএনপির আরেক সমস্যা হলো এই দলের সংস্কারপন্থিরা। নিষ্ক্রিয় ও চুপচাপ রয়েছে দলের সংষ্কারপন্থি শত শত নেতা। অতীতের সিদ্ধান্তের খেসারত দিচ্ছেন তারা। আর যার প্রভাব পড়ছে দলেও। বিভাজনে দুর্বল হচ্ছে দল।
সংস্কারপন্থি বিএনপি নেতা জহিরউদ্দিন শোভন বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘এখন সক্রিয় নেই, এটি সত্যি। তবে একসময় সক্রিয় ছিলাম। এখন আমি কোনো দায়িত্বে নেই, দায়িত্ব দিলে সক্রিয় হব।’’
বিএনপির কর্মকাণ্ডে যোগ না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সময়মতো সকল কর্মকাণ্ডে যোগ দেব। একটু দূরে আছি, এই দূরত্ব কমে আসবে।’’
এছাড়া কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে অভিমানী নেতার সংখ্যাও কম নয়। তারাও জড়িয়ে পড়েছেন পারিবারিক ও নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্যে। খালেদার পাশে দাঁড়ানোর মুহুর্তে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।
বিএনপিতে আস্থাহীনতার বিষয়টিও খালেদাকে অসহায় করেছে। বিএনপি’র গুরুত্বপূর্ণ ডজনখানেক নেতার সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ রয়েছে বলে দলের নেতাকর্মীদের অনেকেই বলাবলি করছেন। এজন্য দল বা জোটের আন্দোলনে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলেও তাদের ধারণা।
সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অনেককেই খালেদা জিয়া আস্থাভাজন মনে করছেন না। সম্প্রতি পত্রিকাগুলোতে নানাভাবে নেতাদের মন্তব্য প্রকাশ হচ্ছে। তাদের কথায় নেত্রীর প্রতি অভিমান ও ক্ষোভ ঝরছে।
অনেকে নিজে থেকে খালেদাকে পরামর্শ দিতে চান না, আবার অনেকেই মনগড়া পরামর্শ দিয়ে খালেদাকে বিভ্রান্ত করছেন। যাতে বিরক্ত হচ্ছেন দলের প্রতি আন্তরিক অন্য নেতারা।
ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দল, দুর্বল হচ্ছে খালেদার নেতৃত্ব।
সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয়েছে ফলাও করে। আর তা হলো- ৪ মে খালেদার দেওয়া আল্টিমেটাম নিয়ে নেতাদের মধ্যে বিভক্তি। শাহবাগীদের নাস্তিক ও জামায়াত হেফাজতকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া ভুল ছিল বলে মনে করেন বিএনপিপন্থি বোদ্ধাদের অনেকেই।
খালেদার অসহায়ত্বের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- সক্রিয় কিছু নেতার অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিতি। দলের নেতাদের অনেকেই জেলখেটে বা আন্দোলন সংশ্লিষ্টতায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন।
সিনিয়র নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, তরিকুল ইসলাম, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অসুস্থ রয়েছেন।
এছাড়া বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনেকেই জেল থেকে ফিরে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
এসব নেতার কাছ থেকে দলের কার্যক্রমে সহসাই অংশগ্রহণের আশা করা যাচ্ছে না।
এছাড়া আটকাতঙ্কে আছেন নেতারা। জানা গেছে, নেতাদের অনেকেই আটকের আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছেন স্বজনদের বাসায়। সারাক্ষন তটস্থ হয়ে খোঁজ রাখছেন বাড়িতে অভিযান শুরু হয় কি না।
শুধু জাতীয় পর্যায়ের নেতারাই নন, জেলা পর্যায়ের অনেক নেতাই নিজ শহর ছেড়ে অন্যত্র্র অবস্থান করছেন্ আটকাতঙ্কে।
এদিকে দলের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অসততার অভিযোগ তো কখনোই কমেনি। টাকার বিনিময়ে পদ দেওয়ার অভিযোগ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। চাঁদপুরের এক নেতাকে ৪৮ লাখ টাকায় পদ দেওয়া হয়েছে বলে রটনার পর দলে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
মামলায় জর্জরিত, জেলে আটক ও নিহত নেতাকর্মীদের পরিবারের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে না দলের পক্ষ থেকে। এতে নেতাকর্মীরা অনেকেই আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছেন। দলের প্রতি নিবেদিত হওয়ার আগ্রহ তাই কমে যাচ্ছে তাদের।
