আমাদের কবিতা: প্রথম পর্ব এখানে
আমাদের কবিতা : দ্বিতীয় পর্ব এখানে
আমাদের কবিতা কী রকম, কেন এমন হলো এবং সেটার যৌক্তিকতা কত দূর গত দুই পর্বে সেটা আমি লিখেছি এবং পাঠক ও এর ফলে শুন্যদশকের প্রবণতা চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। এ পর্যায়ে এসে আমাদের কবিতার প্রবণতা চিহ্নিত করতে যেয়ে আমি প্রবণতা হিশেবে কিছু কবিতার সরাসরি উল্লেখ করতে চাই। এই উদ্ধৃতি শুধুমাত্র প্রবণতাগুলোকে স্পষ্ট করে দেখানোর জন্যে, উদ্ধৃতিগুলোর সাথে কবিদের নামও তুলে দেব কীনা, এ প্রশ্নে আমার কাছে মনে হয়েছে যেহেতু কবিতাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু কবিতাগুলো এখানে নামহীন হয়েই অবস্থান করুক। এতে নামের ঔজ্জ্বল্যের বদলে কবিতাগুলো নিজেই আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, পাঠকও একে আরো নিরপেক্ষভাবে পড়তে পারবেন।
আমাদের কবিতার প্রবণতা সম্পর্কে, আমার কাছে মনে হয়, নিচের উদ্ধৃতিগুলোর পর আমার আর কিছু লেখার থাকতে পারে না। পাঠকের কাছে যখন টেক্সট হাজির- তখন তাকে আর ‘বুঝিয়ে’ দেয়ার কোনও মানে হয় না। কেননা, পাঠক যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান। তিনি নিজেই বুঝে নেবেন, গ্রহন বা প্রত্যাখান করবেন। আর এভাবেই একেকজন পাঠকের ইন্টারপ্রেটেশনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে শুন্য দশকের কবিতা। প্রিয় পাঠক, এবার তাহলে উদ্ধতিগুলো পড়া যাক । আশা করবে কবিতাগুলো পড়ে মন্তব্য করতে ভুলে যাবেন না , কেননা, আপনাদের মন্তব্যের উপরই একরকম গড়ে উঠবে এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য, শুন্যদশকের কবিতার রূপ:
১.
মায়ের উদ্দেশে বাবা যে চুমুটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বাতাসে শুনেছি, সেই হাওয়াই চুমুটা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো পৃথিবীর প্রথম প্রজাপতি
মা, পৃথিবীর যে-কোনো নারী থেকে যাকে কখনোই আলাদা করা যায় না—তাকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত-বিভ্রান্ত সেই প্রজাপতিটার ডানা থেকে যখন টুপটাপ ঝরে পড়ছিলো রঙের আকুতি—রঙের সেই অপচয় ঠেকাতেই সম্ভবত জন্ম হয়েছিলা পৃথিবীর আর সব প্রজাপতির
মাকে বাবা খুঁজে পেয়েছেন সেই কবে ! অথচ তার মুখের দিকে তাকিয়ে কখনোই মনে হয় নি—জীবনে একটাও প্রজাপতি তার খোঁপায় বসেছে।
২.
রাস্তায় কখনও কোথাও আমার নামটা দেখলে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাই। তখন রিক্সাচালককে বড় আত্মীয় মনে হয়। মনে হয় ওই বাড়ির সদস্য আমি। যার সামনে টিনের সাইনবোর্ডে লেখা : ইমরান ভিলা। তখন তিন পায়ের রিক্সাটাকে শরীর আর লেখাটাকে মনে হয় আমার মুখ।
আমার বাড়ির পাশে অসুস্থ একটি ছেলের নাম ইমরান। তার জন্য তুলেছি চাঁদা।
কোনো মেয়ের নাম যদি ইমরান হতো তাকে মনে হয় আমি বাসতাম সবচেয়ে ভালো বেশি।
আমার নামে আরও অনেক বাঙালিদের নাম আছে। এই থেকে প্রমাণিত হয় যে, পৃথিবীতে নামের চেয়ে মানুষ বেশি।
আমার পিতা অনেক গাছ লাগিয়েছে বাড়ি। একটা বৃক্ষের নাম রেখেছি ইমরান। এখন ভাবছি শালিক পাখি যেমন কথা বলে ; সে যদি একদিন বলে ওঠে ‘ও পথিক, জানো ! আমার নাম ইমরান মাঝি’।
আমার নামের অক্ষরগুলো দিয়ে এলোমেলো আরো কয়েকটা মানুষের নাম আছে। সেই ব্যক্তিসমূহকেও আমার আপন মনে হয়।
৩.
