উওরার আজিমপুর বাসস্টান্ডে টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে আছি বাসের আশায়। হঠাৎ কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকলো। তাকিয়ে দেখি ভার্সিটির বন্ধু রাশেদ। ব্যস্ত শহরের রাস্তায় বন্ধুদের দেখা পাওয়া মানে অদ্ভুত এক ভাললাগার ব্যাপার। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। মনের আকাশে ভীড় করলো ক্যাম্পাস জীবনের হাজারো স্মৃতি। কিন্তু হাতে সময় নেই দেরি করলে অফিসে বসের ঝাড়ি খেতে হবে তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রিয় বন্ধুর কাছ থেকে আমাকে বিদায় নিতেই হল। একসাথে বসে ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ করা হল না। তবে রাশেদ জানালো তার বাসা কাছেই আগামী শুক্রবার আমার দাওয়াত। মেসে বুয়ার হাতের আজেবাজে খাবার খেয়ে পেটেটা একেবারে পচে গেছে তাই বন্ধুর বউয়ের হাতের মজাদার খাবারের দাওয়াত সেই সঙ্গে একসাথে বসে ছাত্রজীবনের স্মৃতি চারণের লোভ সামলাতে পারলাম না। তবে মনে মনে ভাবলাম রাশেদ যদি পুনরায় ফোন করে দাওয়াত দেয় তবেই যাবো নতুবা নয়। বৃহস্পতিবার রাতেই রাশেদ আমাকে আমাকে ফোন করে দাওয়াতের কথা মনে করিয়ে দিল, এবারতো আর না যেয়ে উপায় নেই।
নির্ধারিত দিনে বনফুলের দুই কেজি মিষ্টি আর বন্ধুর বাচ্চার জন্য চকলেটের একটা বক্স নিয়ে বন্ধুর বাসায় হাজির হলাম। বন্ধুর ড্রইংরুমে বসে ক্যাম্পাসের অনেক অনেক স্মৃতিচারণ হল, বন্ধুর মেয়েটাও খুব সুইট তাকে কোলে নিয়ে আদর করলাম। রাশেদ বললো
-এবার তুইও বিয়েশাদি করে সংসারী হ। এভাবে আর কত দিন?
খাবার টেবিলে দেখি এলাহী আয়োজন। গরুর মাংস, ইলিশ মাছ, বেগুন ভাজী, মাশকালাইয়ের ঘন ডাল আরও কত কি?
কিন্তু বন্ধুর বউয়ের কোন দেখা নেই।
-তোর বউকে একটু ডাক পরিচিত হই।
-ধীরে বন্ধু, আসছে, তুইতো ওকে চিনিস?
-আমি?
এরই মধ্যে বন্ধুর বউ হাজির।
সত্যিইতো চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু মনে করতে পারছি না কোথায় যেন দেখেছি।
রাশেদই আমাকে মনে করিয়ে দিল, আরে ওর মোবাইল নাম্বারতো তোর কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। এবার আমার সব মনে পড়ে গেল।
২০০৪/০৫ সালের দিকে হঠাৎ করেই মোবাইল অপারেটর গ্রামীণ ফোন ডিজুস নামের সিম বাজারে নিয়ে আসলো। যে সীমে মাত্র আড়াই টাকা খরচ করে একটা কল করলেই হল, ব্যাস সারারাত আর কোন খরচ নেই রাত ১২ টার পর থেকে সারারাত ফ্রি। মিনিটে ৭ টাকা খরচের ভয়ে বেশিরভাগ ছাত্রই যেখানে মোবাইল ব্যবহার করতো না সেখানে এই অভিনব অফারের প্রলোভনে ইয়াং জেনারেশন মেতে উঠলো ডিজুস জ্বরে।সেই যে ইংরেজদের ভারতবর্ষের লোকেদের ফ্রিতে চা খাওয়ানোর মত ব্যাপার। কয়েকমাসের মধ্যেই রাবির বেশিরভাগ ছাত্রের হাতে হাতে পৌঁছে গেল মোবাইল ফোন।ছাত্ররা প্রথম প্রথম পকেটে নয় হাতে করে ঘুরে বেড়াতে লাগলো মোবাইল। সবার রাতের ঘুম হারাম। এমনিতেই ভার্সিটির ছেলেমেয়েরা অনেক রাত জাগে আর মোবাইলে ফ্রি কথা বলার এই অভিনব অফারের কারণে রাতজাগা আরও বেড়ে গেলে। শুধু রাত বারোটার জন্য অপেক্ষা তারপরই মোবাইল নিয়ে ঝাপিয়ে পড়া। কেউ কেউ রুমের বাইরে বারান্দায় চেয়ার বের করে বসে শীতে কাপতে কাপতে আবার কেউ লেপের মধ্যে ঢুকে ফিস ফিস করে, কেউবা বারান্দায় দাড়িয়ে, কেউ সিড়িতে বসে এমনকি বাথরুমে বসেও অনেককে প্রেমালাপ করতে শোনা যেতো।
সবাই যখন আড়াই টাকায় সারারাত কথা বলে তখন ৭ টাকা মিনিটে কথা বলার যুক্তি নেই এই ভেবে আমিও কিনে ফেলি একটা ডিজুস সীম। সীম তো কেনা হল এবার কথা বলা যায় কার সাথে?
