এক.
আর দশটা ছেলের মতো পড়শোনা শেষ করে আমিও ঢাকায় এসেছি অনেক স্বপ্ন নিয়ে। আমার স্বপ্ন একটা ভাল চাকুরী, একটা ফ্লাট, তারপর বিয়ে, ছোট্ট একটি সুখের সংসার। কিন্তু ৩ মাস পরই বুঝলাম এই শহরে টাকা আয় করা সহজ কাজ নয়। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা টাকা প্রতিদিনই কমছে। এই শহরে এক গ্লাস পানি খেতেও যেখানে গুনতে হয় ১৫ টাকা, এককাপ চা খেতে লাগে ১০ টাকা।এখানে ইনকাম না করে টাকা খরচ করতে থাকলে রাজার ভান্ডারও শেষ হতে খুব বেশি দেরি হবে না ।
আমি লিমন, থাকি ঢাকার উওরার একটি মেসে। মেসের সীট ভাড়া ৩ হাজার টাকা, খাওয়া খরচ ২ হাজার, হাত খরচ ২ হাজার প্রতি মাসে চাকুরির ফরম ফিলাপ বাবদ খরচ আরও ২ হাজার টাকা, প্রতিমাসে আমার সর্বমোট খরচ ৯ হাজার টাকা। কিন্তু ইনকাম একেবারেই শূন্য। প্রথমে কিছু টিউশনি জোগাড় করার জন্য চেষ্টা করলাম। শহরে যত আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব আছে সবাইকে বললাম আমার জন্য টিউশনি ঠিক করে দাও। কিন্তু ফলাফল জিরো, সবাই জানালো বছরের মাঝামাঝি সময়ে টিউশনি পাওয়া যাবে না। আমি নিরুপায় হয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করলাম।
মাঝে মাঝে উদাস চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি আর মনে মনে ভাবি তবে কি আমার স্বপ্ন শেষ!
আবারও কি আমাকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে?
না সেটা কিছুতেই নয়। সিন্ধান্ত নিয়ে ফেলি বাইক চালাবো। আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ এ ধরনের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবে এটা অনেকেই ভাবতে পারেন না কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমি বাইক চালাবো। যেহেতু আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে তাছাড়া আমি যথেষ্ট ভাল বাইক চালাই। দেরি না করে গ্রাম থেকে বাইক নিয়ে এলাম। রেজিষ্ট্রেশন করে ফেললাম একটা রাইড শেয়ারিং কোম্পানিতে । শুরু হল রাইডার হিসেবে আমার যাত্রা।
প্রতিদিন আমার বাইকে নতুন নতুন মানুষ উঠে। দ্রুততম সময়ে তাদেরকে আমি পৌঁছে দেই যার যার গন্তব্যে। পুরুষের পাশাপাশি কর্মজীবী মহিলাও মাঝে মাঝে আমাকে কল দেয়, আমি সবাইকে সমান নিষ্ঠার সঙ্গে গন্তব্যে পৌঁছে দেই। আমি সাধারণত যাত্রীদের সাথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও বলি না। পুরুষ যাত্রীরা স্বাভাবিকভাবে বাইকের পিছনে বসলেও মহিলা যাত্রীরা থাকেন আড়ষ্ট সীটের মাঝাখানে ব্যাগ রেখে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখেন।
একদিন সকাল আট'টায় বাইক নিয়ে বের হয়েছি মোবাইল অন করার সঙ্গে সঙ্গেই রাইড শেয়ারিং এর রিকোয়েস্ট আসলো। আমি পৌঁছে গেলাম যাত্রীর লোকেশনে। যাত্রী একজন তরুণী,শ্যামলা বর্ণের তরুণীর মুখে হালকা মেকাপ ঠোঁটে গাড় লাল লিপিস্টিক, মিষ্টি পারফিউমের সৌরভ তার শরীর থেকে ভেসে আসছে।মুখে মেকাপ নেওয়ার পরও তার চেহারায় অদ্ভুত এক ধরনের সরলতার ভাব স্পষ্ট। মেয়েটি কোন প্রকার আড়ষ্টতা ছাড়াই আমার কাছ থেকে হেলমেট নিয়ে বাইকে চেপে বসলো। তরুণীকে গুলশানে নামিয়ে দিলাম, নামার সময় তরুণী বললো
'বাহ আপনিতো বেশ ভাল বাইক চালান'
আমি কোথায় থাকেন?
