হঠাৎ করেই পড়ালেখার ব্যস্ততা বেড়ে গেল। এক হিসাবে ভালোই হয়েছে, বিকালটা পড়ালেখার ব্যস্ততায় কাটছে। কোন কোন বিকালে ছাত্রীকে পড়াতে যাই। সেইটাও অনিয়মিত হয়ে গেছে। ছাত্রীর মা একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল। জবাবে পড়ালেখার ব্যস্ততার কথা বললাম। এর মধ্যেই বাড়ি থেকে চিঠি আসলো। চিঠি পেয়ে প্রথমে খুব অবাক হলাম। অনেকদিন ধরে চিঠি পাই না। চিঠি হাতে নিয়ে স্মৃতিতাড়িত হলাম। একটা সময় ছিল, আমি প্রচুর চিঠি লিখতাম। রেডিওতে অনুষ্ঠান শুনে চিঠি পাঠাতাম। আর রেডিওতে তা পড়ে শুনালো হলো কিনা তার খেয়াল রাখতাম।কি অদ্ভুত রকমের শখ ছিল তখন। এবারের চিঠির উপরে মেয়েলি হাতের গোটা গোটা অক্ষরে আমার বর্তমান বাসার ঠিকানা লেখা। হাতের লেখা দেখেই বুঝলাম এসব ছোটবোনটার কাজ। চিঠি খুললাম বেশ আগ্রহ নিয়ে। একগাদা অভিযোগ করেছে ছোটবোনটা। সঙ্গে যোগ হয়েছে ছোট ভাইটাও। বোনটা ক্লাস সেভেনে পড়ে, ভাইটা পড়ে ক্লাস ফোরে। তাদের অভিযোগ তাদেরকে আমি ভুলে গেছি। একবারও দেখতে যাই না কেন এই নিয়ে তাদের যুথবদ্ধ ক্ষোভ। চিঠিটা পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বাড়িতে যাবো। ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিনের ক্লাস বন্ধ আছে। সেই সুযোগটা বরংচ কাজে লাগানো যাক।
গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলাম এক মধ্যদুপুরে। গ্রামে শীতের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। বেশ কিছু বাড়ির উঠানে লোকজন রোদ পোহাচ্ছে দুপুরের গোসল শেষে। কেউ কেউ আবার ঠান্ডা থেকে বাঁচতে উঠানে আলাদা কাঠ রেখে রোদের মধ্যে গোসল করছে। কোন কোন বাড়ির উঠানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কুশলাদি জিজ্ঞেস করছে। কেউ কেউ আবার বসে গল্প করে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। গ্রামের এই এক সুবিধা বাড়ি অনেক দুরে হলেও লোকজন চিনতে পারে। বড়জোর না চিনতে পারলে বাবা কিংবা দাদার নাম জিজ্ঞেস করে।
বাড়ির উঠান নিয়ে প্রবেশ করার সময় লক্ষ্য করলাম ছোট দুই ভাইবোন সেখানে বসে আছে।আমাকে দেখতে পেয়েই হাসিমুখে দৌড়ে এলো তারা। কে ব্যাগটা ধরবে এ নিয়ে দুইজনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। অবশেষে দুইজনেই ব্যাগ ধরে ভিতর বাড়িতে নিয়ে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে মাকে পাওয়া গেল। আগুনের উত্তাপের পাশে বসে রান্না করছেন। বাবা গ্রামের হাটে গেছেন।
রাতে সবাই একসাথে খেতে বসলাম। রাজ্যের গল্প শুরু হলো তখন। গ্রামের কে কি করছে, কে কেমন আছে, যাবতীয় কাহিনী। আগ্রহ নিয়েই শুনতে লাগলাম। ছোট দুই ভাইবোনের কথা শুনে বুঝতে পারলাম তারা ভালোই খোঁজখবর রাখে। এক পর্যায়ে মা জিজ্ঞেস করলেন-
“ঢাকায় তুই ঠিকমতো চলতে পারিস তো বাবা? বাড়ি থেকে টাকা নেস না। সমস্যা হয় না তোর?”
