ছোটবেলায় চুল কাটাতে চাইতাম না। কানের কাছে চুল আসতে না আসতেই আব্বা চুল কাটানোর জন্য বলা শুরু করতো। আব্বা চুল কাটার স্টাইল বলতে আর্মি কাটিং বুঝতো। এর ব্যাত্যয় সে কোন ভাবেই মেনে নিবে না। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল কোন ভাল ছেলের চুল বড় থাকতে পারেনা। আব্বার আরও কিছু বিশ্বাস ছিল যেমন ভাল ছেলেরা জিন্সের প্যান্ট পরেনা! এবং কোন ভাল মানুষের দুইটা সিম কার্ড থাকতে পারেনা।
শুক্রবার আসলেই সকালে বাজারে যাওয়ার সময় আব্বা জোর করে নিয়ে যেত চুল কাটাতে। রাগে,দুঃখে শেষে আবদার করতাম যেন আমাকে অবশ্যয়ই একটা টেনিস বল কিনে দেয়া হয় চুল কাটানোর পর। বলের নাম ছিল এ্যারোপ্লেন। বলটি সাধারণত সবুজ হতো। সেই বলে একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ ছিল। যতদূর মনে পড়ে বলের দাম ছিল ১৮ টাকা। খেলা শুরু করার আগে বলটি নাকে নিয়ে শুকতাম বেশ কিছুক্ষণ।
যাইহোক, চুল কাটাতে দিয়ে আব্বা জলিল কাকার চায়ের দোকানে বসতো। ছিদাম নামে আমাদের বাজারে নাপিত আছে,সেই আমাদের পারিবারিক নাপিত ছিল। সম্ভবত এখন আর তার দোকান জমজমাট না। তবে তার মত দেশ সম্পর্কে সচেতন মানুষ কম দেখেছি। প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন লোক। জনকণ্ঠ পেপার তার মুখস্থ থাকতো। উনার সাথে আমার একটি মজার ঘটনা আছে। যখন আরও ছোট ছিলাম মানে স্কুলে তখনও যাই নাই।তখন আমরা পুরাতন বাড়ীতে থাকতাম, সেটা পাসের গ্রামে। উনি তখন আমাদের বাড়ী এসে চুল কাটিয়ে দিয়ে যেতেন। আমাকে দৌড়ে ঝাপটে ধরে চুল কাটিয়ে দিতেন। এমনি একদিন সবাই মিলে ধরে জোর করে চুল কাটিয়ে দিচ্ছেলেন আর আমি উনাকে রাগ করে বলছিলাম "আপনাকে আর আপনার নানীকে কূপে (আমরা বলতাম কুয়া)ফেল দেব!" সেই গল্প বড় হওয়ার পরেও চুল কাটাতে গেলে সবাইকে আমার সামনে বলতেন হেসে হেসে। ক্লাস নাইন-টেন পর্যন্ত উনার কাছে চুল কাটিয়েছি। লোকটা খুব ভাল একজন মানুষ। ভাবছি বাড়ী গেলে উনার দোকানে যাব একবার চুল কাটাতে। দেখবো এবার সে ওই গল্প করে কিনা।যদি যাই তবে তা হবে প্রায় ষোল বছর পর যাওয়া। উনার কি আব্বার সেই ছোট করে চুল কাটিয়ে দেয়ার কথা মনে আছে?
চুল কাটা শেষে জলিল কাকার চায়ের দোকানে বসে থাকা আব্বা কে দেখাতে যেতে হত ঠিক আছে কিনা সার্টিফিকেট নিতে! খুব কম বারই পাস করতাম একবারে! মানে আব্বা বলতো সামনে তো চুল এখনও বড়! অথচ বিশ্বাস করেন একদম ছোট থাকতো। তারপর আবার হাত ধরে নিয়ে যেয়ে এবার বসে থেকে আমার সবকটি চুল রিমান্ডে নেয়ার মত করে কাটিয়ে ছাড়তো। সেটাকে আর কোন হেয়ার স্টাইল বলা যেতনা। ছিদাম কাকাও নিখুতভাবে আব্বার ইচ্ছে বাস্তবায়ন করতো।
তারপর বড় হওয়ার পরেও, আর বড় করে চুল রাখা হয় নাই। এখন চুল বড় হলেই মাথা ব্যাথায়। এসএসসি দেয়ার পড়ে কলেজে পড়ার সময় রাজশাহী থেকে বাড়ী এলে আব্বা সকালে ঘুম থেকে উঠে বলতেন শার্টের পকেটে টাকা আছে চুল কেটে এসো আজ।
গত তিন মাস হল চুল কাটা হয় না। প্রায়ই মাথা ব্যাথায় প্রচন্ড। প্রতিদিনই ভাবি আজ কাটবো। চুলে কান ঢেকে গেছে প্রায়। এবার মে মাসে আব্বার মৃত্যুর দশ বছর পূর্ণ হবে। কেন যেন মনে হচ্ছে সকাল হলেই আব্বা বলবে পকেটে টাকা আছে আজ চুল কেটে এসো আব্বা। (আমার আব্বা আমাকে আব্বা বলে ডাকতেন আদর করে)।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ২:০৮