-উওরা ৪ নম্বর সেক্টর, আমি বললাম
-আপনার নম্বরটা আমি সেভ করে রাখছি প্রয়োজন হলে আপনাকে ফোন দিবো।
-আচ্ছা, আমি বললাম।
তরুণীর কাছ থেকে আমার পাওনা টাকা নিয়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়। শরীরে রয়ে গেল তরুণীর পারফিউমের মিষ্টি সৌরভ।
দুইঃ
আমাদের মেসে সদস্য সংখ্যা আট জন। ৪ জন ছাত্র আমিসহ ২ জন বেকার ( যদিও আমি এখন বেকার নই) ২ জন চাকুরীজীবী। আমার রুমমেটের নাম রাসেল। আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন সাবজেক্টে পড়াশোনা করেছি। রাসেল বড় শহরের নামকরা একটা কোম্পানিতে কাজ করে। রাসেল মাঝে মাঝে তার অফিসে গল্প করে। সেদিন রাসেল গল্প করছিল
-আমাদের বসের চরিত্র ভাল নয়, এই অফিসে যেসব মেয়েরা কাজ করে বসকে খুশি করেই তাদের চাকুরী করতে হয়।
-কি বলিস, এরা সমাজের উঁচু তলার মানুষ আর ইনাদের চরিত্র এত খারাপ? আমি বললাম।
-শুধু কি তাই, বস প্রতি মাসেই বিদেশ সফরে যান, অফিসের মেয়েদেরকেই বসের সফর সঙ্গী হতে হয়। মেয়েদেরকে শুধুমাত্র চাকুরী বাচানোর স্বার্থে বসের সব কথা মেনে নিতে হয়।
তিনঃ
একদিন রাত এগারোটার দিকে মোবাইল আমার ফোন বেজে উঠলো, নম্বর অপরিচিত।
-হ্যালো লিমন সাহেব বলছেন?
ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠের জিজ্ঞাসা।
- জি বলছি
-আপনি কে বলছেন?
-আমি সূবর্ণা
-আপনাকেতো ঠিক চিনতে পারলাম না।
-ওই যে গত রবিবার আপনার বাইকে চড়ে গুলশান গিয়েছিলাম,চিনতে পেরেছেন?
- জি চিনতে পেরেছি, আমার কাছে ফোন করলেন কি মনে করে?
-আপনি কি আমাকে একটু পিজি হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারবেন?
-এত রাতে?
-প্লিজ আজ আসুন না।
-আপনি এপস থেকে অন্য বাইক নিয়ে যান।
-প্লিজ আপনিই আসুন না। আমার বাবা হাসপাতালে ভর্তি আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
একজন সুন্দরী মেয়ের এ ধরনের অনুরোধে কিছুতেই প্রত্যাখ্যান করতে পারলাম না।
অগত্যা রাজি হলাম।
আমি পৌছানোর আগেই দেখি সূবর্ণা নামের মেয়েটি লোকেশনে দাঁড়িয়ে আছে।
-সরি এতরাতে আপনাকে বিরক্ত করলাম আমার বাবা হাসপাতালে।
-ঠিক আছে আপনি বসুন আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।
দ্রুততম সময়ে আমরা হাসপাতালে পৌছালাম। সূবর্ণা আমার হাতে তিনশো টাকা গুজে দিয়ে বললো আপনাকে ধন্যবাদ। আমি বললাম
- সরি আমি টাকাটা নেবো না।
-ছি ছি তাই কি হয়?
-হবে না কেন? এ শহরে আমি টাকার জন্য বাইক চালাই এটা ঠিক কিন্তু আমিও মানুষ আমারও বাবা মা ভাই বোন আছে।
আমার এই কথার পর সূবর্ণা কিছুই বললো না, সেদিন সারারাত সুবর্ণার সঙ্গে হাসপাতালের বারান্দায় কাটালাম, সকালে তার বাবার অবস্থা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হল। আমি বাসায় ফিরে এলাম।এরমধ্যে আরও দুইদিন সূবর্ণার বাবাকে দেখতে গেলাম।তার বাবা একসময় সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফিরে গেলেন।
মোবাইলে সুবর্ণার সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হতো। ধীরে ধীরে আমি তার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়লাম। প্রায় প্রতিদিনই অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসতাম, আবার অফিস ছুটির সময় নিয়ে আসতাম। ছুটির দিনগুলোতে শহর থেকে একটু দুরে দুজনে বেড়াতে চলে যেতাম। একদিন সুবর্ণাকে প্রপোজ করে ফেললাম। সে বললো
-দেখো লিমন আমিও তোমাকে ভালবাসি কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।
-কেন?