গোপন বাক্সের দিকে চেয়ে গিনিপিগ ওর লক্ষণীয় বনভূমি নেই।
গুনটানা মানুষের মতো ভেতরে গুঞ্জরন শুধু ! নিজস্ব সুর টুনটুনির
দূষণে খোয়া গেছে। হয়তো বাতাসও সে পথে সমর্পণ হতে গেছে।
পাশের সিট থেকে ভ্রাম্যমাণ কেউ-বা ‘জলে তর্জনী ডুবিয়ে
সহ্য করে মাছের ঠোকর’ নেহাত-ই কেউ যন্ত্রণায় পোড়ে !
বুঝি, মানুষ ঐ অতসীর খেলা শিখতে শিখতেই কতকাল নষ্ট করে
বাক্যবাগীশের চুলে টান ধরে শ্যামলারঙের মতো, তুমি দেখো—
এক ভ্রান্ত কবির অস্থি-মজ্জা, খানাপিনা, পাড়ভাঙা
মূলত, ভূগোল তৈরিতে যা লাগে- আমি বুঝি, ভেতরে ভেতরে পা ঠুকছে সে সব।
৪.
জোছনায় হেলান দিয়ে লাস্যময়ী রাত্রির কাছে কেমন করেই যেন মানিয়ে যাচ্ছে খলিফা হারুন-অর-রশিদ। এইরকম নেশাতুর রাতে গাছেদের ঘোরলাগা সেই অভূতপূর্ব উচ্চতাকে পেছন ফেলে, দুর্দান্ত লন্ঠন হাঁকিয়ে বহুদিন ছুটে গেছে বাড়ির পাশের বয়ে যাওয়া রাস্তা। পায়ের ওপর ভর করে পথের সংকলিত রচনা আর পথিমধ্যে বাদামি বাষ্প ওঠা ব্যথিত টি-স্টলের আগুন যারা রাত্রিকালে রিভিশান দেয়, সেখানে আমিও পেয়ে যেতে পারি দারিদ্র্য বিরচিত ঝরাপাতা, বহমান বিষাদ আর অকৃতকার্য ছাত্রের অশ্র“-পরিচিতি। যেমন তুমুল শাদা খাতায় উবু হয়ে জিরিয়ে নেয় নির্জনতার সা¤প্রতিকতম বঞ্চনা ; বিষণœ আলোর টিমটিম হাতছানি, মৃদুমন্দ শুকতারার চন্দ্রাহত ঘুমপাড়ানি ঘ্রাণ, ঘুমকাতুরে নিবিড় বৃক্ষরাজি, পানশালা—বাংলা মদ পেরিয়ে মাতাল রাস্তার ঢলে পড়া... তবু কী সকল অভাবের জোছনা ক্রোড়ে জড়িয়ে রাখতে পারে দূর অতিথিসম্পর্কের রাত ?
‘তুঁহু মম মন্দাক্রান্তা, নেশামন্ত বিভাসনিশুতি’-কেমন করেই যেন মানিয়ে যাচ্ছে খলিফা হারুন-অর-রশিদ... খলিফা অঝোর ঝরাপাতা। থরথর রাত্রি বিরচিত—বাড়ির পাশেও গাছেদের ঘোরলাগা...
৫.
