গাছ তার ছায়াতলে জ্যোৎস্না-সর চাপা দিয়ে রাখে
চাপা পড়ে তারকার অরব জীবন।
পুনর্জায়মান তারা-
রাত্রির আকাশ বয় তার স্মৃতির স্পন্দন।
এখন সন্ধ্যাবেলায় নীরবে সন্ত্রস্ত ওই দেবদারু
গোপনে বন্ধুর সাথে কথোপকথনে রত...
অনেক অনেকটুকু ব্যথা তাই দুয়ারে প্রস্তুত।
দুয়ারে প্রস্তুত আছে জুড়িগাড়ি, তাতে চেপে
মহাজরায়ুর পানে যেসব কলের গান আনমনে গেছে,
সিন্ধুর বেদনা গেছে- তাদেরও ভুলেছি।
পেয়েছি মূর্খের দেশ, নারীর অনন্ত কলরোল
আর স্বপ্নে এসে থেমেছে দানব সেই-
যার ধ্যান সমুদ্র শুষেছে।
সেখানে অঘোর মুক্তা, আকাশের নক্ষত্রবাগান
অস্থির তাবুর দিকে পরীদের ফেলে যাওয়া গান
আমি দেখেছি বা শুনেছিও!
শুনেছি যে, এই শূন্য চরাচরে
উল্কার প্রেতেরা নাকি বসবাস করে-
নীরব প্রস্তর হয়ে তাদের দেহটি পড়ে আছে
প্রকৃতির কূটাভাসে। যামিনী লণ্ঠন নিয়ে
তাদের সামনে এসে কখন দাঁড়ায়, কখন সামান্য বসে
নক্ষত্রের আরেকটু ভবিষ্যৎ শুনে যায়- জানতে পারিনি।
এখন আমার কাছে এই রাত্রি কেবলই বনপোড়া
প্রাণীদের মাংসকাবাবের কটুগন্ধ বয়ে আনে...
বাদুড়প্রাণের আলোড়ন, পতঙ্গের নৈশগুঞ্জন
যত স্থির কানে আসে, ততটাই খুলে যায়
তারা স্বপ্নের আয়নায়, আফিমে আফিমে ওড়ে
নগরদ্বারের মুখে ব্রোঞ্জ ও মুক্তার পাখি।
মস্তিস্কে অঙ্গার রেখে, উড়ে উড়ে, নিজেরই সঙ্গীর সাথে
নিরক্ত চুম্বন সেরে আসে।
এভাবেই চুম্বনসূত্রের কাছে ভালোবাসা ধীরে ধীরে অপসৃয়মান।
নগরের দ্বারে, ভোরে, ফিরে আসে যতবার সেই দুই পাখি
দেখি, আধারে উড়েছে বলে তাদের গায়ের রং আরেকটু বদলেছে যেন!
অজান্তেই বদলায় তাদের শোচনাসুর তাতে
দূরগ্রামে নির্ঘুম সঙ্গীনির হৃদয়বাষ্প আজ তাই
মূর্তিপাখিদের উড্ডীনতা চাপা দিয়ে রাখে!
প্রতিটি শোচনাকথা এভাবেই দিন ও রাত্রির পারাপারে
বয়ে নেয় আমাদের আর করে তোলে হাস্যকর প্রতিটি সম্পর্ক,
বহু যতেœ গড়া মরূদ্যান।
সমস্ত কৃত্রিম ঘড়ি ছেড়ে কোনও বালিঘড়ির নিকটে
সামান্য সময় চেয়ে দেখেছি যে, সে মূলত সূর্যাস্তের গুনছে প্রহর ।
সূর্যাস্ত-মন্দির আর তটরেখা ঘিরে শামুকের প্রাণে
যতটা রচিত হলো নিরবতা,
বালি ও সময় মাঝে উদ্ভিন্ন সংকট কোণ
এসবই কি তার উপঢৌকন?