আমি মাথা নেড়ে না বললাম।
বাবা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- “সমস্যা হলে বলিস। টাকা কোন না কোন ভাবে ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে।”
আমি কিছু না বলে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কেবল! আমিতো জানি, উনি কতোটা কষ্ট করে পরিবারের খরচ চালাচ্ছেন! ছোট দুই ভাইবোনের খরচ,বাজার সদাইয়ের খরচ সবকিছু বাবাকেই যোগাড় করতে হয়। তারপরেও তিনি আমাকে টাকা ব্যবস্থা করে দিবেন বলেছেন, এটুকু শুনেই ভালো লাগায় মন ভরে গেল। জানি ছেলে হিসাবে বাবার কাছ থেকে পড়ালেখার খরচ চাইতেই পারি, তবুও কিছুটা বড় হয়ে যাওয়ার দায়িত্ববোধ এড়ানোর ইচ্ছা হলো না।
খাওয়া শেষে দুই ভাইবোনকে নিয়ে গল্প করতে বসে গেলাম। তারা দুইজনেই বেশ আনন্দিত। অনেকপর পর এভাবে তিন ভাইবোন মিলে একসাথে গল্প করছি। পড়ালেখার কথা জিজ্ঞেস করতেই, ছোট ভাইটা বললো-
“ভাইয়া, গ্রামের কয়েকটা ছেলে আপুর স্কুলে যাওয়ার সময় রাস্তায় দাড়িয়ে থাকে। আজেবাজে কথা বলে।”
কথাটা শুনে থমকে গেলাম। গ্রামেও তাহলে ইভ টিজিং শুরু হয়ে গেছে! বোনের দিকে চেয়ে থাকলাম। সে আমার দিকে তাকাচ্ছে না। সাহস দেওয়ার জন্যই বললাম-
“আচ্ছা, এইবার বিষয়টার একটা বিহিত করেই তবে শহরে ফিরবো।”
বলার দৃঢ়তা দেখে বোন আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার চাহনী দেখে বুঝতে পারলাম সে কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছে। কতোটা কি করতে পারবো জানি না। তবে বড় ভাই তার সমস্যার সমাধান করতে কিছু একটা করবে এমনটা ভেবেই হয়তো সে নিশ্চিন্ত বোধ করছে।
বেশ কিছুদিন বাড়িতে কাটিয়ে ফিরে আসলাম শহরে। ছাত্রীর পরীক্ষা সামনে, দায়িত্ববোধ থেকেই তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হলো।ফিরে এসে ছাত্রীর বাসায় প্রথম যেদিন পড়াতে গেলাম কাকতালীয় ভাবেই ঐদিনই ছিল আমার জন্মদিন। পড়ানোর রুমটাতে গিয়ে বাসার কিছুক্ষণ পর ছাত্রী আসলো। সঙ্গে দুইটা প্যাকেট। একটা প্যাকেট খোলার পর বেরিয়ে আসলো বার্থডে কেক। আরেকটা প্যাকেট ছাত্রী নিজের কাছেই রেখে দিল। এসব কার্যকলাপ দেখে কিছুটা অবাক হলেও উপভোগ করতে লাগলাম। জন্মদিন নিয়ে কখনোই আমার মাতামাতি ছিলনা। কখন জন্মদিন আসতো,আবার চলে যেতো হিসাবই রাখতাম না।বার্থডে কেকও খুব বেশি কাটা হয়নি। কেক কাটা শেষে বড় একটা অংশ আমাকে দেওয়া হলো। আগ্রহ নিয়ে খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষে খেয়াল করে দেখলাম ছাত্রী আমার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টিটার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম মায়াভরা দৃষ্টি।
জন্মদিনটা অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক একটা দিন মনে হয় আমার কাছে। তবে ছাত্রী মনে রেখেছে জন্মতারিখ এবং সেই অনুযায়ী বার্থডে কেক এনে সেলিব্রেশন করার ব্যবস্থা করেছে। মনে মনে খুশি হলাম খুব। কিন্তু এই খুশি ভাবটা দেখালাম না ছাত্রীকে। মানুষের সাইকোলজি কতো যে ব্যতিক্রমী! উচিত ছিল ছাত্রীকে ধন্যবাদ দেওয়া। কিন্তু এটাও ইচ্ছা করেই দেওয়া হলো না। ছাত্রীর হাতে তখনো আরেকটা প্যাকেট। বাহারী রঙের কাগজ দিয়ে মোড়ানো। কি থাকতে পারে তাতে তাই চিন্তা করছি। পড়াতে আসছি অথচ ছাত্রীর আয়োজন দেখে মনে হলো না তার পড়ার মুড আছে। মা বাবা গেছে তাদের আত্বীয়ের বাসায় বেড়াতে। সেই সুযোগে ছাত্রী এতো কিছু করতে পেরেছে।
“আজকে পড়বে না? বই খাতা কোথায় রাখছো?”
“আজকের দিনটাতেও পড়তে হবে! না পড়লে হয় না? সবদিনই তো পড়ি।”
ছাত্রীর কথা শুনে চুপ করে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম-
“পড়বে না যেহেতু তাইলে আমি আজকে যাই।”
এবার নড়েচড়ে বসলো ছাত্রী। কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। তারপর আবার বললো- “আচ্ছা, পড়বো আজকে। আমি সবকিছু ঠিক করে আসতাছি।”
বলেই মন খারাপ করে পাশের রুমে চলে গেল। বেশ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পুনঃরায় আসলো সে। চোখ খানিকটা ফোলা। তবে কি মেয়েটা কেঁদেছে! এতো অল্পতে কেঁদে ফেললে তো এই মেয়ের কপালে ভবিষ্যতে দুঃখ আছে!
