শপিংমলের ভিতর এভাবেই নেচে গেয়ে আপনার মূহুর্ত্বটাকে আরো আনন্দদায়ক করে তুলতে পারে এই মেক্সিকান নর্তকীরা।
যাদের লম্বা লেখা পড়বার অভ্যাস নেই তারা চাইলে আমার ভ্রমনের ভিডিওটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে দেখে নিতে পারেন। আর ব্লগের লিমিটেশনের কারনে সব ছবিও দেওয়া সম্ভব হয় নি। নিচে আমি আমার ইউটিউবের ভিডিও লিংক এড করে দিচ্ছি।If you want to watch the vlogging video please click in the link below:
তাহলে শুরু করা যাক....
একটা দেশ ঘুরলে নাকি ১০০টা বই পড়ার থেকে বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। ছোট বেলায় স্কুলে সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে মায়া সভ্যতা সম্পর্কে পড়ে নাই এমন মানুষ হয়তো খুজে পাওয়া দুস্কর। সেই মায়ান সভ্যতার উৎপত্তিস্থল মেক্সিকো থেকে ঘুরে আসলাম গত মাসে। মায়া সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেক্সিকোর সবজায়গায়। এমনকি মেক্সিকোর বিভিন্ন জায়গার নামকরন করা হয়েছে সেই মায়ানদের সময়েই। আমরা যে জায়গাটায় গিয়েছিলাম সেটার নাম হচ্ছে কেন-কুন। যার অর্থ হচ্ছে সাপের বাসা। কেন মানে স্বর্প আর কুন মানে হচ্ছে বাসা। নাম শুনে ভয় পাবার কোনো কারন নেই কারন আমার পাঁচ দিনের সফরে একটিও সাপের দেখা মেলে নি। সে যাই হোক এখন সূচনা পর্ব বাদ দিয়ে মূল লেখায় চলে যাই। আশা করি ভবিষ্যতে কেউ মেক্সিকো ঘুরতে গেলে এই লেখাটা তার কাজে আসবে।
বিমান থেকে তোলা আকাশের ছবি।
প্রথমেই আসি ইমিগ্রেশন আর ভিসা প্রসন্গে। আপনার যদি আমেরিকান পাসপোর্ট বা গ্রীন কার্ড থাকে তবে আগে থেকে কোনো ভিসা নেওয়া লাগে না। আমরা মেরিল্যান্ড থেকে যখন প্লেনে করে কেনকুন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নামি তখন ঘরিতে সময় মাত্র সকাল দশটা। ফর্ম পূরন করে ইমিগ্রেশনের সামনে আসতেই চোখে পরে মেক্সিকান ইমিগ্রেশন অফিসারদের। হাসি খুশি অল্প বয়সী কয়েকটি ছেলে মেয়ে ইমিগ্রেশনের স্টলে বসে গল্প করছে কেউ বা চুল ঠিক করছে। দেখে মনেই হয় না যে ইমিগ্রেশন অফিসার। এদেরকে দেখে আমাদের দেশের রুড ইমিগ্রেশন অফিসারদের চেহারার কথা মনে পরে গেলো। পাসপোর্ট আর ফীল আপ করা ফর্মটি ইমিগ্রেশন অফিসারের হাতে দিলাম খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সীল মেরে ফেরত দিলো কোনো প্রশ্ন করা ছারাই। সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে সহজ ইমিগ্রেশন পার করেছি।
আমার হোটেলের বাইরের দৃশ্য।
ইমিগ্রেশন পার করে সামনে এগুতেই নজরে পরলো দেওয়ালের মধ্যে বড় করে লেখা 'স্বর্গ থেকে মাত্র এক পা দূরে'। কেনকুনের সৌন্দর্য আসলেই লাইনটার যথার্থতা প্রমান করে। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে আপনি দুই ভাবে যেতে পারেন। এক সাটলে অথবা ট্যাক্সিতে করে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি যেই হোটেলে উঠবেন সেই হোটলের ট্রাণ্সপোর্টেশন আগে থেকে ঠিক করে রাখেন। তাহলে খরচ সবচেয়ে কম পরবে। যেহেতু আমরা আগে থেকে আমাদের যাতায়তের ব্যবস্থা ঠিক করে রাখি নি সেহেতু এয়ারপোর্টের বাইরে ডেস্কে থেকে আমাদের টেক্সি ঠিক করি। ট্যাক্সিতে রিটার্নসহ আমাদের খরচ পরে ৭৬ ডলার। টেক্সিতে করে হোটেল যাওয়ার পথেই চোখে পরলো রাস্তার দুইপাশের চোখ ধাধানো সৌন্দর্য। মেক্সিকো আদতে গরীব দেশ হলেও কেনকুনের টুরিস্ট এরিয়া দেখে সেটা বিন্দু মাত্র বুজবার উপায় নেই।
