লন্ডনে থাকাটা আমার জন্য একটা শিক্ষা সফরের মতন ছিলো। অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন হইছে লন্ডনে থেকে। কত আজব আজব ধরনের মানুষের সাথে দেখা হইছে আর থাকা হইছে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে বেনেডিক্ট! বেনেডিক্টের ব্যাপারে বলার আগে একটু পিছনের কাহিনী বলে নেই।
Photo Credit: Google.
লন্ডনে আমরা সাধারনত একটা বাসা ভাড়া নিতাম এজেন্সির কাছ থেকে তারপর সেই বাসার কোনো রুম খালি থাকলে সেটা আবার আমরা অন্য মানুষের কাছে ভাড়া দিয়ে দিতাম। এতে করে বাড়ি ভাড়ার পরিমানটা অনেক কমে যেতো। সেরকমি একটি বাসা ছিলো আমার। সেই বাসায় আমি আর আমার কাজিন আর আরো দুইজন বাঙ্গালী ভাই মিলে টোটাল চার জন থাকতাম। তো সেই বাসার একটা রুম খালি থাকায় আমি ইন্টারনেটে এড দেই একরুম ভাড়া দেবার জন্যে। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে লন্ডন বা বাইরের কোনো দেশে কেউ কালোদের ভাড়া দিতে চায় না বা ভাড়া দিতে ভয় পায়। তো এড দেখে সন্ধা বেলা একজন বাসা দেখতে আসলো নাম ইউসুফ ভারতীয় মুসলিম। কথা বার্তা বলে বেশ ভালো লাগলো এবং তখনই সে বাসা ভাড়া নিয়ে নিলো। বললো যে সে আর তার এক কলিগ থাকবে। তখনই টাকা এডভান্স দিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে নিলো।
ইউসুফ ভাই খুব অমায়িক মানুষ ছিলো। অত্যান্ত ভদ্র একজন মানুষ। সে যাই হোক পরের দিন কলিগ আসতেই তো আক্কেলগুরুম! এ দেখি কালো ভাই যার নাম হচ্ছে বেনেডিক্ট। মূলত ইউসুফ ভাই আর বেনেডিক্ট কার ওয়াশের কাজ করে এর মধ্যে ইউসুফ হচ্ছে বস আর বেনেডিক্ট হচ্ছে কর্মচারী। কিছুদিন বেনেডিক্টের সাথে থাকার পর অবশ্য আমাদের ভুল কিছুটা ভান্গে। কারন বেনেডিক্ট অন্য কালোদের মত এগ্রেসিভ ছিলো না বরং একটু বোকাসোকাই ছিলো।
বেনেডিক্ট হচ্ছে নাইজেরিয়ান। সমস্যা একটাই ছিলো মাঝে মধ্যে রান্নাঘরে তার দেশিয় খাবার রান্না করলে গন্ধে ঘরে টেকা যাইতো না। তার ফেভারিট খাবার ছিলো সম্ভবত ফুফু। ফুফু দেখতে অনেকটা আলু ভর্তার মতন। খাইতে কেমন সেটা অবশ্য জানা হইনাই কারন কখনো চেখে দেখা হইনাই। তবে ফুফু সম্ভবত চাল বা গমের গুরা দিয়ে বানানো। তার আরেকটা প্রিয় খাবার ছিলো মনে হয় টমেটো। কারন প্রায়ই দেখতাম সে দুই তিন কেজি টমেটো এনে সেটাকে সেদ্ধো করে ফ্রীজে রেখে দিতো। বেনেডিক্ট একদিন কোথা থেকে জানি বিশাল এক গরুর না ছাগলের মাথা কিনে নিয়ে কিচেনে সিংকের মধ্যে পানির মধ্যে ভিজিয়ে রাখছে। সেই দিনই আমাদের বাসার গ্যাসের বয়লার ইনস্পেকশনের জন্য লোক আসার কথা। যথা সময়ে এক সাদা লোক বয়লার ইনস্পেকশন করতে আসছে। এসে সিংকের মধ্যে ঐ মাংসপিন্ড দেইখা আমারে জিজ্ঞেস করছিল ইজ ইট এ ডেড বডি পার্ট! সাচ এ এম্বেরেসিং মোমেন্ট। যাওয়ার সময় সন্দেহে চোখ নিয়ে তাকাইতে তাকাইতে ঘর থেকে বের হইছে। ভাগ্যিস পুলিশে কল করে নাই।
আমরা প্রতিদিন সকলে নাস্তার সময় কাচা মরিচ পেয়াজ দিয়ে ডিম মিশিয়ে ভাজি করে পরোটা দিয়ে খেতাম। ডিম ভাজির প্রক্রিয়াটা বেনডিক্ট খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতো। তো একদিন কোন কুক্ষনে আমার খালাতো ভাই বেনেডিক্টরে ডিম ভাজি করা শিখায় দেয়। এর পর থেকে আর যায় কোথায় প্রতিদিন সকালে বা যখনি চান্স পাইতো ডিম ভাজি কইরা খাইতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রায় ২০/৩০ মিনিট বাটির মধ্যে পেয়াজ মরিচ ডিম দিয়ে ফেটটেই থাকতো। টুং টাং টুাং শব্দে একাকার অবস্থা। মাঝে মধ্যে সকালে ঘুমের বারোটা বাজতো বেনেডিক্টের এই ডিম ভাজির চক্করে।
তবে বেনেডিক্টের একটা অভ্যাস ভালো ছিলো। সে প্রতিদিন রাতে এসে মেট্রিক্সের অংক করত। ঘন্টার পর ঘন্টা দেখা যাইতো খাতায় অংক মিলাচ্ছে। এক রাতে আমি আর আমার কাজিন ঘুমাইয়া আছি। হঠাৎ রাতে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা। কাহিনী কি পুলিশ আসছে। কাহিনী আর কিছুই না। আমাদের নম্র ভদ্র ইউসুফ ভাই কম্পানীর সেফ ভেংগে টাকা নিয়ে ভেগে গেছে। তো পুলিশ তার খোজে বাসায় আসছে। পুলিশ কি আর ইউসুফকে বাসায় পাবে। সে তো চম্পট। তারপর ইউসুফ ভাইয়ের রুম চেক টেক করে বিদায় নিছে। কিন্তু সেই রাতে আমাদের বেনেডিক্ট পিছনের দরজা দিয়ে পালাইছিল। পরের দিন বাসায় এসে অবশ্য সব আমাদের খুলে বলছে। সে তখনো বিশ্বাস করতে পারতেছিলনা যে তার রুমমেট এই রকম একটা কাজ করতে পারে। যদিও আমাদের ধারনা ছিলো ইউসুফ ভাই ফেরেস্তার মতন মানুষ আর বেনেডিক্ট হয়তো খারাপ মানুষ কিন্ত হইছে তার উল্টাটা। এই জন্যই বোধহয় এই কথাটার প্রচলন হইছে যে, "Never Judge a book by its cover!"
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৮ সকাল ১১:০৫