শৈশব পেরিয়ে যখন দুরন্ত কৈশরে পর্দাপণ করেছি, ইন্টারনেট না থাকলেও আমাদের হাতে ছিল সেবা প্রকাশনীর বই ( তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা,কুয়াশা, কিশোর ক্লাসিক, ওয়েস্টার্ন, কিশোর পত্রিকা, রহস্য পত্রিকা) ।সেবার বইগুলো আমাদের কাছে ইন্টারনেটের চেয়ে কম আনন্দময় ছিলনা। সেই ছেলেবেলায় প্রথম জেনেছিলাম এই অফুরন্ত আনন্দের উৎস একজন ব্যক্তি তিনি কাজী আনোয়ার হোসেন। ছেলেবুড়ো সবার কাছে তিনি কাজী'দা নামে পরিচিত ছিলেন । কাজীদা আমার কাছে একজন হ্যামিলনের বাশিঁওয়ালা। যার মধুময় বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়েছিল আমার লাখো কিশোর। স্কুলের টিফিনের টাকা বাচিয়ে আমরা কিনতাম সেবা প্রকাশনীর বই।বাসস্ট্যান্ড কিংবা রেলস্টেশনের বুকস্টলসহ সব বইয়ের লাইব্রেরীতে পাওয়া যেতো সেবার বই। হকার কাকুকে বলে রেখেছিলাম প্রতিমাসে কিশোর পত্রিকা / রহস্য পত্রিকা দেওয়ার জন্য। নব্বইয়ের দশকের বই মেলার আমার কাছে প্রধান আকর্ষণ সেবা প্রকাশনীর স্টল,হাজারো কিশোর তখন লাইন দিয়ে কিনতো সেবা প্রকাশনীর বই। এখনো বইমেলায় গেলে অন্তত একবার সেবা প্রকাশনীর স্টলের সামনে থেকে ঘুরে আসি বড্ড আপন মনে হয় এই স্টলটাকে।
ক্লাস সেভেন/এইটে ওঠার পর প্রথম মাসুদ রানা পড়া শুরু করি এর আগে একশটার মত তিন গোয়েন্দা পড়ে শেষ করেছি। একদিন আমার এক বন্ধু ক্লাশচলাকানীন সময়ে মাসুদ রানার বইসহ স্যারের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়লো। আমার বুক তখন ধক করে উঠলো, মনে মনে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ পড়তে লাগলাম কারণ আমার ব্যাগেও ছিল মাসুদ রানা। পরে জানলাম আমার মতো আরও দশবারো জনের ব্যাগেও ছিল একই বই।
ছেলেবেলায় প্রথম জেনেছিলাম সেবা প্রকাশনীর অফিস সেগুনবাগিচায়। অনেকবার মনে মনে সেবা প্রকাশনীর অফিস থেকে ঘুরে এসেছি তবে কোনদিন সাহস করে অফিসের আশেপাশেও যাইনি । আমার কাছে এখনো সেগুনবাগিচা এলাকার নাম শুনলে প্রথম মনে আসে সেবা প্রকাশনী এরপরই মনে আসে কাজীদা। জীবনে অনেকবার ইচ্ছা হয়েছিল কাজীদাকে সরাসরি দেখার তবে কোনদিন সেই সৌভাগ্য হয়নি।
সেবার কল্যানেই পৃথিবীর অনেক অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখা পড়ার সুযোগ পেয়েছে আমাদের জেনারেশন। আমাদের জেনারেশনকে প্রথম বইপড়া শিখিয়েছেন কাজী আনোয়ার হোসেন এবং পরে হুমায়ুন আহমেদ। হুমায়ুন আহমেদ তার বইয়ে লিখেছেন, তিনি লেখালেখির শুরুতে অর্থকষ্টে ছিলেন, একসময় জানতে পারেন কাজী আনোয়ার হোসেন বিদেশি গল্পের অনুবাদ করে দিলে টাকা দেন। তিনি রাতদিন পরিশ্রম করে একটি বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করেন যার নাম দেন 'অমানুষ'।পান্ডুলিপি নিয়ে তিনি কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন। এর আগে কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেই বইটি অনুবাদ করেছিলেন 'অগ্নিপুরুষ' নামে, তবে হুমায়ুন আহমেদের অনুবাদ কাজী আনোয়ার হোসেনের পছন্দ হয়। তিনি হুমায়ুন আহমেদকে এক হাজার টাকা দেন এবং বইটি সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করেন। হুমায়ুন আহমেদ তার আত্মজীবনীতে এই ঘটনাটি স্বরণ করেছেন।
হুমায়ুন আহমেদকে আমরা আগেই হারিয়েছি গতকাল হারালাম আরও এক কিংবদন্তি পুরুষ কাজী আনোয়ার হোসেন কে।
অনেক ধন্যবাদ কাজী'দা আমাদেরকে স্বপ্নময় শৈশব উপহার দেওয়ার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:১৪