আমার লালন-অধ্যয়নের অংশ হিসেবেই সংগ্রহ করি ইমাম আহমেদ নামের এক গবেষকের কথিত গবেষণাগ্রন্থ 'লালনের গান : আধ্যাত্মিকতার স্বরূপ' (২০০৯)। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, ইমাম আহমেদের দাবি মোতাবেক এটি তাঁর এমফিল অভিসন্দর্ভের গ্রন্থরূপ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রফেসর রাবেয়া খাতুনের তত্ত্বাবধানে এটি রচিত। বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে গবেষককে 'বাধিত করেছেন' প্রফেসর ডক্টর খালেদ হোসাইন, কবি ও ছড়াকার হিসেবে যিনি আমার অনেক প্রিয়। ওই গ্রন্থের এই গ্রন্থে 'লালনের আধ্যাত্মিক গানের শৈল্পিক উৎকর্ষ' (পৃ. ১৫১-১৬৯) নামের অধ্যায়ে 'আঙ্গিক ও ছন্দবিন্যাস' উপশিরোনামে প্রায় ৮ পৃষ্ঠার আলোচনা রয়েছে। অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে আমি ওই অংশে প্রবেশ করেছি। গবেষক যখন লেখেন, 'তিনি (লালন) গতানুগতিকভাবে পয়ার-ত্রিপদী-পাঁচালির একঘেঁয়ে চর্চা না করে আধুনিক বাংলা অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈচিত্র্যময় ব্যবহারে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।'-- তখন আমার মতো ছন্দানুরাগী পাঠক ওই বিশ্লেষণের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারে না। কিন্তু যতই এগোই, হতাশায় নুয়ে যাই।
গবেষক অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আলোচনা করেছেন শুরুতেই। সংজ্ঞার্থ ঠিক আছে। গবেষকের আবিষ্কার--'সাঁইজি তাঁর গানে অক্ষরবৃত্তের অন্তর্গত পয়ার-ছন্দের বৈচিত্র্য সাধন করেন (৮+৮)=১৬ মাত্রায়’ (পৃ. ১৬১)। এরপর নমুনা হিসেবে উদ্ধার করেন লালন-পঙ্ক্তি--
মানুষে মানুষ কামনা /সিদ্ধ কর বর্তমানে॥
খেলছে খেলা
বিনোদ কালা/
এই মানুষের তিন ভুবনে॥
বিশ্লেষকের মন্তব্য হচ্ছে, 'গানের প্রতিটি চরণ দু-পর্বে বিভক্ত এবং প্রতিপর্বের মাত্রা-সংখ্যা ৮'। কিন্তু আমাদের মতে, অক্ষরত্তৃত্ত ছন্দে হিসাব করলে ওই চরণের ছন্দোবিন্যাস দাঁড়ায়Ñ৯/৮/১০/১১। তাহলে গবেষক ‘প্রতিপর্বের মাত্রা-সংখ্যা-৮; পেলেন কীভাবে?’ এরপরে প্রশ্ন জাতে এই চরণগুচ্ছ কি অক্ষরবৃত্তের চাল গ্রহণ করেছে, নাকি স্বরবৃত্তের চাল গ্রহণ করেছে। আমরা জানি যে, আধুনিক বিচারপদ্ধতি লালনের অনায়ত্ত থাকারই কথা। কিন্তু তিনি সিদ্ধপুরুষ ছিলেন বলেই তাঁর বাণীর বিশ্লেষণে পৌরাণিক-আধুনিক সকল রীতিই প্রয়োগ করা যায়। আমার পর্যবেক্ষণ মোতাবেক, স্বরবৃত্ত ছন্দে বিশ্লেষণ করা যাক-
মানুষে মা/নুষ কামনা /সিদ্ধ কর/ বর্তমানে॥/ ৪+৪+৪+৪
খেলছে খেলা/ ৪
বিনোদ কালা/ ৪
এই মানুষের/ তিন ভুবনে॥/ ৪+৪
এখন দেখা যাচ্ছে স্বরবৃত্তে চার মাত্রার চালে বিশ্লেষণ করলে লালনের গানে কোনো ছন্দচ্যুতি ঘটে না। অক্ষরবৃত্তে পড়তে গেলে পর্বসাম্য ঠিক থাকে না। ভুলটা কি লালনের, নাকি বিশ্লেষকের? পাঠকই তা বিচার করতে পারবেন। দ্বিতীয় উদাহরণে কবি-ছান্দসিক মোহিতলাল মজুমদারের পয়ার-সম্পর্কিত উদ্ধৃতি টানা হলেও লালনের গানে তার প্রয়োগ-কুশলতা দেখাতে পারেননি। লালনের যে পদ তিনি অক্ষরবৃত্ত-পয়ার ছন্দের প্রমাণ হিসেবে দাখিল করেছেন, আসলে তা অক্ষরবৃত্ত-ই নয়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ক্ষেত্রেও গবেষকের বিশ্লেষণ ব্যাকরণ-সম্মত