আজকাল পত্রিকা খুলতে খুব ভয় হয়। পড়তে গেলে আরও ভয় করে। বুকের বা পাশে হাত দেই। মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখি বেচে আছি কি না। কিংবা হিসেব করার চেষ্টা করি কতক্ষণ বেঁচে থাকব। ভয় হয়, খুব ভয় হয়। আবার প্রবল ভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে।
পত্রিকায় যেসব মুখগুলো দেখি, যাদেরকে খুন করা হয়েছে গুলি করে, কুপিয়ে, বালিশ চাপা দিয়ে, পিটিয়ে কিংবা সিলিং এ ঝুলিয়ে তাদের মুখের উপর নিজের মুখটা বসাই। দেখি গুলি খেয়ে মরে গেলে আমার মুখটা কেমন দেখা যাবে। কেউ যদি আমাকে কুপিয়ে বীভৎস ভাবে খুন করে তবে আমার মুখের আদলটা কেমন হবে। অথবা বালিশ চাপা অবস্থায় কিংবা সিলিং এ ঝুলান অবস্থায় আমার মুখ। আমার প্রিয় জিবন্ত মুখটা কেমন হবে সেটা ভাবতে গেলে খুব ভয় হয়। কষ্ট হয়।
ইদানিং কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। সবার মুখের দিকে তাকাই। খুব নিখুঁত ভাবে পরীক্ষা করি। বুঝতে চেষ্টা করি কেউ আমার উপর রেগে আছে কি না। আমার কোন কথায় কারো কপালে ভাঁজ দেখা গেলে আমার ভয় করে। প্রবল ইচ্ছে জাগে তাঁর পা চেপে ধরে বলি ভুল করে ফেলেছি মাপ করে দেন। কিংবা মেরে না ফেলে শাস্তি দিন। যেকোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নিব। কিন্তু আমাকে মারবেন না। আমাকে বাঁচতে দিন। আমার বাঁচতে খুব ভাল লাগে।
আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে আমার অফিস হাঁটাপথ। তবু মাঝে মাঝে যখন খারাপ লাগে ক্লান্ত লাগে রিকশা নেই। কিংবা প্রচণ্ড রোদ্দুর তখন। রিকশা ওলাদের জিজ্ঞেস করি মামা যাবেন। কেউ রাজি হয়। কেউ না করে। বেশি ভাড়া চায়। কেউ শীতল দৃষ্টিতে তাকায়। কেউ কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়। কারো কারো দৃষ্টিতে ক্ষোভ ঘৃণা। মনে হয় তাদের রিকশাওলা হওয়ার পেছনে আমার কোন হাত আছে। আমি অনুভব না করলেও বুঝতে পারি রোদে তাদের রিশা চালাতে খুব কষ্ট হয়। খারাপ লাগে। আমি এও বুঝতে পারি খুনে দৃষ্টি। আমি ভয় পাই দৃষ্টি নত করি । চুপচাপ চলি।
আমার একমাত্র ছোট বোন কলেজে পড়ে। খুব আদরের ছোট বোন। মাঝে মাঝে ফোন করি খোঁজ নেই। ওর কণ্ঠ স্বাভাবিক থাকলে ভাল লাগে স্বস্তি পাই। কিন্তু কণ্ঠ একটু অন্যরকম হলেই আমার ভয় হয়। খুব ভয় হয়। বারেবারে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে, অসুখ না অন্য কিছু, না….. । মাঝে মাঝে ছোটবোনকে বলি, খবরদার কোথাও যাবি না, কারো সাথে মিশবি না কিংবা কাউকে বিশ্বাস করবি না। কাউকে বিশ্বাস করবি না এই কথাটা বলতে আমার খুব খারাপ লাগে। ইচ্ছে করে না বলতে। তবু বলি প্রায়শই বলি। যে মেয়েটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি কিংবা আমাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখে তাকেও বলি। কোথাও যেও না। ঘরে থাক। সিটিয়ে থাক। কেউ কিছু বললে প্রতিবাদ করবে না। চুপচাপ চলবে, চুপচাপ থাকবে। আমার বোন কিংবা তাঁর সহপাঠী, প্রেয়সি কিংবা তাঁর সহপাঠী সবাইকে বলি সমঝে চল, সমঝে চল। কাউকে বিশ্বাস কর না। বেঁচে থাক।
আমার পরিচিত গণ্ডিটা খুব বড় না হলেও খুব ছোট নয়। কেউ ভাই কেউ বন্ধু, ছোট ভাই, ছোট বোন, সহকর্মী তারা সবাই খুব প্রিয় না হলেও তাদের হাসিখুসি জীবন্ত মুখটা দেখতে আমার ভাল লাগে। আরাম বোধ হয়। মনে হয় বেঁচে আছি। আমি চাই না পত্রিকার বীভৎস খুন হয়ে যাওয়া সেই মুখগুলোর কোন একটা তাদের হোক। সবাই বেঁচে থাকুক, বেঁচে থাকুক, বেঁচে থাকুক। না হয় কম্প্রোমাইজ করুন, চুপচাপ থাকুন, বেঁচে থাকুন। অনেক সময় বেঁচে থাকাটাই অনেক বড় সফলতা।
আজকাল কে যে কারে মারছে, কোপাচ্ছে, গুলি করছে কিছুই বুঝতে পারি না। কেন যে এসব করছে তাও বুঝি না। তাই ভয় হয় কখন কার শর্ত ভঙ্গ করলাম, কার মনমত চলা হল না ব্যাস আমাকে কুপিয়ে দিল, মেরে দিল। তাই আমি বলি কি আপনারা যে শর্তই দিন না কেন কোন সমস্যা নেই, আমি প্রত্যেকের শর্ত মেনেই বেঁচে থাকতে চাই। আমার প্রিয় মানুষগুলোর বেঁচে থাকা দেখতে চাই। কারন বেঁচে থাকতে আমার ভাল লাগে। বেঁচে থাকা দেখতে আমার ভাল লাগে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ সকাল ১০:১২