সম্প্রতি দেশের মিডিয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলোকে স্পষ্টতই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বিকল্প মিডিয়ার ব্যবহারকারীরা। বিকল্প মিডিয়ার ব্যবহারকারী মানেই দেশের সাধারণ জনগণ। মূলধারার মিডিয়ায় যেসব মানুষের অ্যাকসেস নেই তারাও হতে পারে বিকল্প মিডিয়া প্রভাব বিস্তারকারী। এমনিতেই মূলধারার মিডিয়া ও বিকল্প মিডিয়ার বিতর্ক গত কয়েক বছরে মিডিয়া স্টাডিজের আলোচনার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মূলধারার মিডিয়া যখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, মালিকপক্ষের স্বার্থসহ নানা কারণে সঠিক সংবাদটি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, ঠিক তখনই দৃশ্যপটে হাজির হচ্ছে ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোর মতো বিকল্প মিডিয়া। বাংলাদেশে মূলধারার মিডিয়াকে বিকল্প মিডিয়া এর আগেও নানা সময় ছোটখাটো ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ জানালেও এবারই প্রথম এতটা সাহস নিয়ে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার ব্যাপারে বিকল্প মিডিয়া আলাদা ও শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। মিডিয়া স্টাডিজ নিয়ে যাদের আগ্রহ রয়েছে তাদের কাছে গবেষণার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। তবে মূলধারার মিডিয়া কর্মী এবং বিকল্প মিডিয়াগুলোর প্রথম জেনারেশন ব্যবহারকারী হিসেবে আমি কিছু বিষয়কে সামনে আনতে চাই। মূল ও বিকল্প মিডিয়ার সাম্প্রতিক বিরোধের জায়গাটি হলো ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা। গত কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন ব্লগ এবং ফেসবুকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনেকেই অভিযোগ জানাচ্ছিলেন, তাদের আন্দোলনের খবর মিডিয়াগুলো ঠিকভাবে জানাচ্ছে না, আন্দোলন নিয়ে অনেক ধরনের বিভ্রান্তিকর খবর ছাপানো হচ্ছে কিংবা দেখানো হচ্ছে, খবরের ধরন এমন হচ্ছে যা পরোক্ষভাবে ধর্ষক পরিমলের পক্ষেই যায়। এই আন্দোলনকারীরা এই সমাজেরই অংশ, বয়সে তরুণ এই আন্দোলনকারীরাও বিভিন্ন মিডিয়ার ভোক্তা। মিডিয়ার দায়িত্ব যেখানে জনমানুষের অনুভূতিকে সম্মান জানিয়ে সত্যের পক্ষে কলম ধরা এবং মিথ্যাকে চিহ্নিত করে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা সেখানে ভোক্তা হিসেবে এই মানুষদের মিডিয়ার প্রতি আলাদা চাহিদা থাকে, আলাদা প্রত্যাশা থাকে। মিডিয়া যখন সেই চাহিদাকে অনুবাদ করতে ব্যর্থ হয় কিংবা কোনো কারণে করতে চায় না, তখন ওয়াচডগ হিসেবে এই মানুষেরাই বিকল্প প্লাটফর্মের সন্ধান করে। গত কয়েক বছর ধরে এই বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ব্লগ এবং সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঘটনায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনের সংবাদ প্রচারের জন্য বেছে নিয়েছে ব্লগ, ফেসবুক, গুগল প্লাসের মতো বিকল্পধারার মিডিয়াকে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কেবল মূল মিডিয়ার ওপর নির্ভর না করে নিজেদের খবর নিজেরাই জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে। গত ১৫ জুলাই জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুকে একটি কমিউনিটি পেজ খুলেছে শিক্ষার্থীরা। 'ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া প্রকৃত ঘটনা' [www.facebook.com/vnsc.update] নামের কমিউনিটি পেজটি খোলার উদ্দেশ্য হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানাচ্ছে- 'মিডিয়া বিভ্রান্তি দূর করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমরা চাই সবাই সত্য জানুক।' তারা আরও জানাচ্ছে, 'ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখায় শিক্ষক নামধারী পশু পরিমল জয়ধর কর্তৃক ছাত্রী নিপীড়নের পর তার বিচার এবং পরিমলকে সমর্থনকারী অধ্যক্ষ হোসনে আরার পদত্যাগ দাবি করে প্রতিষ্ঠানটির অস্থির অবস্থার কথা সবার জানা। কিন্তু মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত কিছু ভুল ও অসত্য সংবাদ পরিবেশিত হওয়ায় অনেকেই