-আমার বাবা অসুস্থ্য পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমার কাধে, ফ্যামেলিকে ফেলে কোনদিনই তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমার ভাই অনেক ছোট, ও বড় হয়ে একটা চাকুরি না পাওয়া পর্যন্ত এই সংসারটা আমাকেই চালিয়ে নিতে হবে।
সুবর্ণার দায়িত্বশীলতা আমার ভাল লাগলো। আমি বললাম তোমার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজী।
চারঃ
সুবর্ণা আর আমি জীবনের স্বর্ণালী সময়গুলো উপভোগ করছিলাম। একসময় আমিও ভাল একটা চাকুরি পেয়ে গেলাম। আমার জীবনের সব স্বপ্ন যেন হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিচ্ছে একে একে। সুবর্ণাকে বললাম
-চল এবার দুজনে বিয়ে করে ফেলি, তোমার চাকুরির টাকা তুমি তোমার পরিবার চালাবে,আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না।
একসময় সুবর্ণার মা বাবাকেও বললাম বিয়েতে রাজী করাতে, আপনাদের দায়িত্ব আমরা দুইজনে পালন করবো। সবাই সুবর্ণাকে বোঝাতে চেষ্টা করলো। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও বললো সুবর্ণা।
একদিন ভর দুপুরে সুবর্ণা আমার মেসে এসে হাজির, আমিতো ওকে দেখে তাজ্জব বনে গেলাম।
-তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য চলে এলাম, সে বললো
-সত্যি অনেক ভাল লাগছে তোমাকে আমার মেসে দেখে।
-তোমার মেসে প্রথম আসলাম কি খাওয়াবে?
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম।
শুধু ডিম ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমি মরিচ পেয়াজ দিয়ে একটা ডিম ভাজি করে আনলাম, সঙ্গে এক প্যাকেট সস। মেয়েরা যেকোনো খাবার সস দিয়ে খেতে পছন্দ করে।
-বাহ, ডিমটাতো ভালোই ভেজেছো, এই বিদ্যা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে বলে হাসতে লাগলো।
এরই মধ্যে আমার রুমমেট রাসেল হাজির, রাসেল সুবর্ণাকে দেখেই চমকে গেল। সুবর্ণাও দেখলাম রাসেলকে দেখে চমকালো। আরে তোমরা কি পূর্ব পরিচিত নাকি।
আরে হ্যাঁ,সুবর্ণাতো আমাদের অফিসেই আগে চাকুরী করতো, রাসেল বললো।
আমার বুকের মধ্যে ভয়াবহ ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। আর কিছুদিন পরেই সুবর্ণা আর আমার বিয়ে। কিছুদিন আগেই রাসেল জানিয়েছিল তাদের অফিসে বসকে খুশি না করে কোন মেয়ে চাকুরী করতে পারেনা তার মানে সূবর্ণাও তাই?
পাঁচঃ
এরপর থেকে সুবর্ণার সঙ্গে আমি যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম। সে ফোন করলে হাই হ্যালো টাইপের কথা বলতাম।সুবর্ণা জিজ্ঞেস করলো
-তোমার কি হয়েছে, তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ কেন।
আমি কোন উওর দিতে পারছিলাম না।আমার বারবার মনে হচ্ছিল সুবর্ণাও কি তাহলে বসকে খুশি করে চাকুরী করতো? আমার উদাসীনতায় সুবর্ণাও আমার সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিল। দুইজন এখন আমরা দুই মেরুর বাসিন্দা।
একদিন ছুটির সকালে রাসেল আর আমি মেসের রুমে বসে আছি
রাসেল আমার কাছে জিজ্ঞেস করলো
-কিরে সুবর্ণার খবর কি, তোদের বিয়ে কবে?
-অফিসের বসকে খুশি করে চাকুরী করা মেয়েকে কি বিয়ে করা যায়? আমি বললাম।
রাসেল আশ্চর্য হয়ে বললো
-আরে সুবর্ণা ওই ধরনের মেয়ে নয়। অন্যান্য মেয়েদের মতো সুবর্ণাকেও বস কুপ্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু সে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সেদিনই চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে।
সেদিন সূবর্ণার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়ে গেল। আমি মার্কেট থেকে সূরর্ণার জন্য একটা লাল শাড়ি,একটা আংটি, নাকফুল ও আমার জন্য একটা পাঞ্জাবী কিনে রাসেল নিয়ে সোজা সূবর্ণাদের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। সেদিন রাতেই আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। সুবর্ণাদের বাড়িতেই আমাদের বাসর হল।বাসর রাতে আমি সুবর্ণার দিকে আপলোক তাকিয়ে থাকি আর মনে মনে বলি
-এইতো আমার সেই স্বপ্নের রাজকন্যা, যার জন্য আমি এতগুলো বছর অপেক্ষা করে বসে আছি।
সত্যি জীবনটা বড্ড সুখের, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সুবর্ণাকে নিয়েই বাচতে চাই।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:০৩