নয়। স্বরবৃত্তকে মাত্রাবৃত্তের চালে হিসেবে করলে কি লালনের গানের শৈল্পিক উৎকর্ষ খুঁজে পাওয়া যাবে? এতে যে গবেষক তাঁর অজান্তেই লালনকে খাটো করে তুললেন, তার জবাব কী হতে পারে? স্বরবৃত্ত ছন্দের দ্বিতীয় উদাহরণটিও স্বরবৃত্ত ছন্দের বলে মনে হচ্ছে না। গবেষক হয়তো পার পেয়ে যাবেন এই বলে যে, এটি তাঁর গবেষণা-অভিসন্দর্ভ, এবং তা অন্তত তিনজন প্রফেসর দেখে দিয়েছেন, তাই ভুলের দায় তাঁর একার নয়। আমাদেরও তেমন মনে হয়! এটি যদি গবেষকের ঐকান্তিক গবেষণা হতো, ধরে নিতাম যে অনিচ্ছাকৃত এই ভুল ঘটে গেছে। কিন্তু এটি তো দীর্ঘদিন ধরে প্রণীত একটি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা। তত্ত্বাবধায়ক মহোদয় প্রতিটি শব্দ দেখে ডিগ্রি দেয়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন। তার পর আরো নিঃসন্দেহে দুইজন বিজ্ঞ প্রফেসর তা মূল্যায়ন করেছেন। তাঁরাও এই ভুল বিশ্লেষণ এড়িয়ে গেলেন কীভাবে? আমি তো কেবল ছন্দের অংশ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছি। অলঙ্কার প্রয়োগ নিয়ে তিনি যে আলোচনা করেছেন, তার বিপত্তি নিয়ে আর কথা বলার ইচ্ছে নেই। এইসব যাঁদের দেখার দায়িত্ব পালন করেছেন, দেখার বিনিময়ে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত সম্মানী নিয়েছেন, সেই পরীক্ষক-অধ্যাপকেরাই যখন পার করিয়ে দিয়েছেন, ডিগ্রি দিয়েছেন, আমাদের তাতে করার কিছু নেই। ওটি ছিল পরীক্ষার খাতা। কিন্তু তা যখন মুদ্রিত আকারে জনসমক্ষে এল, তখন পাঠক হিসেবে আমার কথা বলার সুযোগ রয়েছে। আমরা জানি, অনেক অভিসন্দর্ভ ডিগ্রি পেলেও, তা প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয় না। এর ক্ষেত্রে তেমন কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল কিনা আমরা জানি না। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে পক্ষপাত দেখালে তা অশিক্ষকসুলভ আচরণ হয়, তাহলে ভুল তথ্যে ডিগ্রি দিলে কি অশিক্ষকসুলভ আচরণ হয় না? এতে কি তত্ত্বাবধায়কের অযোগ্যতা প্রমাণিত হয় না? এ বিষয়ে ডিগ্রিদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং তত্ত্বাবধায়ক মহোদয়ের বক্তব্য উচ্চতর গবেষণার খাতিরেই প্রকাশ করা জরুরি বলে বিবেচনা করি। অভিসন্দর্ভটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ফলে, অনেক পাঠক যে বিভ্রান্ত হতে পারেন, ভুল তথ্য জানতে পারেন, তার দায় কে নেবে? ভুল বিশ্লেষণের বই পাঠকের হাতে যেতে দেয়া কি ঠিক হচ্ছে? লেখক এবং প্রকাশক র্যামন পাবিলার্শ এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন। কষ্ট করে ডিগ্রি নিলেন, ভুল বিশ্লেষণ করে বাঘা-বাঘা অধ্যাপকের স্বীকৃতি নিলেন, তাতে আমাদের আপত্তির সুযোগ নেই। কিন্তু ওই অভিসন্দর্ভ গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময়ও যখন লেখক সচেতন হলেন না, তখন পাঠক হিসেবে আমরা তাঁর কৃতিত্বকে অস্বীকার করার অধিকার রাখি। বলে রাখা ভালো, লেখকের সঙ্গে আমার ব্যাক্তিগত পরিচয় নেই। তবু সত্যের খাতিরে এই অপ্রিয় কথাগুলো না বলে স্বস্তি পাচ্ছি না। আশা করি বইটি সংশোধিত আকারে কিংবা ছন্দ-অলঙ্কার অংশ বর্জন করে বাজারে ছাড়া হবে। তাতে পাঠক হিসেবে আমরা বাধিত হবো।
তপন বাগচী