বীচে কেউবা ভলিবল খেলছে কেউবা আবার রোদ পোহাচ্ছে।
সকাল ১২ টার মধ্যেই আমরা আমাদের রিসোর্টে পৌছে যাই। রিসোর্টের ভিতরের ইন্টেরিয়র দেখেই আমাদের যাত্রা পথের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আর রিসোর্টের লবি থেকে যখন সামনের সমুদ্র চোখে পরে তখনি মন চাচ্ছিল নীল পানিতে গিয়ে ঝাপ দেই। দুইটা ইনফরমেশন এক মেক্সিকোর ভাষা হচ্ছে স্প্যানিশ আর মুদ্রার নাম হচ্ছে পেসো। ১ ডলার = ১৮ পেসোস। হোটেল থেকেই ৪০ ডলার ভান্গিয়ে টোটাল ৭০০ পেসোস পেলাম। আপনি মেক্সিকোতে চাইলে আমেরিকান ডলারো ব্যবহার করতে পারবেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পেসোস এর দরকার পরে। শুরুতেই হোটেল থেকে একটা লোকাল এরিয়ার একটা ম্যাপ জোগার করে নিলাম। যদিও মেক্সিমাম টাইম হোটেলের আসে পাশেই থাকা হইছে। রিসোর্টের ভিতরেই সুইমিংপুল তার সাথে লাগানো হটটাব। আর একটু হেটে নিচে গেলেই কেনকুনের নীল সমুদ্রসৈকত। পাঁচ দিনের ভিতর তিন দিনই হোটেলের ভিতর ছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করেই সুইমিংপুল তারপর দৌড়ে গিয়ে সমুদ্রে ঝাপ তারপর ফিরে এসে আবার সুইমিং পুল। এর পর হট টাবের গরম পানিতে ঘন্টা খানেক শুয়ে থেকে হোটেলে বেক করতাম। মাঝখানে সুইমিংপুলের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট থেকে দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিতাম।
রাতের বেলা হোটেল থেকে সাগরের তোলা একটি ছবি।
মেক্সিকোর বাস অনেকটা বাংলাদেশের মত। আপনি হাত তুলে রাখলেই ওরা আপনাকে রাস্তার উপর থেকে বাসে তুলে নিবে আবার যেখানে নামতে চাইবেন সেখানেই নামিয়ে দিবে। তবে ভাড়া দেবার সময় সাবধান। আপনি একবার বাসে উঠলে যেখানেই নামুন না কেনো আপনার ভাড়া হচ্ছে ১২ পেসোস। আমাদের তিনজনের ভাড়া হচ্ছে ৩৬ পেসোস। কিন্তু আমি দুইবার বাস ড্রাইভারকে ৫০ পেসোসের একটা নোট দেওয়ার পর আমাকে শুধুমাত্র ২ পেসোস ফেরোত দিয়েছিল যেখানে দেওয়ার কথা ১৪ পেসোস। পরে আমাকে চেয়ে বাকি টাকা ফেরত নিতে হয়েছিল। এর পর থেকে আমি অবশ্য পকেটে সব সময় ভাংতি টাকা রাখতাম। বাসে উঠার পর গুনে গুনে ৩৬ পেসোস বাস ড্রাইভারের হাতে ধরিয়ে দিতাম। মেক্সিকোতে টেক্সিও অনেক কম দামে পাওয়া যায়। তবে উঠার আগে অবশ্যই দরদাম করে নিবেন নাহলে পরে ড্রাইভার উল্টাপাল্টা ভাড়া চেয়ে বসতে পারে। তবে বাসে চলাচল করলেই আপনার পকেটের টাকা বেশি সেইভ হবে। বাসে মাঝে মধ্যে কিছু মানুষ এসে গান শুরু করে দিতে পারে। চাইলে তাদের গান শুনার বিনিময়ে ৫/১০ পেসোস দিয়ে দিতে পারেন।
মেরিওট কেনকুন রেসোর্ট।
কেনকুনে একটি বিশাল শপিংমল আছে যেটার নাম হচ্ছে ফ্যাশন হারবার কেনকুন প্লাজা। বাসে উঠে ড্রাইভারকে বললেই সে আপনাকে নামিয়ে দিবে। মোটামুটি সবকিছুই পাওয়া যায় সেখানে। এছাড়া প্লাজার পিছনের দিকে সারি সারি রেস্টুরেন্ট রয়েছে যেখান থেকে আপনি খুব কম দামে অথেন্টিক মেক্সিকান ফুড খেতে পারবেন। টাকোস, নাচোজ ছাড়াও রয়েছে অনেক রকমের স্পাইসি ফুড। মেক্সিকানরা স্পাইসী খাবার খেতে খুব পছন্দ করে। মলের মধ্যে হাটতে থাকলে আপনার নজরে পরবে অনেক সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য। এছাড়াও রাস্তার পাশের দোকানে দেখবেন একুরিয়ামে মানুষ জন পা দুবিয়ে বসে আছে আর ছোটো ছোটো মাছ পায়ের চামড়া খেয়ে পা পরিস্কার করে দিচ্ছে। হঠাৎ করে দেখলাম প্লাজার মাঝখানে সুন্দরী নর্তকীরা এসে নাচানাচি শুরু করে দিছে।
এটা কিন্তু মেক্সিকান খাবার ছিলো না...