একরুমমেট পরামর্শ দিলো ০১৭১৭ এর পর একটা পর একটা নম্বর বসিয়ে ডায়াল করতে থাক, দেখবি কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবি। প্রথম কলে কাজের বেটি রহিমা টাইপের একজন কল ধরে বললো
-আফনে কেডা ? কারে চান? অন্তরাত্তা কেপে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিলাম। তবে হাল ছাড়লাম না, এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা চলতে থাকে চেষ্টা।
কয়েক ঘন্টার চেষ্টায় সফলতা দেখা মেলে। মেয়েটা ক্যাম্পাসেরই, প্রথম দিনই আলাপ বেশ জমে গেল, নাম মায়া,কথাবার্তাও মায়াময়। ডিপার্টমেন্টের নাম বললো না তবে জানালো ফাস্ট ইয়ার, থাকে খালেদা জিয়া হলে। মনে মনে শান্তনা পেলাম ৪৫০ টাকা দিয়ে ডিজুস সীম কেনা সার্থক।
কিন্তু সেই প্রথম দিনের আলাপ পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো কথাবার্তা, বেশিদুর এগুলো না। পরদিন থেকে আর মায়ার নাম্বারে কিছুতেই ঢুকতে পারলাম না, যখনই ফোন করি তখনই নম্বর বিজি। রাত ১২ টা ১ মিনিটেও বিজি রাত ২ টার সময়ও বিজি। অতএব মায়া অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি।
আমার মতো আমার বন্ধুদের অনেকেরই ডিজুস সীম আছে কিন্তু কথা বলার মানুষ নেই। বন্ধু হৃদয় একদিন বললো
-দোস্ত একটা মেয়ের নম্বর দে একটু আলাপ জমাই।
মনে মনে বললাম
-আমার নিজের পেটেই হাটুপানি তোরে কি দিমু? কিন্তু মুখে বললাম ভিন্ন কথা।
- নো চিন্তা দোস্ত, মোবাইলের ফোনবুক থেকে মায়ার নম্বর বের করে হৃদয়কে দিলাম।
একইভাবে লিমন, শাহেদকেও মায়ার নম্বর দিলাম
মনে মনে ভাবলাম
-আমি পারি নাই তবে এদের ৩ জনের মধ্যে একজনতো নিশ্চয়ই সফল হবে।
ঠিক একমাস পর ক্যাম্পাসের গাছের ছায়ায় হৃদয়ের সাথে দেখা হল। তবে একা নয় সঙ্গে শ্যামলা বরন আর ছিপছিপে গড়নের একটি মেয়ে। একসাথে বসে কাসুন্দি দিয়ে মাখানো পেয়ারা খাচ্ছে। আমাকেও খেতে দিলো। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল এভাবে
-ও মায়া আমার গার্লফ্রেন্ড।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম আর মনে মনে ভাবলাম এটাই তাহলে সেই মায়া?
যাক আমি না পারলেও আমার বন্ধু হৃদয় সফল।
৫ মাস পর।
বন্ধু লিমন থাকতো শহরের একটি নামকরা মেসে। একদিন শুক্রবার কিছু কেনাকাটা করতে শহরে গিয়েছিলাম।ভাবলাম যাই লিমনের সাথে একটু দেখা করে আসি। লিমনের দরজায় টোকা দিলাম কিন্তু লিমন দরজা খুললো না। জিজ্ঞেস করলো
-কে?
আমি নিজের নাম বললাম।
লিমন বললো
-ও তুই একটু দাড়া খুলছি।
ভিতরে ঢুকে তাজ্জব বনে গেলাম, লিমনের রুমে একটি মেয়ে ( রাজশাহীর এই মেসটিতে দিনের বেলা মেয়েদের যাওয়ার অনুমতি ছিল)। মেয়েটিকেও চেনাচেনা লাগলো। যা ভাবছেন ঠিক তাই, মেয়েটা মায়া।
কিন্তু মায়া আজ হৃদয় বা লিমনের বউ নয় সে রাশেদের বউ। রাশেদ কিভাবে মায়াকে পটালো সেই বর্ণনা দিতে লাগলো। এবং আমাকে বার বার ধন্যবাদ দিতে লাগলো মায়ার সাথে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য। রাশেদ ওয়াশরুমে যাওয়ার পর মায়া আমাকে বললো
-শুধু বারবার আপনার সাথেই দেখা হয় কেন বলুন তো?
আমি বিজ্ঞের মতো বললাম
-পৃথিবীটা গোল তাই ঘুরে ঘুরে একই মানুষের সাথে বার বার দেখা হয়।
মায়া বললো
-গোল না ছাই, আমি আপনার কেসটা বুঝে গেছি আমার নম্বরটা আপনিই এদের তিন জনকে দিয়েছেন।
এরই মধ্যে রাশেদ চলে এল। আরও কিছু সময় আমরা গল্প করে আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
রাস্তায় হাটতে হাটতে ভাবলাম স্বামীস্ত্রীর একে অপরের অতীতের সব গল্প না জানাই ভাল।
ছবিঃ ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০২০ দুপুর ১২:০৬