বিভ্রান্ত। সবার এই বিভ্রান্তি দূর করতেই আমাদের এই কমিউনিটি পেজ। পেজটি ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত। জুনের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত কী ঘটছে, জানতে চোখ রাখুন আমাদের পেজের নোট, ফটো অ্যালবাম ও ওয়ালে।' নিউ মিডিয়ার একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে ওই কমিউনিটি পেজটির দিকে লক্ষ্য রাখছিলাম। দেখলাম মাত্র একদিনের মধ্যেই কমিউনিটি পেজটি ৫ হাজারের বেশি লোক পেয়ে গেছে, যারা এটি পছন্দ করেছেন। তার মানে ৫ হাজার সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী নিয়মিত এই কমিউনিটি পেজটি অনুসরণ করছেন। এই ৫ হাজার ব্যবহারকারীর মাধ্যমে তাদের ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা আরও হাজার হাজার লোক এই পেজের পোস্ট সম্পর্কে জানতে পারছেন। প্রতিনিয়তই অনুসরণকারী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে এই কমিউনিটি পেজটির মিডিয়া ভ্যালু এখন অনেক বেশি।
বলতে দ্বিধা নেই, ওই কমিউনিটি পেজটির মাধ্যমে বিকল্প মিডিয়া মূলধারার মিডিয়াগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এর প্রভাব নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী। পুরনো প্রশ্নটি আবারও প্রবলভাবে সামনে এসে উপস্থিত। তাহলে কি বিকল্প মিডিয়ার উত্থান মূলধারার মিডিয়ার জনপ্রিয়তাকে হুমকির মুখে ফেলবে? সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পর্যবেক্ষক হিসেবে একটা ব্যাপারে বলে রাখতে পারি, জনপ্রিয়তাকে কতটা হুমকির মুখে ফেলবে সেটি সময়ই বলে দেবে, তবে বিকল্প মিডিয়াগুলো যে এখন শক্তিশালী অবস্থান করে নিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই বিকল্প মিডিয়া কেবল সংবাদ প্রচারের জায়গা হয়নি, পাশাপাশি অ্যাকটিভিজমের জায়গাও হয়ে উঠেছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তরুণ সমাজ সবচেয়ে বেশি প্রচারণা চালিয়েছে ব্লগ আর ফেসবুকে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটি ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ছিল_ এটি প্রায় সব রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেনে নিয়েছেন।
ফেসবুক গত এপ্রিলে সাংবাদিকদের জন্য একটি বিশেষ পেজ খোলে। মূলধারার সংবাদপত্রগুলোর সাংবাদিকরা সংবাদ উৎস হিসেবে ফেসবুকের ব্যবহার করছেন এমন বক্তব্যকে সামনে রেখেই ফেসবুক এই পেজ খোলে। শুরু থেকেই পেজটির দিকে লক্ষ্য রাখছিলাম। কিছুদিন আগেই দেখলাম ওয়াশিংটন পোস্ট, গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকাগুলো সংবাদপত্রে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার খবরকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেই বিবেচনায় ভিকারুননিসার সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে আমাদের মূলধারার মিডিয়াগুলো দুটি বিষয়ে ধারণা নিতে পারে। এক. কোনো স্বার্থের কারণে কিংবা চাপে সঠিক সংবাদ প্রকাশ না করলে মিডিয়ার ভোক্তারা বিকল্প মিডিয়াতে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেই। দুই. গণমানুষের সেন্টিমেন্টকে বুঝতে হলে মূলধারার মিডিয়াগুলোকে বিকল্প মিডিয়াগুলোর দিকে নজর রাখতে হবে।
আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা মূলধারার সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল দেখে অনেক সময়ই সিদ্ধান্ত নেন কিংবা পরিবর্তন করে থাকেন। কিন্তু এসব সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের মতের বাইরেও সাধারণ মানুষের ভিন্ন কোনো মত থাকতে পারে। সেই ভিন্ন মতগুলোই উঠে আসে ব্লগ, ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস আর ইউটিউবের মতো বিকল্প মিডিয়াগুলোতে। তাই মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে বুঝতে হলে সংবাদপত্র পড়া ও টিভি চ্যানেল দেখার পাশাপাশি বিকল্প মিডিয়াগুলোও পড়ে দেখা উচিত দেশের নীতিনির্ধারকদের।
লেখাটি গত ১৭ জুলাই ২০১১ দৈনিক সমকালের সম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হয়েছিল (Click This Link)। লেখাটার ব্যাকআপ রাখার জন্য ব্লগে পোস্ট করে রাখলাম।