প্রতিটি শোচনাকথা এভাবে কি দ্বিখণ্ডিত করে যাবে আমাদের
গ্রহপ্রসারের পানে উন্মুখ তাকিয়ে রবে একভাগ
অন্যভাগ রয়ে যাবে পরাজিত শরীরপোশাকে
তা না হলে কে-ই বা ঘুরবে একা একা গোলাকার
স্পষ্ট হওয়া ব্যর্থতাকে ঘিরে!
মাটির ঘরের মত অভিমানী জীবন চেয়েছি
ভেবেছি, দূরবীনে দেখে নেব পতঙ্গের অহোরাত্রি,
বিষাদপ্রস্তর গ্রামে সর্ন্তপণে জ্বলে ওঠে কুঁপি,
কী-বা ভেবে বালকেরা সন্ধ্যাকালে আতাফল চুরিতে বেরয়।
হাওয়ার লাবণ্যমর্ম দমবন্ধ অভিসারে হৃদয়কথাকে আজ
আকাশে অস্পষ্ট কোনো চন্দ্রফসলের দিকে বয়ে নিয়ে যায় ...
সন্ধ্যার আকাশে যদি উড়ে আসে
ফুটফুটে তারার মতো জোনাকীর ঝাঁক-
বলো- নিকটের তারা, কোনদিকে যাবো আমি?
আমার বাহান্ন ডানা আজ কোন গুণ্ঠনে লুকাবো?
উজ্জ্বল পোশাক দিয়ে আমি কি সে পরিখা ভর্তি করে নেব!
নাকি সবকিছু ত্যাগের মুহূর্তে শুধু ঝোলায় উঠাব
অতিচেনা সেই বাস্তুসাপ?
আমি কি নিষেধ শুনবো, তরঙ্গের রাগ ?
শুনবো কি মাল্লারের কথা- ‘যেও না, যেও না।
কেননা সেসব দেশে মানুষেরা আপন হৃদয়-খন্ড হাতে নিয়ে হাঁটে’
প্রতিটি হৃদয়কথা গান্ধর্বের দেশে গিয়ে মুহ্যমান আজ।
প্রতিটি হৃদয়কথা শোচনাচুল্লীতে পৌঁছাতে চেয়ে
হয় যত নিমখুন, গড়ে যতো ভুলের প্রাসাদ
কাছ থেকে যাকে মিহিকাপড়ের মতো মনে হয়
তার ’পরে অলঙ্ঘ্য তন্দ্রায় আমি গড়িয়ে বুঝেছি,
বহু উঁচু থেকে যাকে অগ্নিপিণ্ড বলে মনে হয়, তা মূলত
পরিত্যক্ত হৃদপিণ্ড এক, নিজেরই বিক্ষিপ্তির ভার
জবার উদ্যানে তাকে আগুনের শিখা করে তোলে।
এভাবেই অপরিমেয় জবারক্তের কাছে হতভম্ব হতে হতে
আমার কেবল এক শীতভারাতুর সৈকতের কথা মনে পড়ে।
যেখানে একাই আমি নুড়ি পাথরের কাছে
ভিক্ষা করিÑ আমার ভেতরে যেন প্রবাল-সত্তা কিছু জাগরুক হয়
যাতে বিস্মৃতির অংশ হয়ে সমুদ্রে কিছুটা মেশে সবুজ সমুদ্র।
মহাশিকড়ের পানে ধমনীর কাজ শুধু তরঙ্গের রাশিমালা
সমুদ্রে মেশানোÑ যেখানে হৃদয় স্ফুট।
যেখানে প্রস্তুত চন্দ্রগিরির উপত্যকায়
যত কাফ্রি এসে তাবু ফেলে, আমার প্রার্থনা:
তাদের ঘোড়াটি যেন মেঘে মেঘে বিলুপ্ত তরঙ্গশিখর দেখে রাখে।
তাদের ঘোড়াটি যেন মুখ উঁচু করে আজ সারারাত
একটি হ্রেষাও না ছাড়ে; কেননা এ দৃশ্য শুধু নরকের।
সবুজ সমুদ্র আজ তাই এত উন্মাতাল।
শিকারের লোভে আজ যারা আবহাওয়া-বার্তা উপেক্ষা করেছে
তারাই তো গণিকার স্তব্ধ শিক্ষক।
কুঠি থেকে বের হয়ে পবিত্র øানের পরে তারাই তো
গণিকার স্বাস্থ্য নিয়ে সমুদ্রের সাথে কিছু করেছে আলাপ!