যুবদলের এক নেতা বলেন, ‘‘আমিসহ অনেকেই নিজের মামলা সামলাতে ব্যস্ত। টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে সব কিছু নিজে ম্যানেজ করতে হয়। দল থেকে কোনো সাহায্যই কেউ করে না। দল এসব খবর রাখেই না।’’
এদিকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, ভারত, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোসহ নানাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চেষ্টা করেছে বিএনপি। কিন্তু এর মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এলে তার সঙ্গে দেখা করেন নি খালেদা।
আর এই বিষয়টিতে কিছু নেতা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কারণ তারা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা দলের রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হতো বলে মনে করেন।
অনেকেই বলেছেন, সিঙ্গাপুরে বিশেষ শক্তির কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছেন খালেদা। তার প্রেক্ষিতেই তিনি প্রণবকে প্রত্যাখ্যানের সাহস দেখিয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, ভারতের মুখাপেক্ষি নয় বিএনপি।
এই বিষয়টিকে দলের অনেকেই ভুল হিসেবে দেখেছেন। তবে মূল সমস্যা অন্য জায়গায়। দলের নেতাদের এই বিষয়টি খালেদা ব্যাখ্যা করেন নি বলে অভিযোগ অনেকের। ফলে ধোয়াশায় পড়ে গেলেন তাদের কয়েকজন। তাই এ সংক্রান্ত কোনো পরামর্শও তারা খালেদাকে দেওয়ার সাহস পাননি বা আগ্রহ দেখান নি।
সরকার দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কয়েকজনের কাছ থেকেও এ বিষয়ে বক্তব্য এসেছে। তারাও খালেদার সিঙ্গাপুর সফর নিয়ে রহস্য ভাঙতে চেয়েছেন। যা বিএনপির সেই নেতাদের মনোবেদনা আরও বাড়িয়েছে।
দলের এই দুর্যোগ মুহুর্তে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সস্ত্রীক দেশের বাইরে আছেন। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কারা জেলে, কারা বাইরে, কারা দেশের বাইরে, আর কারা হাসপাতালে আছেন তার সঠিক হিসেব জানে না দলের কেউই।
এর মধ্যে জেলফেরত নেতাকর্মীদের একজন বলেন, ‘‘জেল খেটে এলাম, নেত্রী একবার ডেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলেননি। তাহলেও শান্ত্বনা থাকতো। কিন্তু এসব সিস্টেম আমাদের দলে নাই। বড় নেতারা জেলে গেলে ম্যাডাম জানেন, আমাদের বিষয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নাই। তাই জেলে-জুলে গিয়ে কী লাভ? শুধু পরিবারের কষ্ট।’’
এভাবে অভিযোগ ও অভিমানের মুখে পড়ছেন খালেদা।
মাঝে মাঝেই তার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পান এমন এক নেতা বলেন, ‘‘তার দুই ছেলে সঙ্গে নেই, দলেও এই দশা, বিশ্বস্ত মানুষের অভাব- সব মিলিয়ে খালেদা জিয়া একা ও অসহায় দিন যাপন করছেন।’’
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘এটা ঠিক সরকার প্রতিনিয়ত যে অন্যায় বিএনপির প্রতি করছে তাতে কষ্ট পাচ্ছেন খালেদা জিয়া। নেতাকর্মীদের জেলে ভরছে, নির্যাতন করছে, কর্মসূচি করতে দিচ্ছে না-এতে কষ্ট পাওয়াই স্বাভাবিক। তবে এতে তার মনোবল ভাঙছে তা মনে করার কোনো কারণ নেই।’’
তিনি বলেন, ‘‘এখনো খালেদা জিয়া দৃঢ়চেতা। তিনি বলেছেন, উপযোগী আন্দোলন আসবে সামনে। পরিস্থিতি বদলে যাবে। তবে মানুষের ভোগান্তি যেন না বাড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে দলনেত্রীকে।’’
এদিকে নজরুল ইসলাম খান বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া দমবার পাত্রী নন। বিএনপির ওপর বরাবরই এসব বাধা-বিপত্তি এসেছে। কিন্তু এসব কেটে যাবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া সব পরিস্থিতি দেখছেন, সময়োপযোগী সিদ্ধান্তও নেবেন। হতাশ তিনি কখনোই হন না। জনগণের প্রতি তার আস্থাও অটুট।’’
সূত্র- View this link