বছখানিক আগের কথা। অফিস থেকে আগেভাগেই বেরিয়েছি। গাড়িতে প্রচুর ভীড়, তার উপর মৎস্যভবন থেকেই শুরু হয়েছে প্রচন্ড জ্যাম। একসময় ধৈর্য হারিয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাটা শুরু করলাম, যেটা প্রায়ই করে থাকি। হাটতে হাটতে শাহবাগ শিশুপার্কের সামনে চলে এলাম। রাস্তার পাশে হকাররা ফুচকা, চটপটি আচারসহ নানা রকমের খাবারের পশরা সাজিয়ে বসে আছে। খোলা আচার দেদারসে বিক্রি হচ্ছে যা দেখতে খুবই লোভনীয়। রাস্তার ধুলাবালিকে আচারগুলো যেন নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আচারের সাথে ধুলাবালি আঠার মত লেগে যাচ্ছে। আর বোটকা সাইজের মাছিগুলো আশপাশ দিয়ে ঘুরাঘুরি করছে। অনেক শিক্ষিত মানুষও ওগুলো টাকা দিয়ে কিনে খাচ্ছেন।
শিশুপার্কের সামনে গাড়ির জন্য দাড়িয়ে আছি দীর্ঘ সময়। কিছুতেই গাড়িতে উঠতে পারছি না, সবগুলোরই দরজা বন্ধ। গাড়ি থেকে নেমে ভালোই বিপদে পড়ে গেলাম। ফুটপাত দিয়ে একজোড়া তরুণ তরুণী হাত ধরাধরি করে হেটে যাচ্ছে। এরা সম্ভবত কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। যদিও এটা খুবই সাধারণ ঘটনা, কিন্তু হঠাৎ করেই মেয়েটাকে দিকে চোখ পড়তেই চেনাচেনা মনে হল। স্মৃতির ভান্ডার তোড়পাড় করলাম কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।তারা আমার থেকে ১৫-২০ বছরের ছোট হবে তাই এদেরকে চেনার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। ততক্ষণে তরুণ তরুণী বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে গেছে, তাদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি মেয়েটাকে কোথায় দেখেছি? হঠাৎ করেই তারা দাড়িয়ে পড়লো এবং তরুণী তার ব্যাগ থেকে একটা টিস্যু পেপার বের করলো। টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ নয় হাতের তালু মুছলো ও ছেলেটার হাতের তালু মুছে দিল। পুনরায় তারা হাত ধরাধরি করে ঢাকার জনস্রোতে মিশে গেল। টিস্যু দিয়ে হাত মোছার দৃশ্যটা আমার স্মৃতির দুয়ার খুলে দিলো। আরে এই মেয়েটাতো নীতু।
সেই ছোট্ট নীতু। নীতুর সাথে এর আগেরবার যখন দেখা হয়েছিল তখন নীতুর বয়স ৭/৮ বছর হবে।আমি তখন রাবির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, নীতু আমার বন্ধুর খালাতো বোন। ক্যাম্পাসে এসেছিল বেড়াতে। মুখটা গোল গাল, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলে দুটো বেনী করে রাখতো আর মুখটা ছিল সবসময়ই হাসিখুশি।হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে মিষ্টি হেসে কথা বলতো। তখন ওকে দেখে আমার মনে হয়েছিল
-ইস আমার কেন একটা ছোট বোন নেই?
সেদিন আমিই ওকে হাত ধরে সারা ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলাম।বিশাল ক্যাম্পাস দেখে সেদিন নীতুর চোখে ছিল মুগ্ধতা। দীর্ঘ সময় হাত ধরে থাকতে থাকতে একসময় আমার মনে হয়েছিল হাতের তালু ভিজে যাচ্ছে, নীতু তার জামার পকেট থেকে টিস্যু বের করে নিজের হাতের তালু মুছলো সাথে আমারটাও মুছে দিয়ে বললো
-সরি ভাইয়া, আমার হাতের তালু খুব ঘামে।
সেই ছোট্ট নীতু এখন তরুনী। আজ সে ভাইয়ার হাত ধরে নয় প্রেমিকের হাত ধরে আছে, তার সেই হাত আজও একইভাবে ঘামছে। আসলে জীবনের বিভিন্ন সময় আমাদেরকে বিভিন্ন মানুষের হাত ধরে এগিয়ে যেতে হয় যেমন ছোট বেলায় বাবা মায়ের হাত, প্রাপ্ত বয়সে প্রেমিক/প্রেমিকা কিংবা স্বামী/স্ত্রীর হাত আর শেষ জীবনে সন্তানদের হাত। সবসময়ই কারও না কারো হাত ধরেই এগিয়ে যেতে হবে এটাইতো প্রকৃতির নিয়ম।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৪