এইতো কারণ যাতে
গণিকার রক্তে সুপ্ত থাকে সমুদ্রের নাদ।
সেইবার মাতৃসম কোনো গনিকার রক্তের ভেতর
দেখা হয় খুঁজে ফেরা আবহমান পানপাত্রের সাথে,
গণিকাকে মৃত ভেবে সে নিশ্চিন্তে বলে-
যে কোন ভরাট পাত্র দুঃখ দেয় শেষকালে গিয়ে!
তার চেয়ে নাকি ভাল ঘুমন্ত পাথরখণ্ডে এতটুকু বসা-
খানিক নির্জন থাকা, অজান্তে গানের সুর ভজা
হঠাৎ ঝড়ের মাঝে পাথরখণ্ডকে ছুঁয়ে
আরেকটু নির্লিপ্তি শেখা।
কেননা, লালিমার দিকে যেতে যেতে সব পাখি
নিজ থেকে আগুনের ভাষা বুঝে ফেলে-
জ্যোছনায় উড়ন্ত যত খণ্ড খণ্ড পানপাত্র
রাত্রির আকাশে ক্রমে হয় দৃশ্যমান
আমাদের হৃদয়কথারা ততটাই ধীরে ধীরে, সেই পথে
চাঁদের পাহাড়ে গিয়ে গড়ে তোলে আরেকটু অদেখা ফাটল।
নক্ষত্রবাগান ক্রমে এভাবেই শোচনাকথায় ভরে ওঠে।
দূর থেকে অনন্ত বিষাদ নিয়ে তারাদের গ্রাম
প্রতিরাতে মোহশরীরের সাথে বলে কথা
যতভাবে অসফল আমরা নিজেরাই
গণিকার কম্পনগাথায় ভরে নিজেদের ডেকে তুলি
নিস্কৃতিপাহাড় থেকে,
হৃদয়কথারা যেন ততটাই নিজেদের ফাঁকি দিয়ে যায়।
কেবলই অন্ধের হামাগুড়ি
পাহাড়ে বনের মর্মে, তরঙ্গ-তাঁবুতে স্তব্ধ হতে হতে
অনেক অনেকটুকু ব্যথা আজ ভুলতে পেরেছে।
বিলয়ের চরাচরে উড়ে যেতে চাওয়া কোনো পাখি
তীব্র লাল আগুনের বল যার জন্যে অপেক্ষায় থাকে
তার পায়ে লেগে থাকা উত্তাল সমুদ্র-নাদ
রুপার করুণ কুচি, বিগতজন্মের ডায়েরি
বাস্তুসাপের প্রহরা, আগুনশিখার লোভে উড়ে আসা
পতঙ্গের ছাইরাশি,
প্রতিরাতে লেবুবাগানের তলে করুণার সহযোগে
আমাকেই চাপা দিয়ে রাখে।
ডোমের সঙ্গীতে সেইদিন বারবার কেঁপে ওঠে তারাদের গ্রাম।
সেই গানে, কোনো অন্তঃসত্ত্বা কুমারীর
সন্তর্পণ পদক্ষেপ হয়ে যদি ফিরে আসি,
সমুদ্র, তাহলে তুমি আমাকেও নিও!
দূরাকাশে তারার বিষাদ যত বহমান, তার চেয়ে
সমুদ্রগুল্মের দেহে লেগে থাকা আমার গন্ধক
কখনই ভারি নয়!
বিষাদগ্রামের মত সেই দেশে জ্বলবে না কুপি
কখনই জানাবো না, আমি জাগ্রত।