এখনো কিছু দৌর্বল্য দূরবর্তী পাহাড়ের সবুজ গাছে, ঝিকিমিকি রোদে
হাজার যুগ যুগ মুহূর্তভাণ্ড বুক-সমুদ্দুরে, খেয়া হয়ে আছি
টানগণিতের সূত্রে ভাবনাসড়কে বিকারহীন দর্শন উঠে এলে
চোখের সম্মুখে দেখি গহীন পরিখা থেকে উঠে আসছে
লাল লাল আগুনের চোখ, প্রভাতসংগীত...
৬.
গগনে ঘুমন্ত মাঝি
তার নৌকা চন্দ্রগিরি পাড়ে লেগে আছে।
৭.
যে দরজায় নক করলো সে হচ্ছে আমি
যে দরজা খুললো সেও হচ্ছে আমি
যিনি কিছুই করলেন না তিনি হচ্ছেন
আমাদের লাশ
কবরে নেমে চকলেটের গন্ধ ছড়ান।
৮.
হে রেডিও, আমার প্রাণরে ভেতর হতে তাড়িয়ে এনেছো এই জেব্রা জবাই, আহত দৃশ্য- ভাঙা তোমার করুণ স্বও তাই। আর মধ্যরাতের অধৈর্য্য বাতাস বেয়ে সময়ের দিকে উঠে যাচ্ছে অস্থির শামুক; খোলসের গুরুভার, জীবনের ওজন, মাধুর্য্য, হাভাব, বেপথ এই রাতেই কী পার হয়ে যাবে আকাশের অদ্বিতীয় নক্ষত্ররচিত জ্বলজ্বলে স্তর, প্রজ্ঞাবৃক্ষ। যে আমি দাঁড়িয়ে আছি পাথর-পাত্রের ভেতর তা আজ ভরে গেছে রক্তে, অক্ষত শরীর থেকে কিভাবে যে এতো রক্ত বেরিয়ে আসছে- একাই উতরে গেলো ত্বকের প্রেক্ষাগৃহের দরজা, গাঢ রঙ, আড্ডা, মাতালের শিস, হাসি, বিষন্ন নিরিহ সুর, কামনা, সংলাপ।
প্রশান্ত নদীর পাশে শুয়ে আছি। জল আজ ধীরে ধীরে আলোসুতোর মায়াবী পথ ধরে ঐ পাহাড়ের দিকে চোখের আড়ালে তার শীতল তন্তুও পোষাক ছেড়ে আমাকেও ডাক দিচ্ছে বৃষ্টি শাবলের মত পৃখিবীর দিকে ছুটে যেতে।
শিশু শামুক, আজানা ঐ কীটরাজ্যে বরং তোমার সাথেই যাওয়া ভালো । লাখো জেব্রার পিঠের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে নিজের প্রথম নাম ভুলে যেতে যেতে রক্ত-গন্ধ ছড়ানো আমার দেহ তুলে দেব ক্ষুদার্থ সোনালী ঈগলের ঘরে।
৯.
আমি আর বাসের কাচের জানলায় আমার মুখ
পরস্পর কথা বলি, মাথা রাখি চুলে
সে বলে কীসের ভুলে তোমার গালটা এমন গরম ?
আমি বলি কই-তোমারটা তো ঠাণ্ডা
কীভাবে এ যাত্রীহীন সন্ধ্যায় আমার সাথে লুকোচুরি করো ?
আমার গলাটা গরম, কিন্তু তোমার আওতায় পৃথিবীর যাবতীয় রঙ্গমেলা
দুজনার আরও পরে আরও অনেক যন্ত্রণা শেষে দেখা হবার কথা ছিলো
দোষী হয়তো আমরা দুজনেই
১০.