“আজকে পড়াবো না। সবদিনই তো পড়াই। আজকে না পড়ালে কি হবে!” আমি বললাম।
এবার ছাত্রী কোন কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো কেবল।চুপ করে থাকা দেখে কথা না বাড়িয়ে পড়ানো শুরু করলাম। পড়ানো শেষ করে উঠতে যাবো এমন সময় ছাত্রী আমাকে বাকি প্যাকেটটা ধরিয়ে দিল।
“এইটা কি! এর মধ্যে কি আছে!”
“স্যার এইটা আপনার জন্য। আপনার বার্থডে গিফট।”
নিবো না নিবো করে নিয়ে ফেললাম। একবার নিয়ে ফেলেছি যেহেতু ফেরত তো আর দেওয়া যায় না।
“আপনাকে একটা অনুরোধ করি? পরেরবার যখন পড়াতে আসবেন তখন কি এই শার্টটা পড়ে আসবেন?” ছাত্রী বললো।
কথা না বাড়িয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পড়লাম। ইচ্ছা করলে বলতে পারতাম ঠিক আছে পরেরবার যখন তোমাদের বাসায় আসবো তখন তোমার গিফট করা শার্ট পড়ে আসবো। এমনটা বললেই মেয়েটা খুশি হতো। কেন জানি খুশি করার ইচ্ছা হলো না। এইটা কি একধরনের মাইন্ড গেম!মানুষের মন কি তবে দ্বৈত সত্ত্বার! একটা সত্ত্বা খেলায়, আরেকটা কেবল ভাবায়। একটা সত্ত্বার উপর মানুষের কোন নিয়ন্ত্রন নেই, আরেকটা মানুষকে নিয়ন্ত্রনের ভাবনা দেয়!
ছাত্রীর বাসা থেকে বের হয়ে চলে রাস্তায় এলোমেলোভাবে হাটতে লাগলাম। হাতে ছাত্রীর দেওয়া গিফটের প্যাকেটটা। প্যাকেটের ভিতরে শার্ট। আমি প্রায় সময়ই একটা শার্ট পড়ে টিউশনীতে যাই, এইটা দেখেই ছাত্রী শার্ট গিফট করার চিন্তা করলো। বিষয়টা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। শার্টের ক্ষেত্রে আমার বিকল্প থাকে না । আরেকটা সাইকোলজি হলো, একটা শার্ট পছন্দ হয়ে গেলে সেটাই সারা সপ্তাহজুড়ে পড়ি। সন্ধ্যা নেমে এসেছে তখন। অবন্তীদের বাসার সামনে দিয়ে ফেরার সময় থমকে দাড়ালাম। একমাসেরও বেশি সময় হয়ে গেছে। এখনো তারা ফিরে আসেনি। মোবাইল ফোনে কথা বলার বিষয়ে বলেছিল অবন্তী। সেটাওতো হলো না!
পরের আরো কয়েকটা বিকাল সন্ধ্যা বানিয়ে দিলাম ছন্নছাড়াভাবে হাটাহাটি করে। রোজনামচার বিকালের অংশটার পরিবর্তনটা খুব করে উপলব্ধি করলাম শেষ বিকালে হাটতে হাটতে।রাতে দেরি করে বাসায় ফিরি।রাত নামলেই মনে হয় হয়তো অবন্তী ফোনকল করবে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। এর পিছনে হয়তো যুক্তিসই কোন কারণ আমি দেখাতে পারবো না। এই যে ফোনকলের জন্য জেগে থাকা এটাও অনেকের কাছে পাগলামি মনে হতে পারে। এমনতো না যে, অবন্তীর সাথে আমার এমন সম্পর্ক, সবকিছু সে আমাকে জানাবে, সবকিছু আমার সাথে শেয়ার করবে। সম্পর্কের মাত্রা কি! মোহ নাকি ভালোবাসা,পরিণত নাকি অপরিণত! এইসব ভাবতে ভাবতে কোন কোন রাত পার হয়ে যায়।মাঝেমধ্যে এইসব ব্যাপার খুব সিলি মনে হয়।একজনের কথা ভেবে রাত জাগা হচ্ছে, অদ্ভুত মানসিকতা! তবে এইটা হচ্ছে থিওর্যকটিকাল কথা। হাইপোথিসিস অনেক দেওয়া যায়। ঠিক পরামর্শ যেমনটা অনেক দেওয়া যায়। কিন্তু ব্যাপারটা নিজের জীবনের ক্ষেত্রে হলে তখন তা ভিন্ন হয়ে দাড়ায়।
বুঝতে পারলাম অবন্তীর ব্যাপারটা প্রতীক্ষার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন, অপেক্ষায় সময়ের বন্ধনী থাকে, প্রতীক্ষায় থাকে না। অপেক্ষা সবার জন্যই করা যায়, প্রতীক্ষা করতে হয় বিশেষ কারো জন্য। তবে কি অবন্তী আমার বিশেষ কেউ!
(চলবে......)
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব
সপ্তম পর্ব
অষ্টম পর্ব
নবম পর্ব
দশম পর্ব