নিজের লাভ না থাকলে আমি সচরাচর বাজারে যাই না। কিন্তু আব্বার সাথে বাজারে গেলাম সেদিন। উদ্দেশ্য মাছের রাজার সাথে সাক্ষাত্ করা এবং দুয়েকজনকে বাসায় নিয়ে আসা। বলে রাখা ভাল, আমি ঢাকার বাইরে থাকলেও আমাদের এলাকাকে একটা ছোটখাট উপশহরের সাথে তুলনা করা যায়। তো সেই এলাকার মাছের বাজারটাও কম বড় না! কিন্তু পুরো সকাল ঘুরেও কোন ইলিশের দেখা পেলাম না। ক্লান্ত হয়ে যখন বাসায় ফিরছি তখন একজনের কাছে ইলিশের পেলাম। তবে সেগুলোকে ইলিশ না বলে জাটকা বলাই ভালো। পিচ্চি পিচ্চি সাইজ। তার উপর দেখে মনে হচ্ছে এগুলো পদ্মার না, বার্মা থেকে আনা হয়েছে। যেই বয়সে তাদের পানিতে জলকেলি করার কথা সেই বয়সে তারা মানুষের পেটে যাওয়ার জন্য রেডী হয়ে গেছে। দেখে আফসুস লাগলো। ভাবলাম নিয়ে যাই একহালি। কিন্তু দাম শুনে চারবার টাশকি খেলাম। চারটা জাটকা পরপর রাখলে মনে হয় না বিশ ইঞ্চি লম্বা হবে। অথচ এদের দাম নাকি দুই হাজার টাকা, তার মানে প্রতিটা পাঁচশ টাকা করে। (বুঝতে পারছেন তো আমি অংকে ভাল )
থাক সে কথা, এবার বলি আমার জীবনে প্রথম ইলিশ কেনার কথা। বেশিদিন আগের না, গত বছরের কথা। আমার প্রথম টিউশনি, ক্লাশ ওয়ানে পড়া বাচ্চাকে পড়াতে হবে। বাচ্চা ভয়ংকর, কাচ্চা ভয়ংকর। বহু কষ্টে ঐ পিচ্চিকে নিয়া একমাস পার করলাম। মাস শেষে পিচ্চির নানু এসে আমার হাতে একটা সাদা খাম ধরিয়ে দিল। জীবনের প্রথম কামাই। পিচ্চিরে আইপি সহ ব্যান করে বাসায় এসে খাম খুললাম। দুইটা পাঁচশ টাকার নোট। পরদিন গেছি আড্ডা দিতে। এক লোক আসলো মাথায় বিরাট এক ঝাঁকা নিয়া। ঝাঁকায় কি? ইলিশ মাছ। নামাও, দেখি। দেখা শেষে কিনে ফেললাম একজোড়া, মাত্র পাঁচশ টাকা দিয়া। মাছগুলা ওজন দিয়া দেখলাম প্রতিটা এক কেজি চারশ গ্রাম। প্রায় তিন কেজি ইলিশ কিনেছিলাম মাত্র পাঁচশ টাকায়। আরে ভাই তখন অফ সিজন ছিল তাই এত সস্তায় কিনতে পারছিলাম।
ব্যাপারটা গত পাঁচ ছয় বছর ধরে চলছে। প্রতিবছর রমজানের আগে আগে আশেপাশের কয়েক বাসায় ইলিশ কিনে আনা হয়। যে সে ইলিশ না, একেবারে চাঁদপুর থেকে কিনে আনা পদ্মার ইলিশ। আব্বু সহ আরো চার পাঁচজন আঙ্কেল দিন ঠিক করে চাঁদপুর চলে যায়। আগে থেকেই মাইক্রোবাস ভাড়া করা থাকে। সেটাতে চড়েই যায়। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। সবাই মোটামুটি ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কেজি ইলিশ নিয়ে বাসায় আসে। আত্মীয় স্বজন কে দেওয়া হয় কয়েক কেজি। হয়ত শেষ পর্যন্ত হয়ত থাকে বিশ কেজির মত। মাছগুলোর পেট কেটে নাড়িভূড়ি বের করে ধুয়ে ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়। এতে মাছটা পঁচে না। অনেকদিন ভালো থাকে।
এবার বলি পহেলা বৈশাখে এক ফাইজলামীর গল্প। আমার স্মৃতিতে পহেলা বৈশাখ নিয়ে তেমন কোন মজার ঘটনা নেই। এর বড় কারণ প্রায় সব সময়ই এই দিনে আমার শরীর খারাপ থাকে, যার কারণে আমি বাইরে যেতে পারি না। যেমন এ বারের পহেলা বৈশাখও আমার ঘরে বসেই কাটাতে হবে। এস,এস,সি পরীক্ষার পরে এক পহেলা বৈশাখে আমি ঘুরার সুযোগ পেলাম। আমাদের এলাকায় অনেকগুলা কিন্ডার গার্ডেন স্কুল আছে। তার মধ্যে একটা পান্তা-ইলিশের আয়োজন করল। আমরা সারা সকাল এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করে ঢুকে গেলাম সেখানে। মাটির সানকিতে পান্তা ভাত, তিনরকমের ভর্তা আর পিচ্চি সাইজের এক পিস ইলিশ। যাক, আমরা একটু দুর্নীতি করে আরেক পিস ইলিশ জোগাড় করলাম। খাওয়া শেষে বের হতে গিয়া দেখি টাকা চায়। খাইছে, অল্প স্বল্প না, পুরা তিনহাজার। আমরা মানুষ পাঁচজন। খাইছি দশ টুকরা মাছ। টাকা চায় তিনহাজার। কেম্বে কী?
এক ফ্রেন্ড বুদ্ধি কইরা গিয়া ঝাড়ি মারল, "ঐ মিয়া, আপনে যে জায়গায় স্কূল বানাইছেন ঐ জায়গার মালিক আমার আপন বড় ভাই। আর আপনে আমার কাছে টাকা চান?" ঐখান থেকে বের হয়ে তারে ধরলাম, "আসলেই কি মালিক তোর বড় ভাই?" "আরে ধুর! আমি কাওরে চিনি না।"
আবার ইলিশের কথায় আসি। ইলিশকে কেন মাছের রাজা বলা হয়? অভিজ্ঞ রাধুনীরা হয়ত ইলিশ কাটার সময় খেয়াল করে থাকবেন, এর পিঠের দিকে দুই পাশে চিকন সুতার মত দুইটা সাদা দাগ। ব্রাহ্মণরা হিন্দুদের মাঝে উচু জাত, তারা পৈতা পড়ে। তেমনি ইলিশের এই দুইটা দাগকে পৈতার সাথে তুলনা করা যায়। তাই ইলিশকে মাছের রাজা বলা হয়। তাছাড়া ইলিশের স্বাদ ও গন্ধ
তো আছেই।
ইলিশ কিন্তু খুব নরম স্বভাবের মাছ। এরা পানির অনেক গভীরে থাকে। সূর্যের আলোতে আনার সাথে সাথে এরা মারা যায়। আরেকটা জিনিশ, ইলিশ মাছ সেদ্ধ করা তেমন কোন কঠিন কাজ না। মধ্যদুপুরের কড়া সূর্যের তাপে রেখে দিলেও ইলিশ মাছ সেদ্ধ হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ৮:০০