আমরা আমাদের সফরের তৃতীয় দিন মায়া মুজে কেনকুন নামক একটি জাদুঘরে যাই। মিউজিয়ামে ঢুকতে নাম মাত্র মূল্যে টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। এখানে মূলত দুইটা অংশ রয়েছে। প্রথম ভাগ আপনি গাছ গাছালির মাঝ দিয়ে হেটে যাবেন আর দেখতে পাবেন মায়ানদের তৈরী ঘরবাড়ি এবং উপাসনালয়ের ধ্বংসাবসেস। আর দ্বিতীয় ভাগে একটি এক্সিবিশন সেন্টারের ভিতর মায়ানদের ব্যবহৃত আসবাব পত্র, গয়না এবং তাদের তৈরি বিভিন্ন চিত্রকর্ম। বেশ ইন্টারেস্টিং। এখানে আপনি প্রচুর ইগুয়ানা বা গিরগিটি দেখতে পাবেন। মেক্সিকানরা কিন্তু ইগুয়ানাকে মুরগীর মত রান্না করে খায়। অবশ্য ইগুয়ানাকে মজা করে মেক্সিকান চিকেনো বলা হয়।
কেনকুনের সমুদ্রসৈকত
চতুর্থ দিন আমরা আগে থেকেই বুক করে রাখি চিচেন ইটজায় যাবার জন্য। সকাল ছয়টা বাজে ট্যুরের মাইক্রো বাস এসে আমাদের হোটেল থেকে নিয়ে যায়। আমাদের ট্যুর গাইড যে ছিলো সে খুব ভালো ছিলো। এতো সুন্দর ভাবে সব কিছুর বর্ননা দিয়েছে আমরা খুব অল্প সময়ের ভিতরেই চিচেন ইটজা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে ফেলি। আপনি চাইলে একা একা চিচেন ইটজায় যেটে পারেন তবে আমার উপদেশ থাকবে যদি প্রথম বার যাওয়া হয় তবে অবশ্যই ট্যুর গাইডের সাথে যাওয়া। কেনকুনের ট্যুরিস্ট এড়িয়া থেকে চিচেন ইটজায় যেতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় লাগে। প্রথম ঘন্টা আমরা ঘুমিয়েই পার করি আর দ্বিতীয় ঘন্টায় আমাদের গাইড ঐ জায়গার ইতিহাস আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চার্যের একটি হচ্ছে এটি। কি কারনে এটাকে সপ্তম আশ্চার্য হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে সেটা আমরা সেখানে যাওয়ার পরেই বুজতে পারি। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে যখন কিনা লোহার ব্যবহার শুরু হয়নি সে সময় কিভাবে এত উচু আর এত নিখুত স্থাপনা তৈরী করা হয়েছে তা আজো রহস্য। চিচেন ইটজা পিরামিডের গঠন প্রনালীতে গানিতীক বিভিন্ন সংকেত প্রকাশ করা হয়েছে। এই চিচেন ইটজা এবং মায়ানদের নিয়ে আলাদা একটি পোস্ট দেওয়ার ইচ্ছা আছে। কারন এখানে লিখতে গেলে এই লেখা আরো লম্বা হয়ে যাবে। আপনারা নিশ্চই জানেন যে মায়ানদের সময় কোনো মু্দ্রার প্রচলন ছিলো না। তার বিনিময় প্রথার মাধ্যমে লেনদেন করত। অর্থাৎ কারো কাছে যদি মাছ থাকে সে অন্যকে সেটা দিয়ে তার কাছ থেকে চাল নিবে। যেখানে এই লেনদেন হত সেটাও দেখা হয়েছে। যাই হোক সারাদিন ঘুরাঘুরি করে বিকালের দিকে আমাদের ট্যুর বাসে করে আমরা আমাদের হোটেল ফিরে আছি।
কেনকুন লেখাটির সাথে তোলা আমার একটি ছবি। ২০ মিনিট লাইনে দাড়িয়ে থেকে ছবি তোলার সুযোগ হয়।
ফিরে আসার আগের দিন অবশ্য আমরা সারাদিন হোটেল আর সুইমিংপুলেই কাটিয়ে দেই। কেনকুনে আসলে দেখার মত আরো অনেক কিছু আছে যা আমরা এই সফরে মিস করেছি। পরবর্তীতে গেলে যে জায়গা গুলো মিস করেছি সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। সবশেষে বলতে হয় কেনকুন আসলেই স্বর্গের মতই সুন্দর। কেনকুনের সৌন্দর্য এখনো চোখে লেগে আছে। শুধু সমুদ্রসৈকত আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয় বরং মায়ান সভ্যতার রেখে যাওয়া ধ্বংসাবসেস জায়গাটার আকর্ষন আরো কয়েকগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। কখনো যদি সুযোগ হয় তবে অবশ্য মেক্সিকো ঘুরে আসবেন। আজ তাহলে এ পর্যন্তই থাক। সবাই ভালো থাকবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৮ সকাল ৮:৫৫