সন্ধ্যা শেষের গলিতে দাঁড়িয়ে পাটল রঙের ঘোড়া। পিঠে তার ডানা নাই। দূর অতীতের আরবি ঘোড়ার এদেশি সহোদর, খর্বকায়। বাঁকানো শরীরে চাবুক আর ভারবহনের ক্লেশকর দাগগুলো কেউ একদিন হয়তো ঠিকই দেখতে পাবে। হ্রেষা নাই, চুপচাপ। আমি চিনতে চেষ্টা করি : ঘোড়াই বটে।
শুনি মধ্যরাতে তার হ্রেষা অকস্মাৎ ! আমাদের সুপ্তিঘোর চিরে লক্ষ-কোটি ঘোড়ার হ্রেষা তার সাথে একযোগে ছুটে চলে, ছুটে চলে রঙিন কাগজে বাঁধাই-করা বইয়ের মতো নিয়তির নানা মাঠ-বাট পার হয়ে...। সমস্ত নিয়তির শেষে পৌঁছানো যায় এখানে, এই প্রান্তরে, ঘোরলাগা পূর্ণিমায়। পড়ে আছে অশ্বের শাদা হাড়গোর। আর সর্বশেষ মীমাংসার শেষে যেন, অভিজ্ঞ শকুনেরা পাহারায়। তাঁরা বলে : ‘ঘোড়ারা পয়দা করে কেবলই ঘোড়া’।
মাঠের ওপারে সেই আয়ুবৃক্ষ। তার নিচে বসে আছে প্রবীণ শকুন। পাতা ঝরানো আর নাম-ঘোষণা এখন তারই আয়ত্তে। ঘোড়দৌড় তার খুব প্রিয়। সে বলে : ‘ঘোড়া দৌড়ায় জোরে...খুব জোরে। ঘোড়ার দলেই থাকে গাধা ও খচ্চর ; তারা দৌড়ায় না, হাঁপায়। দেখে সুখ আসে।’ এ সময় আয়ুবৃক্ষ হতে একটি পাতা ঝরে পড়লে সে ব্যস্ত হয়।
আমাদের উড়িয়ে নিতে চায় ফের তুমুল হ্রেষারব। দেখি কোটি কোটি অশ্বের অভিযান টলায়মান চাঁদের নিচে। জগতের সমস্ত আস্তাবল ভেঙে, কবিতা সঙ্গীত বা পটচিত্র থেকে, ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠা থেকে, রাত্রির তালাবদ্ধ সব চিত্রশালা পিছে ফেলে, প্রাচীন গুহার প্রস্তরিত অন্ধকার থেকে, ক্যানভাসের সদ্য-সমাপ্ত ছবি থেকে, অশ্বাসীন বীরের ভাস্কর্য থেকে বীরকে ভূলুণ্ঠিত করে ছুটে এসেছে সব ঘোড়া অদম্য অদ্ভুত দুর্বিনীত উল্লাসে...। তারা ছুটছে নির্বাধ স্রোত। উত্তেজনাবশত আমি চড়ে বসতে যাই। দেখি নিচে কাতরাচ্ছে সঙ্গিনী, এক ভয়ার্ত মাদী-ঘোড়া...গলায় আটকে গেছে হ্রেষা !
১১.
আজ রাতে আমি কোনো বান্ধবীর মোবাইলে হানা দেবো না, অপরিচিত হয়ে। আজ রাতে দূরের কোনো হরিণকে করবো না হ্যালো..., খাঁচাবন্দি করার লোভে। আজ সারারাত প্রার্থনা করবো প্রেতাত্মা ও লোডশেডিংয়ের। প্রার্থনা করবো সমুদ্রখেকো ঝিনুকের। পুজো করবো ডাইনির মোহনীয় আত্মার। আজ রাতে আমার সমস্ত শরীরের, আমার শরীরের সমস্ত পৃথিবীর এবং পৃথিবী-ঊর্ধ্ব জগতের ভেতর সবকিছু মিইয়ে যাবে। আমার নাভি থেকে বেরিয়ে একটা শিকড় গেঁথে যাবে মাটিতে। আমি হয়ে উঠবো পৃথিবীর প্রাচীনতম শিশ্নগাছ
তুই কী হবি, বলতো, আমার রোদ্দুর ?
১২.
পিঠে বৃষ্টি ঠেকিয়ে শীত আমাকে থ্রেট দিচ্ছে
-যাব যাব বলেছিলাম, যাইনি এখনো।